ভাষা মতিনের স্মৃতিচারণ মেয়ের

‘বাবা বলতেন, ভাষা হারিয়ে গেলে জাতিও হারিয়ে যায়’

তানিয়া আক্তার, ঢাকা টাইমস
| আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৩:১১ | প্রকাশিত : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১:১১

বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের সূতিকাগার ভাষা আন্দোলন। এই ভাষা আন্দোলনের অগ্রনায়ক আবদুল মতিন। তদানীন্তন পাকিস্তানে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা রাখায় অভিহিত হয়েছিলেন ভাষা-মতিন নামে। জীবনভর আপামর জনগণের পরম শ্রদ্ধায় অভিষিক্ত ছিলেন তিনি। ভাষা-মতিনের বড় সন্তান নাট্যনির্মাতা মাতিয়া বানু শুকু। ঢাকা টাইমসের সঙ্গে বাবার সংগ্রামী জীবন সম্পর্কে নানা অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন।

বাবার সঙ্গে কাটানো শৈশবের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলুন।

বাবাকে আমি পাই আমার ৬ বছর বয়সে জেল থেকে বেরোবার পর। তার আগে জেল গেটে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, বয়স মনে নেই, তবে তিনি আমাকে একটা হলদে ফুল আর কপালে চুমু দিয়েছিলেন সেটা মনে আছে। জেল থেকে আমাকে তার লেখা একটা চিঠি এখনো আমার মায়ের কাছে আছে। কিন্তু প্রথম দেখায় তাকে আমি স্বাদরে গ্রহণ করতে পারিনি, তার বুকসমান দাঁড়ি দেখে আর আমার মাকে দখল করে নেওয়ার অপরাধে। ধীরে ধীরে সেই মানুষটাই কখন আমাদের সবচেয়ে কাছের হয়ে উঠেছে টেরই পাইনি। সত্তর বা আশির দশকে আমার আশপাশের অন্য কোনো পিতা-সন্তানের সম্পর্ক এতটা বন্ধুত্বপূর্ণ দেখিনি।

সাধারণ এক বাবার চেয়ে সংগ্রামী বাবাকে নিয়ে আপনার অনুভব কেমন?

ছোট বয়সে আলাদা করে সংগ্রামী বা সাধারণ বাবা টাইপের কোনো ধারণাই আমাদের হয়নি। কারণ বাড়িতে রাজনৈতিক পরিবেশ থাকার ফলে আমরা সারাক্ষণ বাবার সতীর্থ সংগ্রামী মানুষদের সঙ্গেই বেড়ে উঠেছি। বড়ো হওয়ার পর নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হয়েছে, সংগ্রামী বাবার কারণেই হয়তো আমরা চিন্তা-চেতনায় এগিয়ে থাকতে পেরেছি।

স্বাধীনতার পরের বছরই গ্রেপ্তার হয়ে জেল খেটেছেন প্রায় চার বছর। সেই সময়গুলোতে আপনার পরিবারের কেমন কেটেছে?

আমি তখন খুবই ছোট তাই আমার স্মৃতিতে কিছু নেই। মায়ের মুখে শুনেছি, তার অনেক কষ্ট হয়েছে। সদ্য স্বাধীন দেশে, একা দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে তাকে টিকে থাকার লড়াইয়ে নামতে হয়েছে। মা তখন স্কুলে চাকরি করতো, টিউশনি করতো। বাবা ফিরে আসার পরও সংসারের ঘানি আমার মায়ের একার ঘাড়েই ছিল। এ নিয়ে মায়েরও অভিযোগের জায়গা ছিল না, কারণ বিয়ের আগেই তাদের এ বিষয়ে পরিষ্কার কথা হয়ে গেছে যে, বাবা রাজনীতি করবে আর মা সংসার সামলাবে। প্রসঙ্গত, আমার মা’ও রাজনৈতিক পরিবারেরই মেয়ে ছিলেন।

সন্তান হিসেবে আপনার প্রতি তার কোনো প্রত্যাশা ছিল?

বাবা-মা মানেই প্রত্যাশার পাহাড়। তবে আমার বাবার একমাত্র প্রত্যাশা ছিল ‘প্রকৃত মানুষ হও’। আমার ছোটবোন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল। আমার ছিল শিল্পী হওয়ার আকাক্সক্ষা। বাবার নিজেরই ছিল শিল্পী সত্তা- তিনি ভালো ছবি আঁকতেন, ব্যাপক গল্প করতে পছন্দ করতেন, তুমুল রসবোধ ছিল তার।

ভাষার পাশাপাশি দেশের মানুষের জন্য জীবনভর যে সংগ্রাম করে গেছেন খুব কাছ থেকে তা পর্যবেক্ষণ করার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলুন।

ভাষার সংগ্রামটা ছিল প্রাসঙ্গিক। মূলত দেশপ্রেম, জাতিসত্তার বোধটাই ছিল প্রখর। দেশ বিভাগ, স্বাধীনতা, নিপীড়িত মানুষের অধিকার, রাষ্ট্রতন্ত্র, সমাজ এবং সমাজতন্ত্র সর্বোপরি দেশের মানুষকে ঘিরেই ছিল তার চিন্তা-চেতনা। আমরা কাছে থেকে তার এই চেতনার ছায়াতেই বড় হয়েছি।

বাবাকে নিয়ে বিশেষ কোনো স্মৃতি থাকলে সে সম্পর্কে বলুন।

অজস্র স্মৃতি। বিশেষ বলে আলাদা করে কোনটার কথা বলবো। বেড়ে ওঠার সময়টায় তাকে কাছে পাওয়াটাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে সৌভাগ্যময় অধ্যায়। এখনো প্রতি মুহূর্ত তাকেই স্মরণ করি। তার অভাব বোধ করি।

সংগ্রামী বাবার সংসার জীবন সামলাতে মায়ের ত্যাগ সম্পর্কে বলুন।

ছোটবেলায় বিষয়টা ত্যাগ বলে মনে হতো। এখন মনে হয় এটা আমার মায়ের সৌভাগ্য যে, তার মতো একজন মানুষের সঙ্গী হতে পেরেছিলেন। একইভাবে এটা আমার বাবারও সৌভাগ্য যে, এরকম পরিশ্রমী, চিন্তাশীল একজন সঙ্গী আমৃত্যু তার পাশে ছিলেন, ভালোবেসেছিলেন।

আপনার এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের বর্তমান অবস্থা কেমন?

আমরা দুই বোন। আমি লেখালেখি আর নাটক, সিনেমা নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত। ছোটবোন মালিহা শুভন স্কুলে শিক্ষকতা করেন।

মৃত্যুর আগে দেশের কোন বিষয়গুলো নিয়ে বাবাকে বেশি বলতে শুনছেন বা গুরুত্ব দিতে দেখেছেন?

একবারে শেষ সময়ে তিনি খুব গুছিয়ে চিন্তা করতে পারতেন না। তবে শেষ সময় পর্যন্ত একটা বিষয়ই তার কাছে গুরুত্ব পেতো। সেটা দেশ, দেশের জনগণ। আমাদের বলতেন, শুধু অর্থনৈতিক মুক্তিই না, শিক্ষা আর সংস্কৃতির অগ্রগতি ছাড়া কোনো জাতির মুক্তি নেই।

ভাষা সৈনিক আবদুল মতিনের সঙ্গে মাতিয়া বানু শুকু

বাংলা ভাষা নিয়ে তার যে স্বপ্ন ছিল তা বর্তমানে কতটা প্রতিফলিত হতে দেখছেন?

আমার বাবা সাহিত্যিক ছিলেন না, কাজেই শুধু ভাষা বা ভাষাতত্ত্ব নিয়ে তার মাথাব্যথা ছিল না। জাতিসত্তা, জাতীয়তাবোধ, নিজের ভাষা, কথা বলার অধিকার এসব বিষয়ই তার কাছে গুরুত্ব পেতো। তিনি আমাদের বলতেন, ভাষা হারিয়ে গেলে সে জাতিও বিলীন হয়ে যায়। বাংলা হারিয়ে যাওয়ার মতো দুর্বল ভাষা নয়। আমিও সেটা বিশ্বাস করি।

বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের সূতিকাগার বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্যতম রূপকার তিনি। মৃত্যুর পর তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা না দেওয়াকে স্বজন হিসেবে কীভাবে দেখছেন?

স্বজন হিসেবে নয়, বাঙালি হিসেবে বিষয়টাকে অসম্মানসূচক বলে মনে করি। এই রাষ্ট্রীয় মর্যাদা তার প্রাপ্য ছিল। তার মতো করে আরো অনেক ত্যাগী নায়কের অবদানকেই এখন আর আলোকিত করা হয় না। ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের এগিয়ে যাওয়ার পথ ক্রমেই অন্ধকারাচ্ছন্ন হবে বলে মনে করি।

রাষ্ট্রের কাছে আপনার পরিবারের কোনো প্রত্যাশা রয়েছে?

পরিবার হিসেবে নয়, স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের কাছে প্রত্যাশা, ‘অতীত যেন মুছে না যায়’। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে অতীতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সমুন্নত রাখার রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টা যেন থাকে। আমাদের সন্তানেরা যেন খুঁজলেই পেতে পারে শেকড়ের সঠিক ঠিকানা। নতুন প্রজন্মের জন্য যদি সেই পথ উন্মুক্ত না থাকে তবে অন্ধকারে নিমজ্জিত এক বিকৃত জাতির নাগরিক হিসেবে পরিগণিত হবে।

(ঢাকাটাইমস/২১ফেব্রুয়ারি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

সোনার ধানের মায়ায় হাওরে নারী শ্রমে কৃষকের স্বস্তি

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কঠোর বার্তা দেবে আ. লীগ 

গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন: চাহিদা বেড়েছে তরমুজের, ক্রেতা কম ডাবের

গাছ কাটার অপরাধে মামলা নেই 

কথায় কথায় মানুষ পেটানো এডিসি হারুন কোথায়? থানায় ছাত্রলীগ নেতাদের মারধরের তদন্ত কোথায় আটকে গেল?

মজুত ফুরালেই বাড়তি দামে বিক্রি হবে সয়াবিন তেল

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে ইরান-ইসরায়েল সংকট

ছাদ থেকে পড়ে ডিবি কর্মকর্তার গৃহকর্মীর মৃত্যু: প্রতিবেদনে আদালতকে যা জানাল পুলিশ

উইমেন্স ওয়ার্ল্ড: স্পর্শকাতর ভিডিও পর্নোগ্রাফিতে গেছে কি না খুঁজছে পুলিশ

জাবির হলে স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে জঙ্গলে ধর্ষণ, কোথায় আটকে আছে তদন্ত?

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :