আজিমপুর কবরস্থান: গোড়ায় আগুন দিয়ে চলছে গাছ নিধন

গাছ অক্সিজেন দিয়ে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। সেই গাছকেই কিছু মানুষ নির্বিচারে ‘হত্যা’ করছে সামান্য স্বার্থে। বিক্রির উদ্দেশ্যে গাছ কাটা, জমি দখল কিংবা ভবন বা ভিন্ন কারণে গাছ নিধন হরহামেশা দেখা গেলেও এবার ঢাকা টাইমসের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ব্যতিক্রম বৃক্ষ নিধনের চিত্র। খোদ রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে গাছের গোড়ায় আগুন দিয়ে অভিনব কায়দায় বৃক্ষ নিধন করছে একটি চক্র। সবুজে ঘেরা এ কবরস্থানের চারশ বছরের পুরনো গাছগুলো এই কৌশলে সাবাড় করে ফায়দা লুটছে চক্রটি।
ওই কবরস্থান ঘুরে অন্তত ৫০টি গাছের গোড়া পোড়া অবস্থায় দেখা গেছে। পাতা পোড়ানোর নামে আগুন ধরিয়ে গাছগুলোর গোড়া পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। গোড়া পুড়ে কালো হয়ে গেলেও গাছগুলোতে সবুজ পাতা দেখা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এভাবে পুড়তে পুড়তে একদিন গাছটি মারা যায়। তখন ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে দুর্ঘটনা এড়াতে ওই গাছ কেটে ফেলতে আবেদন করা হয় সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে। এরপর নির্বিঘ্নে গাছ কেটে সামান্য মূল্য দেখিয়ে বিক্রি করা হয়। এই অপকৌশলে চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে নিধন করে আসছে চারশ বছরের প্রাচীন গাছগুলো।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পরিচ্ছন্ন ও নান্দনিক এ কবরস্থানে প্রবেশের ফটক রয়েছে দুটি। প্রধান ফটকের সঙ্গে কেয়ারটেকারের অফিস। বিভিন্ন প্রজাতির ফুল ও গাছ দিয়ে কবরস্থানের পুরো এলাকা সবুজায়ন করা হয়।
আয়তনের বিবেচনায় এ কবরস্থান বিশাল। এক সময় গাছ-গাছালিতে পরিপূর্ণ ছিল ভেতরের পরিবেশ। তবে বর্তমানে কবরস্থানে গেলেই চোখে পড়ে কিছুদিন আগেও অক্সিজেন সরবরাহকারী যে সবুজ গাছগুলো দাঁড়িয়ে ছিল, সেই গাছগুলো হঠাৎ করেই মৃত।
আবার কোনো কোনো গাছের ডালপালা ও শুকনো পাতাসহ কিছু অংশ পড়ে আছে। দেখলেই বোঝা যায় সেখান থেকে বিশাল আকৃতির কোনো গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। আশপাশের কিছু গাছ শুকিয়ে যেতেও দেখা গেছে ওই কবরস্থানে। কেন হঠাৎ করে গাছগুলো মরতে শুরু করেছে, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে আসে আগুনে পুড়িয়ে গাছ নিধনের চাঞ্চল্যকর তথ্য।
৯ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার। ঘড়ির কাঁটায় বিকাল সাড়ে তিনটা। কবরস্থানে প্রবেশ করে দেখা যায়, অর্ধশত গাছের গোড়ায় পোড়া দাগ। কবরস্থানের মূল গেট থেকে হেঁটে ৩৪ নম্বর পিলারের ডান পাশের চার ফুট রাস্তার শেষ প্রান্তে সীমানা প্রাচীরের কাছে তখন শতবর্ষী কড়ই গাছের গোড়ায় ধোঁয়া উড়ছিল। অথচ গাছটির কাণ্ডে সবুজ পাতা।
গাছটির কাছাকাছি থাকা মালির কাছে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা টাইমসের কাছে দাবি করেন, শুকনো পাতা জমিয়ে পোড়ানো হচ্ছে, তবে গাছ পোড়ানো হচ্ছে না। কবরস্থানের ভেতরে আরও কিছু গাছের গোড়ায় পোড়া ছাই, কয়লা দেখা গেছে।
কেন গাছের গোড়ায় আগুন জ্বালানো হয়েছে- জানতে চাইলে সে সময় কবরস্থানে কর্মরতরা ঢাকা টাইমসকে বলেন, কবরস্থানের ঝরা পাতা ও ময়লা পুড়িয়ে নষ্ট করতে প্রতিদিনই আগুন জ্বালানো হয়। তাই সেই আবর্জনা পোড়ানো আগুনের ছাই ও কয়লা পড়ে আছে।
অনুসন্ধান বলছে, আবর্জনা বা শুকনো পাতা পোড়ানোর নামে প্রতিনিয়ত গাছের গোড়ায় আগুন জ্বালানো হয় গাছ নিধনের উদ্দেশ্যে। পরবর্তীতে কিছু অসাধু লোকের যোগসাজশে মৃত গাছগুলো ভেঙে পড়ে কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে- এমন বাহানায় সেগুলো কেটে অপসারণের জন্য অনুমতি চাওয়া হয় কর্তৃপক্ষের কাছে।
এ বিষয়ে আজিমপুর কবরস্থানের ইমাম হাফিজুর রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, বর্তমানে ২৪ দশমিক ৪ একর কবরস্থান জুড়ে ছোট-বড় আনুমানিক ৪০০-৫০০টি গাছ রয়েছে। নভেম্বরের দিকে তিনটি গাছ কাটা হয়। গাছ কাটতে আসেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের স্কট ট্রেজারার আবদুল মোতালেব। তিনি গাছ কেটে করপোরেশনের গোডাউনে কেটে ফেলা গাছ বুঝিয়ে দেন। যেহেতু করপোরেশনের লোক কাগজপত্র মারফত এসে গাছ কেটে নিয়ে যায়, এ বিষয়ে কোনো প্রকার সিন্ডিকেট কাজ করার সুযোগ নেই।
কবরস্থানে স্বজনের কবর জিয়ারত করতে আসা স্থানীয় বাসিন্দা আসাদুজ্জামান আসাদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, বেশ কিছুদিন ধরেই এমনটি দেখা যাচ্ছে। আমি এই এলাকার স্থানীয় মানুষ। পাশেই আমার বাসা। প্রতি শুক্রবারই কবরগুলো জিয়ারতে আসি। চোখের সামনেই দিনের পর দিন গাছগুলোর হারিয়ে যাওয়া দেখছি। তবে কেন বা কী কারণে গাছগুলো কাটা হচ্ছে জানি না।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় পরিবেশ আন্দোলনের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, এমনিতেই ঢাকা শহরে সবুজের আচ্ছাদন কম। সব দেশেই প্রাচীন গাছ সংরক্ষণের একটি নীতিগত কাঠামো, সিদ্ধান্ত বা আইন থাকে। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে সে আইন নেই। আমরা এখনও বন বিভাগের অধীন, তা আইনে থাকলেও সে আইনে রাজধানীর গাছ-পালার বিষয়টি নিয়ে কাজ করে না। বিধায় আমরা এ বিষয়ে আইন তৈরির দাবিতে কাজ করছি। জরুরি বা জাতীয় প্রয়োজনে গাছ কাটা হলে তার বিপরীতে গাছ লাগানো জরুরি। এছাড়া গাছ না কাটার বিকল্প কোনো পথ আছে কি না, সেটিও ভাবতে হবে। বন অধিদপ্তরের নাম নিয়েই তো সমস্যা। কারণ বন আর গাছ সব সময় তো সর্মাথক নয়। ফলে বনের ওপর বন অধিদপ্তরের কর্তৃত্ব চললেও আমার-আপনার বাসার গাছ বা আজিমপুর কবরস্থানের গাছ, পার্কের গাছ কাটার বিষয়ে আলাদা কোনো বিধিমালা নেই। এ বিষয়ে কোনো আইন দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখনও হয়নি। একটা ছোট গাছ কাটারও কোনো এখতিয়ার কারও নেই।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা বাবর আলী মীর বলেন, এই ধরনের অভিযোগ আমি প্রথম শুনলাম। আমিও সরেজমিনে গিয়ে বিষয়টি দেখব এবং এ বিষয়ে যা যা পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন আমরা সে পদক্ষেপ গ্রহণ করব। আর অভিনব কায়দায় গাছ কাটার কোনো সুযোগ নেই আমাদের। কারণ ঝুঁকিপূর্ণ গাছ চিহ্নিত হলে সিটি করপোরেশনকে অবহিত করতে হয় এবং সিটি করপোরেশনের মনোনীত প্রকৌশলী টিম গিয়ে গাছ কাটে।
স্থানীয় কাউন্সিলর হাসিবুর রহমান মানিক ঢাকা টাইমসকে বলেন, ২০১৫ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর আজিমপুর কবরস্থানের সব প্রকার আধুনিকায়ন করার পদক্ষেপ হাতে নিই। গাছের বিষয়ে আমি তেমন কোনো অভিযোগ পাইনি। তবে অনেক সময় কবরের সংস্কার ও সংরক্ষণ ও খোঁড়াখুঁড়ির কারণে শেকড় কেটে ফেলতে হয় ইচ্ছা বা অনিচ্ছা সত্ত্বেও। কারণ সমাধিস্থ জায়গার স্বল্পতা রয়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে হাতে বিকল্প কিছু না থাকায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কবরস্থানগুলোর নীতিমালা ২০২২-এর ৮ নম্বর নীতিমালাতে বলা হয়েছে, সংরক্ষিত বা সাধারণ কবরের আশপাশে ফুল বা পাতা বাহার গাছ লাগানো যাবে। শিকড় বা মাটি আঁকড়ানো গাছ লাগানো থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় আজিমপুর কবরস্থানের মূল ইমাম ও প্রধান মোহরার মাওলানা হাফিজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, গাছ কাটার বিষয়টি দেখে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। তাদেরকে ঝুঁকিপূর্ণ গাছের তালিকা দেওয়া হলে তাদের ইঞ্জিনিয়ার স্কোয়াডের লোকজন এসে গাছ কেটে নিয়ে যাওয়ার ছাড়পত্র আমাকে দেয়। তারপর গাছ নিয়ে যায়। আর আপনারা যে বিষয়টি বলছেন এখান থেকে বাহিরের লোকজন বা স্টাফ কেউই একটা ডাল নিয়ে যাওয়ারও ক্ষমতা রাখে না। তাই এ অভিযোগ সঠিক নয়।
চারশ বছর পুরনো আজিমপুর কবরস্থানটির বর্তমান আয়তন প্রায় সাড়ে ৭৪ বিঘা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত আধুনিক এ কবরস্থানে ১৬০০ মিটার দৃশ্যমান সীমানা দেয়াল রয়েছে। এর মধ্যে উত্তর ও দক্ষিণ পাশে ৩২০ মিটার কাচের সীমানা। যে কারণে বাইরে থেকে কবরগুলো সহজেই চোখে পড়ে। ভেতরে চলাচলের জন্য ১৬৮টি হাঁটার পথ রয়েছে। প্রতিদিনই এই কবরস্থানে নগরবাসীর মরদেহ সমাহিত হচ্ছে।
(ঢাকাটাইমস/১২ফেব্রুয়ারি/এএম/এজে)

মন্তব্য করুন