ইউনিমার্টে কী ইসরায়েলি প্রডাক্ট বিক্রি হয়? সিলেটে ভাঙচুর, আতঙ্ক ঢাকায়ও

ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান দাবি করে চেইন সুপারশপ ইউনিমার্টের আউটলেটে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। সোমবার বিকালে সিলেট নগরীর দর্শন দেউড়ি এলাকায় এই হামলার ঘটনা ঘটে।
হামলাকারীদের অভিযোগ, ‘ফিলিস্তিনের নিরীহ মানুষকে গণহত্যায় জড়িত ইসরায়েল। তাদের পণ্যই বেশি বিক্রি করে ইউনিমার্ট। পূর্বেও তাদের সতর্ক করা হয়েছে কিন্তু তারা শোনেনি। তাই আজকে তৌহিদি জনতা তাদেরকে নিবৃত করার চেষ্টা করেছে। যারা ইসরায়েলি পণ্য বিক্রি করে দেশটিকে সহযোগিতা করছে তাদের বাংলার মাটিতে ঠাঁই হবে না।’
এখন প্রশ্ন উঠেছে ইউনিমার্ট কী আসলেই ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান? কেনই বা তাদের আউলেটে হামলা হলো?
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ আমলে সুবিধাভোগী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের অন্যতম ইউনাইটেড গ্রুপ। তাদেরই প্রতিষ্ঠান ইউনিমার্ট। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইউনিমার্টের বিরুদ্ধে কর্মী শোষণ, ভারতীয়দের চাকরির সুযোগ করে দেওয়া, বেশিদামে পণ্য বিক্রিসহ নানান অভিযোগ রয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন সময় মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ রাখা, নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় তরল দুধ না রাখা, দেশে উৎপাদিত শিল্পপণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে বিএসটিআইয়ের সনদ বাধ্যতামূলক হলেও অনুমোদন ছাড়া চকলেট, ফলের জুস, ইনস্ট্যান্ট নুডুলস, মধু, কফি ও বেবি শ্যাম্পু বিক্রির অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগে অনেকবার জরিমানার মুখোমুখি হতে হয়েছে ইউনিমার্টকে। তারা ইসরায়েলি শতশত ব্রান্ডের পণ্য তাদের আউটলেটগুলোতে বিক্রি করে থাকে। যা অন্যান্য সুপারশপ থেকে তুলনামূলকভাবে বেশি।
এদিকে ফিলিস্তিনিদের গণহত্যাকারী ইসরায়েলি পণ্য কেএফসি, ইউনিমার্টে বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে ইসরায়েলি কোমল পানীয় বিক্রি করা হয়। এটি মেনে নেওয়া যায় না উল্লেখ করে সিলেট নগরীর বিভিন্ন জায়গা থেকে দলে দলে মিরবক্সটুলা সড়কে জড়ো হতে থাকেন বিক্ষোভকারীরা। এরপর শহীদ মিনারে মিছিল নিয়ে আসার পথে রয়েলমার্ক ভবনের সামনে পিকআপ ভ্যানে থাকা ইসরায়েলি বিভিন্ন কোমল পানীয় নষ্ট করে ও পিকআপটি ভাঙচুর করা হয়। এছাড়া দরগা গেট এলাকায় বাটা জুতার বড় শো-রুমে হামলা এবং দর্শন দেউড়ি এলাকায় ইউনিমার্টের আউটলেটে হামলা হয়। তবে ইউনিমার্টের সামনে সেনাবাহিনী মোতায়েন থাকায় ভিতরে বিক্ষুব্ধ বিক্ষোভকারীরা তেমন ভাঙচুর করতে পারেনি।
সিলেটে ইউনিমার্টের আউটলেটে হামলার ঘটনায় ঢাকায়ও ক্রেতাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নিত্যপণ্য কিনতে গিয়ে সাধারণ ক্রেতাদের ওপর হামলার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ইসরায়েলি বাহিনীর নির্মম নির্যাতন বন্ধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসরায়েল বিরোধী আন্দোলন হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে ঢাকাসহ দেশজুড়ে লাখ লাখ সাধারণ মানুষ রাস্তা নেমেছিল। এতো কিছুর পরেও ইউনিমার্ট ইসরায়েলি পণ্য বিক্রি বন্ধ করেনি।
জানা গেছে, ইউনিমার্ট পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন ইউনাইটেড গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড রিয়েল এস্টেট কনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ল্যান্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শেখ ফারুক। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে গুলশান থানায় হত্যাচেষ্টার মামলা হয়েছে।
অভিযোগ আছে, গুলশানের ‘সেন্টার পয়েন্ট’ নামের ভবনটিতে শেখ ফারুকের হেলমেট বাহিনীর অফিস রয়েছে। যেখানে রয়েছে সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য। যাদের কাছে আছে- পুলিশ-প্রেস লেখা বুলেট প্রুফ জ্যাকেট, আত্মরক্ষার্থে ঢাল, অবৈধ অস্ত্র। ইউনাইটেড গ্রুপের যেকোনো দখলদারিত্ব বা কাউকে প্রতিহত করতে এই হেলমেট বাহিনী সরাসরি কাজ করে। সম্প্রতি এই ক্যাডার বাহিনীর হামলায় এসএস বিল্ডার্সের কয়েকজন নিরাপত্তারক্ষী আহত হন। এরমধ্যে মোহাম্মদ জনি নামে একজন নিরাপত্তারক্ষী এখন জীবন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। ইউনিমার্টের পরিচালক শেখ ফারুকের নির্দেশ আছে, তারা (ইউনিমার্ট) ইসরায়েলি পণ্য নিজেদের আউটলেটে প্রদর্শনী করে বিক্রি করবেন। সিলেটের মতো ঢাকায় কেউ তাদের প্রতিহতের চেষ্টা করলে তারাও সশস্ত্র ক্যাডার দিয়ে তা প্রতিহত করবেন।
ইউনিমার্টে পণ্য কিনতে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ক্রেতা:
সাধারণ ক্রেতারা বলছেন, ইউনিমার্টে পণ্য কিনতে গিয়ে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। কারণ আজকে সিলেটে হামলা হয়েছে। তবে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর উপস্থিতি থাকায় সেখানে তেমন ভাঙচুর হয়নি। ঢাকায়ও এমন ঘটনা ঘটতে পারে। এই নিয়ে একটা আতঙ্ক দেখা গেছে।
ইউনিমার্টে কেনাকাটা করেন এমন একাধিক ক্রেতার সঙ্গে কথা হয়েছে ঢাকাটাইমস প্রতিবেদকের। তাদের একজন মোহাম্মদেনাল মোক্তার বলেন, ‘অন্যান্য সুপারশপ থেকে ইউনিমার্টে অনেক পণ্যের দাম বেশি। আর প্রতিষ্ঠানটি ইসরাইলি অনেক কোম্পানির প্রডাক্ট বিক্রি করে। বিভিন্ন সময় এসব নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। তবে তারা কখনও সতর্ক হয়নি। ইউনিমার্ট ইসরাইলি পণ্য বিক্রি করে দেশটিকে আর্থিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। আর সেই টাকায় ফিলিস্তিনের নিরীহ মানুষকে বোমা ফেলে হত্যা করছে ইসরায়েল। আমরা ইউনিমার্টকে এখন বয়কট করব যদি না তারা এসব পণ্য বিক্রি বন্ধ করে।’
আবু সুফিয়ান নামে আরেক ক্রেতা বলেন, ‘ইউনিমার্টে আজকে হামলা হয়েছে শুনেছি। কেনাকাটা করতে গিয়ে জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে চাই না। তারা ক্রেতাদের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় আনছে কি-না সেটা তো জানি না। তাই আপাতত সেখানে কেনাকাটা করতে যাচ্ছি না।’ এছাড়া যদি ইসরাইলি পণ্য বিক্রি বন্ধ হয় তাহলে সেখানে কেনাকাটা করতে যাবেন বলে জানান এই ক্রেতা।
সামগ্রিক বিষয়গুলো নিয়ে ইউনিমার্ট লিমিটেডের উপদেষ্টা সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবীর মিলনকে একাধিক ফোন করা হলে তিনি তাতে সাড়া দেননি।
২০২৩ সালের নভেম্বরে সিলেটে ইউনিমার্টের আউটলেট চালু করা হয়। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন- পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর মঈনউদ্দিন হাসান রশীদ, ইউনিমার্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মুরতজা জামান প্রমুখ।
ইউনিমার্টের তরমুজ বিতর্ক:
গত বছর তরমুজের ভরা মৌসুমে গুলশানে অবস্থিত ইউনিমার্ট আউটলেটে প্রতি কেজি তরমুজ বিক্রি হচ্ছিল ১৮৫০ টাকায়। কেউ একজন সেই ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেন। যেখানে অর্ধেক তরমুজের দাম লেখা ছিল ৪,৭৬৩ টাকা। পরে এটা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হলে ইউনিমার্ট খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করায়। তাদের দাবি ছিল- ইউনিমার্টের তরমুজ বিদেশ থেকে আমদানি করা; যা তারা সরাসরি করেন না। বিদেশ থেকে আমদানি করা ফল হওয়ায় সরকারকে বেশি ডিউটি দিতে হয়। পাশাপাশি এয়ারে (বিমানে) পণ্য আমদানিতে দাম বেড়ে যায়। এ কারণে তরমুজের দাম বেশি ছিল।’
(ঢাকাটাইমস/০৭এপ্রিল/এসএস/এমআর)

মন্তব্য করুন