ইউনাইটেডের ফারুক-আবিদের নেতৃত্বে গুলশানে হেলমেট বাহিনীর তাণ্ডব

রাজধানীর গুলশানে সশস্ত্র সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছেন এসএস বিল্ডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তারক্ষীরা। এতে বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হয়েছেন।
শনিবার রাতে গুলশানের অভিজাত ‘সেন্টার পয়েন্ট’ ভবনের নিচতলায় এই হামলার ঘটনা ঘটে। হামলার নেতৃত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগ আমলে সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী গ্রুপ ইউনাইটেড গ্রুপের হেলমেট বাহিনীর প্রধান মো. আবিদ ও প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী (সিইও) শেখ ফারুক।
আহতদের সূত্রে জানা গেছে, ১০-১৫ জনের সন্ত্রাসী গ্রুপ হামলার সময় লোহার রড, রামদা ব্যবহার করে। তাদের পুলিশ ও প্রেস লেখা বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পরিহিত দেখা গেছে এবং ঢাল ব্যবহার করেছেন।
দুর্বৃত্তদের হামলায় গুরুতর আহত মোহাম্মদ জনিকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেলে এবং পরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার শারীরিক অবস্থা গুরুতর বলে জানান চিকিৎসকরা। হামলায় জনির পায়ের হাড় ভেঙে গেছে এবং মাথায় বেশ কয়েকটি সেলাই দেওয়া হয়েছে।
তাছাড়া শাকিব হোসেন, উসমানসহ তিনজন আহত হন। এই সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় থানায় অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী নিরাপত্তারক্ষী শাকিব হোসেন।
হামলার ঘটনায় লিখিত অভিযোগ পেয়েছে জানিয়ে পুলিশ বলছে, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে আটক করা যায়নি।
জানা গেছে, সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় ইউনাইটেড সিকিউরিটি সার্ভিসের ইনচার্জ মো. আবিদ ছাড়াও জড়িত ছিলেন ইউনাইটেড গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) শেখ মোহাম্মদ ফারুক হোসেন, নুর হোসেন, সারজিত হোসেন, মো. ফারুক, ইউনাইটেড সিকিউরিটি সার্ভিসের সুপারভাইজার রতন বিশ্বাস, পেট্রোল অফিসার শুভ, সিকিউরিটি সুপার ভাইজার আচাবুর রহমান, সিকিউরিটি আফজাল নাসের ভূঁইয়া, শহিদুল আলমসহ অজ্ঞাত আরও ১৫/১৬ জন।
ইউনাইটেড গ্রুপের অনিয়ম-দুর্নীতি, জালিয়াতি, বেআইনি সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার পাশাপাশি ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসায় অমানবিকতার ভুরি ভুরি অভিযোগ রয়েছে। তা নিয়ে ঢাকাটাইমসে বেশ কয়েকটি সংবাদ ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান মঈনুদ্দিন হাসান রশিদ, প্রধান উপদেষ্টা হাসান মাহমুদ রাজার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা রয়েছে।
এদিকে শনিবার গুলশান থানা করা এজাহার সূত্রে জানা গেছে, গুলশান সেন্টার পয়েন্টের লিফটের ১৮ তলায় অবস্থিত ফ্লোরের মালিক এসএস বিল্ডার্স। মালিকানা নিয়ে ইউনাইটেড টুইন টাওয়ার ডেভেলপারস্ লিমিটেডের সঙ্গে এসএস বিল্ডার্সের দ্বন্দ্ব চলছে। এরই জেরে শনিবার দুপুরে ১৮ তলায় পাহারায় থাকা নিরাপত্তা কর্মী রাজীব, মোন্তাসির ও জাহাঙ্গীরকে আটকে রাখে ইউনাইটেডের লোকজন। পরে তাদের দুজনকে ছেড়ে দেওয়া হলেও নিরাপত্তাকর্মী রাজীবকে ওই ভবনের দ্বিতীয় তলায় আটকে নির্যাতন করা হয়।
খবর পেয়ে নিরাপত্তাকর্মীরা একসঙ্গে রাজীবের খোঁজ করতে যান। সেন্টার পয়েন্টের নিচে ইউনাইটেডের হেলমেট বাহিনীর প্রধান শেখ ফারুক ও আবিদের নেতৃত্বে ১৫-১৬ জন হেলমেট পরিহিত সশস্ত্র লোক ১৮ তলায় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সিকিউরিটি অপারেশনের শাকিব, জনি, উসমানসহ অন্য নিরাপত্তারক্ষীদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। পরে এলোপাতাড়ি মারপিট শুরু করে। তাদের রামদার কোপে জনি গুরুতর আহত হন। এছাড়া উসমান, শাকিবসহ আরও কয়েকজন আহত হন।
আরও পড়ুন : এবার বেরিয়ে এল হাজার কোটি কর ফাঁকি, সর্বগ্রাসী ইউনাইটেড!
এসএস বিল্ডার্সের একজন ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ ক্রয় চুক্তি অনুযায়ী ইউনাইটেড গ্রুপ ওই ভবনের একটি ফ্লোর ২০১১ সালে আমাদের বুঝিয়ে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার প্রায় দশ বছর পর ২০২১ সালে আমাদের বুঝিয়ে দেয় (লিফটের ১৮ তলা)। এরপর আমরা তৃতীয় পক্ষকে অফিস হিসেবে ভাড়া দিয়েছিলাম। আওয়ামী লীগ সরকার পরিবর্তনের পর ওই ভাড়াটিয়া চলে গেলে নতুন করে একজনকে ভাড়া দেওয়া হয়। তারা ডেকোরেশেনের কাজ শুরু করলে হঠাৎ ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৮ তলার বিদ্যুৎ, পানি ও লিফট বন্ধ করে দেয় ইউনাইটেড।
বিষয়টি নিয়ে ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান মঈনউদ্দিন হাসান রশিদের কাছে কারণ জানতে চাইলে তিনি এসএস বিল্ডার্সের কর্মকর্তাকে বলেন, ‘আমাদের নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। এ কারণে বিদ্যুৎ, পানি ও লিফট সংযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে। এর সঙ্গে আমাদের (এসএস বিল্ডার্স) সংশ্লিষ্টতা নেই জানালে মঈনউদ্দিন হাসান আমাকে আশ্বস্ত করেন তিনি বিষয়টি দেখবেন।’
কিন্তু সুরাহা না হওয়ায় ২৮ ফেব্রুয়ারি বিষয়টি আদালতকে অবহিত করা হয়। পরে সেখানে দখল শর্তে স্থিতাবস্থা (১৪৫ ধারা) জারি করেন আদালত। এরপরেই শনিবার ওই ফ্লোরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তা কর্মীদের ওপর সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটে।
গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোখলেসুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ঘটনার পর আমরা সরেজমিনে গিয়েছিলাম। বিষয়টি নিয়ে ভুক্তভোগী এসএস বিল্ডার্স একটি অভিযোগ দিয়েছে। সেটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।’
আরও পড়ুন : খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় অপারগতা: ইউনাইটেড বয়কট ও বিচার চান ক্ষুব্ধ নেতারা
গুলশান জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) আলী আহমেদ মাসুদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মারামারির একটা ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ বিষয়টি দেখছে।’
ও্ই ঘটনায় মামলা হওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করে আজ গুলশান বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) তারেক মাহমুদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘তবে এখন পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হননি। পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। আমরা দুই পক্ষকে নিয়ে বসেছিলাম। তাদেরকে শান্ত থাকতে বলেছিলাম। এর মধ্যেই মারামারির ঘটনা ঘটেছে।’
হামলার অভিযোগের বিষয়ে জানতে ইউনাইটেড শিল্পগ্রুপটির কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে এই শিল্পগোষ্ঠীর কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে জুলাই আন্দোলন দমনের অভিযোগে পাঁচটি হত্যা মামলা হয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারকে বিপুল অর্থসহায়তা করে ইউনাইটেড গ্রুপ।
আরও পড়ুন : অবৈধ ভবন নিয়ে ইউনাইটেড গ্রুপের জবাব পায়নি রাজউক, বেরিয়ে আসছে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য
আওয়ামী লীগ সরকারকে খুশি করতে গত বছরের ২১ জুন বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে চিকিৎসা সহায়তা না দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে ইউনাইটেড গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে।
তাছাড়া ক্যান্টনমেন্টের মইনুল রোডের বাড়ি থেকে বেগম খালেদা জিয়াকে বের করে দেওয়ার ঘটনায় সরাসরি জড়িত ছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আব্দুল মুবীন। এই মুবীন সম্পর্কে ইউনাইটেড গ্রুপের প্রধান উপদেষ্টা হাসান মাহমুদ রাজার বেয়াই। মুবীন পরে ইউনাইটেড গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড পাওয়ারের চেয়ারম্যান হন।
সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর গোয়েন্দা বিভাগের অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে, ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকার কর ফাঁকি দিয়েছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী এই শিল্পগ্রুপটি। এমনকি ব্যক্তি পর্যায়ে গ্রুপের কয়েকজন পরিচালক কর ফাঁকি দিয়েছেন ৪০ কোটি টাকা।
আইন অনুযায়ী গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরকারকে দেওয়ার কথা, তা না করে বেশি দামে বেসরকারি খাতে বিক্রি করছে মাফিয়া হয়ে ওঠা ইউনাইটেড। গত ২ নভেম্বর ‘নিয়মবহির্ভূত সুবিধা নিয়ে ও আইন ভেঙে মুনাফা লুটছে ইউনাইটেড পাওয়ার’ শিরোনামে ঢাকাটাইমসের প্রতিবেদনে দেখা যায়, তারা প্রতি ঘনমিটারে গ্যাস কিনছে ১৬.৭৫ টাকা দরে, কিন্তু একই গ্যাস অন্যান্য বিদ্যুৎ কোম্পানির কিনতে হয় ৩০.৭৫ টাকায়।
এই ইউনাটেড গ্রুপের বিরুদ্ধে আইনের ব্যত্যয় ও অনিয়ম করে বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ নানা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চালানোর অভিযোগের পাশাপাশি শিল্পগ্রুপের কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও অভিযোগের অন্ত নেই। কিন্তু তারা সব সময় থেকে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
হাজার কোটি টাকা কর ফাঁকির ছাড়াও ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের তদন্তে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এরই মধ্যে প্রাথমিক তথ্য পেয়েছে।
গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর ইউনাইটেড গ্রুপের কর্ণধার হাসান মাহমুদ রাজা, চেয়ারম্যান ও এমডি মঈনউদ্দিন হাসান রশিদ ও গ্রুপের কর্মকর্তা কর্নেল (অব.) আফজালের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে হত্যা মামলা হয়। আন্দোলনের সময় ঢাকার প্রগতি সরণিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত বাহাদুর হোসেন মনিরের বাবা আবু জাফরের করা মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এই তিনজনও আসামি। তাদের বিরুদ্ধে আরও চারটি মামলা হয়েছে। বিশেষ করে জুলাই ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ সরকারকে অর্থায়নের অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।
এই গ্রুপের প্রধান কার্যালয় ও ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিরুদ্ধে ভবন নির্মাণে অনিমের অভিযাগও রয়েছে। আওয়ামী লীগ আমলে সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ইউনাইটেড গ্রুপের এসব স্থাপনা গড়ে তোলায় অনুমোদন নেই রাজউকের। এ নিয়ে রাজউক থেকে বিভিন্ন সময় নকশা ও নথি চেয়ে একাধিকবার চিঠি দিলেও তা সরবরাহে গড়িমসি করে ইউনাইটেড।
গত ৩ নভেম্বর মাদানি এভিনিউয়ে অনুমোদন ছাড়া ইউনাইটেড গ্রুপের প্রধান কার্যালয় গড়ে তোলায় ভবনটি কেন ভেঙে ফেলা হবে না তা জানতে চিঠি দেয় রাজউক। এরপর টনক নড়ে ইউনাইটেডের। তারা দৌড়ঝাঁপ শুরু করে রাজউকে।
এই গ্রুপের ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধেও নানা সময়ে চিকিৎসা অবহেলার অভিযোগ উঠেছে রোগীর স্বজনদের তরফে। সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালে মারা যায় শিশু আয়ান। শিশুটির বাবা শামিম আহমেদ ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঈন উদ্দিন হাসান রশিদ এবং সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনাইটেড মেডিকেল হাসপাতালের চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ রাজাসহ আটজনের বিরুদ্ধে ডিবিতে অভিযোগ করেন।
(ঢাকাটাইমস/২৩মার্চ/মোআ)

মন্তব্য করুন