তুরিন আফরোজকে নিয়ে যত বিতর্ক

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের একসময়ের দাপুটে প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। অনৈতিকভাবে আসামির সঙ্গে গোপন বৈঠকের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের সব মামলার কার্যক্রম থেকে তাকে প্রত্যাহার করা হয়। ২০১৮ সালের মে মাসে তাকে পদ হারাতে হয়।
এছাড়া নিজের মায়ের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানোর অভিযোগ আছে এই আইনজীবীর বিরুদ্ধে। একইসঙ্গে জামায়াত সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনে জন্মদাতা মাকে বাড়ি থেকেও বের করে দেন তিনি।
সেই তুরিন আফরোজকে সোমবার রাতে ঢাকার উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। অভিযোগ, ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে তার বিরাট ভূমিকা ছিল। তুরিনের বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও আছে। আজ তাকে আদালতে তুলবে পুলিশ।
উত্তরার বাসায় তুরিন আফরোজকে গ্রেপ্তারের পর রাতেই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. মহিদুল ইসলাম।
তিনি জানান, ‘পুলিশ অভিযানের সময় তার (তুরিন) ল্যাপটপ ও মোবাইলের ফেসবুক চেক করে অনেকগুলো সরকারবিরোধী প্রচারণা পেয়েছে। তুরিন আফরোজের বিরুদ্ধে এক ছাত্র হত্যাচেষ্টার মামলা রয়েছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে আব্দুল জব্বার নামের এক ছাত্রকে হত্যার উদ্দেশে গুলিবিদ্ধ করার অভিযোগে দায়ের করা মামলার ৩০ নম্বর আসামি তিনি। এ মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের পর আমরা তাকে থানায় নিয়ে এসেছি।’
মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিল পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। তৎকালীন সরকারের পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য ২০১৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি প্রসিকিউটর হিসেবে ব্যারিস্টার ড. তুরিন আফরোজকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।
সে সময় জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ অনেকের বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করে আলোচনায় চলে আসেন এই আইনজীবী।
তবে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার প্রভাবশালী আসামি জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক ডিজি মেজর (অব.) ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে গোপন বৈঠকের অভিযোগ ছিল তুরিনের বিরুদ্ধে। এরপরই ট্রাইব্যুনাল থেকে তাকে প্রত্যাহার করা হয়। একই সঙ্গে অনৈতিকভাবে আসামির সঙ্গে গোপনে বৈঠক করার অভিযোগ তদন্তের জন্য আইন মন্ত্রণালয়কে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদনও করা হয়।
মাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন তুরিন
রাজধানীর উত্তরার রেসিডেন্সিয়াল মডেল টাউনের ১১ নম্বর সড়কের ৩ সেক্টরের ১৫ নম্বর প্লটের পাঁচতলা বাড়িতে ২০০২ সাল থেকে বসবাস করে আসছিলেন তুরিন আফরোজের মা শামসুন্নাহার বেগম এবং তুরিনের ভাই শিশির আহমেদ শাহনেওয়াজ। তবে নিজের ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে মা ও ভাইকে ওই বাড়ি থেকে ২০১৭ সালে বের করে দেন তুরিন আফরোজ। পরে ওই বাড়ির ভোগ দখল ও মালিকানা দাবি করে শাহনেওয়াজ ও তুরিন আফরোজ ঢাকার যুগ্ম জেলা জজ আদালতে দুটি দেওয়ানি মামলা দায়ের করেন। ২০১৮ সালের ১১ অক্টোবর দুই পক্ষের আবেদনের শুনানি নিয়ে ওই বাড়ি ভোগদখলের ক্ষেত্রে স্থিতাবস্থা জারি করে ঢাকার পঞ্চম যুগ্ম জেলা জজ আদালত। সম্প্রতি সেই মামলার রায় নিজেদের পক্ষে পেয়েছেন শামসুন্নাহার বেগম এবং শিশির আহমেদ।
বিচারিক আদালতের মামলার আরজিতে তুরিন আফরোজ দাবি করেছিলেন, তার মা শামসুন্নাহার ১৯৯১ সালে ক্রয়সূত্রে উত্তরার সম্পত্তির মালিক হন। পরের বছর ১৯৯২ সালে শামসুন্নাহার তার স্বামী তসলিম উদ্দিনকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিযুক্ত করেন। পরে ১৯৯৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তসলিম উদ্দিন ওই সম্পত্তি মেয়ে তুরিন আফরোজকে হেবা (দানপত্র) করে দেন।
তবে শামসুন্নাহার ও তার ছেলে শাহনেওয়াজ আদালতে লিখিত জবাব দিয়ে বলেছিলেন, তসলিম উদ্দিন কখনো তার মেয়ে তুরিন আফরোজকে উত্তরার সম্পত্তি দানপত্র করেননি। বরং শামসুন্নাহার তার ছেলে শাহনেওয়াজকে উত্তরার সম্পত্তি ১৯৯৭ সালে হেবা করে দেন।
পরে ওই জমি শাহনেওয়াজের নামে নামজারি করে ১৯৯৯ সালে হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের কাছ থেকে ২৫ লাখ ঋণ নেওয়া হয়। রাজউকের অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী নির্মাণ করা বাড়িতে তারা ২০০২ সাল থেকে বসবাস করে আসছিলেন।
এদিকে ২০১৮ সালে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন তুরিন আফরোজ। তবে দল তাতে সাড়া দেয়নি।
কথিত গণকমিশনে ছিলেন তুরিন
ইসলামপন্থী রাজনীতিতে অর্থায়ন ও দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অভিযোগ এনে ১১৬ জন ধর্মীয় বক্তার একটি তালিকা দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) জমা দেয় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত তথাকথিত ‘গণকমিশন’।
২০২২ সালের ১১ মে দুদক চেয়ারম্যান মঈনউদ্দীন আবদুল্লার হাতে এই তালিকা তুলে দেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির গণকমিশনের চেয়ারম্যান ও বিতর্কিত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক (বর্তমানে গ্রেপ্তার হয়ে কারাবন্দি)। সঙ্গে ছিলেন সংগঠনটির সদস্যসচিব ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। এতে এক হাজার মাদরাসা ও ১১৬ জন ধর্মব্যবসায়ী/ ওয়াজকারী সম্পর্কে তথ্য দেওয়া হয়। যা সেসময় আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়।
শেখ হাসিনার পতনের দিন দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানো হয়। একইদিন নীলফামারীর জলঢাকায় ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজের ব্যক্তিগত কার্যালয়েও ভাঙচুর করা হয়েছিল।
তাছাড়া ২০ আগস্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তুরিন আফরোজসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে হেফাজতের সমাবেশে ‘গণহত্যার’ অভিযোগ তদন্তের আবেদন করা হয়। যাতে শেখ হাসিনাসহ শাহরিয়ার কবির, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকারের নাম রয়েছে।
(ঢাকাটাইমস/৮এপ্রিল/এসএস/এজে)

মন্তব্য করুন