এবার বেরিয়ে এল হাজার কোটি কর ফাঁকি, সর্বগ্রাসী ইউনাইটেড!

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা টাইমস
  প্রকাশিত : ১৮ মার্চ ২০২৫, ১৮:৫০| আপডেট : ১৮ মার্চ ২০২৫, ২০:৫৫
অ- অ+

ব্যবসার নানা ক্ষেত্রে ইউনাইটেড গ্রুপের অনিয়ম-দুর্নীতি, জালিয়াতি, আইন লঙ্ঘন, বেআইনি সুবিধা নেওয়ার খবরের পর এবার বেরিয়ে এল আয়কর ফাঁকির তথ্য। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর গোয়েন্দা বিভাগের অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকার কর ফাঁকি দিয়েছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী এই শিল্পগ্রুপটি। এমনকি ব্যক্তি পর্যায়ে গ্রুপের কয়েকজন পরিচালক কর ফাঁকি দিয়েছেন ৪০ কোটি টাকা।

ইউনাইটেড গ্রুপের বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো অনুমোদন থেকে শুরু করে স্থাপন, উৎপাদন, বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ, সরবরাহ, বিক্রি, গ্যাস কেনা ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে আইনের লঙ্ঘন ও প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের ইচ্ছামতো সুবিধা নেওয়ার বিষয়ে ইতিমধ্যে ঢাকাটাইমসে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। গত ২ নভেম্বর নিয়মবহির্ভূত সুবিধা নিয়ে ও আইন ভেঙে মুনাফা লুটছে ইউনাইটেড পাওয়ার শিরোনামে ঢাকাটাইমসের একটি প্রতিবেদনে এসব বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য উঠে আসে।

কোম্পানি প্রতিষ্ঠায় অনিয়ম, প্রভাব খাটানো, হুমকি আর অপকৌশল অবলম্বনের বেপরোয়া ধারা ইউনাইটেড গ্রুপ সরকারের রাজস্ব ফাঁকিতেও ব্যবহার করছে।

এনবিআরের কর গোয়েন্দা বিভাগের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, এই রাজস্ব ফাঁকিতে ইউনাইটেড গ্রুপের সাতটি বিদ্যুৎ কোম্পানির মধ্যে মূল সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এই কোম্পানি বিভিন্ন করবর্ষে তার শেয়ারহোল্ডারদের নগদ লভ্যাংশ থেকে উৎসে আয়কর কর্তন করে। কিন্তু কোম্পানি ও পরিচালকদের লভ্যাংশ থেকে আয়কর না কেটে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে।

ইউনাইটেড পায়রা পাওয়ার লিমিটেড, ইউনাইটেড আশুগঞ্জ এনার্জি লিমিটেড, ইউনাইটেড ময়মনসিংহ পাওয়ার লিমিটেড, ইউনাইটেড এনার্জি লিমিটেড, ইউনাইটেড আনোয়ারা পাওয়ার লিমিটেড ও ইউনাইটেড জামালপুর পাওয়ার লিমিটেড- নিজের এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র অলসভাবে বসিয়ে রেখে বিগত আওয়ামী সরকারের আনুকূল্যে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে ৭ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা পকেটে পুরেছে ইউনাইটেড গ্রুপ।

এ ছাড়া অন্যান্য গ্রুপের কোম্পানির চেয়ে কম মূল্যে গ্যাস কেনার সুযোগ, সরকারকে না দিয়ে বেসরকারি খাতে বেশি দামে বিদ্যুৎ বিক্রির মতো আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ আছে ইউনাইটেড পাওয়ারের বিরুদ্ধে। এভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা তারা লুপাট করেছে সরকার ও জনগণ থেকে। এর সঙ্গে বছরের পর বছর আয়কর ফাঁকি দিয়ে গেছে প্রতিষ্ঠানটি।

ইউনাইটেডের দাবি, বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে আয় করমুক্ত। কিন্তু সরকারের এসআরও অনুযায়ী, ইউনাইটেড ময়মনসিংহ পাওয়ার, ইউনাইটেড এনার্জি ও তাদের পরিচালকদের লভ্যাংশ করমুক্ত নয়। তাই কোম্পানিগুলো প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০১৭-১৮ করবর্ষ পর্যন্ত এবং পরিচালকরা ২০১৫-১৬ করবর্ষ পর্যন্ত লভ্যাংশের ওপর আয়কর দিয়েছেন। এরপর সুপ্রিম কোর্টে একটি রেফারেন্স মামলা করে আর লভ্যাংশের ওপর আয়কর দিচ্ছেন না তারা।

একে অসৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলছেন এনবিআর কর্মকর্তারা। তাদের মতে, কর ফাঁকির টাকা ঝুলিয়ে রাখতে করযোগ্য লভ্যাংশ আয়কে করমুক্ত দাবি করে ইউনাইটেডের পরিচালকরা রেফারেন্স মামলা করেন।

প্রশ্ন উঠেছে এই মামলা সব শেয়ারহোল্ডারের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য হওয়ার কথা। কিন্তু ইউনাইটেড সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ থেকে উৎসে কর কাটলেও কোম্পানি ও পরিচালকদের বেলায় তা না করে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে।

জানা যায়, ইউনাইটেড ময়মনসিংহ পাওয়ার লিমিটেড ২০১৯-২০ করবর্ষ থেকে সর্বশেষ ২০২৪-২৫ পর্যন্ত ৯৩৭ কোটি ৮৮ লাখ ৭১ হাজার ৩১৯ টাকা রাজস্ব ফাঁকি দেয়। আর এ সময়ে ইউনাইটেড এনার্জি লিমিটেড ফাঁকি দিয়েছে ৩২২ কোটি ২৬ লাখ ৬৯ হাজার ৩৭২ টাকা।

কর গোয়েন্দাদের সূত্রে একটি দৈনিকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউনাইটেড গ্রুপের যে চার পরিচালক ৪০ কোটি টাকা কর ফাঁকি দিয়েছেন, তারা হলেন মঈনুদ্দিন হাসান রশিদ, হাসান মাহমুদ রাজা, খন্দকার মঈনুল আহসান শামীম ও ফরিদুর রহমান খান।

এই চারজন শুধু ২০১৭-১৮ করবর্ষে প্রায় ২২ কোটি টাকা কর ফাঁকি দেন। এর মধ্যে মঈনুদ্দিন হাসান ৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকা, হাসান মাহমুদ ১২ কোটি ৭১ লাখ টাকা, খন্দকার মঈনুল আহসান চার কোটি দুই লাখ টাকা এবং ফরিদুর রহমানের কর ফাঁকির পরিমাণ এক কোটি আট লাখ টাকা।

এ ছাড়া হাসান মাহমুদ ২০১৮-১৯ করবর্ষে পাঁচ কোটি ২৬ লাখ টাকা ও খন্দকার মঈনুল আহসান ২০১৬-১৭ করবর্ষে ১২ কোটি ৪২ লাখ টাকা কর ফাঁকি দেন।

আয়কর গোয়েন্দাদের প্রতিবেদনে ইউনাইটেড গ্রুপের বিপুল রাজস্ব পুনরুদ্ধারে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। তাদের আশঙ্কা, ওই সব কম্পানি ও পরিচালকদের ফাঁকি দেওয়া আয়কর আদায় না হলে অন্যান্য খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোও কর ফাঁকি দিতে উৎসাহিত হবে। তাতে বিপুল রাজস্ব হারাবে সরকার।

গ্রুপটির বড় অঙ্কের কর ফাঁকির বিষয়ে জানতে ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান মঈন উদ্দিন হাসান রশিদের কাছে জানতে তার দপ্তরের ফোন নম্বরে যোগাযোগ করলে সালমান নামে একজন ফোন ধরেন। তিনি চেয়ারম্যানের ব্যস্ততার কথা জানিয়ে জনসংযোগ দপ্তর কিছুক্ষণের মধ্যে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে যোগাযোগ করবে বলে জানান। কিন্তু পরবর্তী কয়েক ঘণ্টায়ও কেউ আর যোগাযোগ করেনি।

তবে একটি দৈনিকে প্রকাশিত ইউনাইটেডের পরিচালক কুতুবুদ্দিন আকতার রশিদের বক্তব্যে দাবি করা হয়, তারা এটিকে কর ফাঁকি বলতে নারাজ। তার ভাষ্য, বিদ্যুতের আয়ে সব ধরনের আয় করমুক্ত।

এভাবে সব ক্ষেত্রেই নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করে সরকারি আনুকূল্যে সুবিধা নিতে সিদ্ধহস্ত ইউনাইটেড গ্রুপ।

বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে দেশের আইনে ইনডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি) বিদ্যুৎকেন্দ্র সরকারের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন করে তা সরকারকে দেবে। তবে তারা বাইরে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে পারবে না। কমার্শিয়াল ক্যাটাগরির ক্যাপটিভের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, উৎপাদিত বিদ্যুৎ নিজস্ব কারখানায় ব্যবহারের পর উদ্বৃত্ত অংশ শর্তসাপেক্ষে বিক্রি করার সীমিত সুযোগ আছে। তবে তার দাম নির্ধারণ করবে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন।

অথচ অনিয়ম করে স্থাপিত ইউনাইটেডের ঢাকার ইপিজেড এলাকায় ৮৬ মেগাওয়াট ও চট্টগ্রাম ইপিজেডে ৭২ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরকারকে না দিয়ে বেশি দামে বেসরকারি খাতে বিক্রি করছে এই খাতে মাফিয়া হয়ে ওঠা ইউনাইটেড।

গত ২ নভেম্বর নিয়মবহির্ভূত সুবিধা নিয়ে ও আইন ভেঙে মুনাফা লুটছে ইউনাইটেড পাওয়ার শিরোনামে ঢাকাটাইমসের প্রতিবেদনে দেখা যায়, তারা প্রতি ঘনমিটারে গ্যাস কিনছে ১৬.৭৫ টাকা দরে, কিন্তু একই গ্যাস অন্যান্য বিদ্যুৎ কোম্পানির কিনতে হয় ৩০.৭৫ টাকায়। গ্যাস দিয়ে ইউনিটপ্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ৪.১৭ টাকা, সেই বিদ্যুৎ ইউনাইটেড ১০.৮৮ টাকা দরে বিক্রি করে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে।

এই ইউনাটেড গ্রুপের বিরুদ্ধে আইনের ব্যত্যয় ও অনিয়ম করে বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ নানা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চালানোর অভিযোগের পাশাপাশি শিল্পগ্রুপের কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও অভিযোগের অন্ত নেই। কিন্তু তারা সব সময় থেকে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের তদন্তে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এরই মধ্যে প্রাথমিক তথ্য পেয়েছে।

গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর ইউনাইটেড গ্রুপের কর্ণধার হাসান মাহমুদ রাজা, চেয়ারম্যান ও এমডি মঈনউদ্দিন হাসান রশিদ ও গ্রুপের কর্মকর্তা কর্নেল (অব.) আফজালের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে হত্যা মামলা হয়। আন্দোলনের সময় ঢাকার প্রগতি সরণিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত বাহাদুর হোসেন মনিরের বাবা আবু জাফরের করা মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এই তিনজনও আসামি। তাদের বিরুদ্ধে আরও চারটি মামলা হয়েছে। বিশেষ করে জুলাই ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ সরকারকে অর্থায়নের অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।

আরও পড়ুন>>ইউনাইটেড গ্রুপের অনুমোদনহীন ভবন কেন ভেঙে ফেলা হবে না, রাজউকের নোটিশ

এই গ্রুপের প্রধান কার্যালয় ও ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বিরুদ্ধে ভবন নির্মাণে অনিমের অভিযাগও রয়েছে। আওয়ামী লীগ আমলে সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ইউনাইটেড গ্রুপের এসব স্থাপনা গড়ে তোলায় অনুমোদন নেই রাজউকের। এ নিয়ে রাজউক থেকে বিভিন্ন সময় নকশা ও নথি চেয়ে একাধিকবার চিঠি দিলেও তা সরবরাহে গড়িমসি করে ইউনাইটেড।

গত ৩ নভেম্বর মাদানি এভিনিউয়ে অনুমোদন ছাড়া ইউনাইটেড গ্রুপের প্রধান কার্যালয় গড়ে তোলায় ভবনটি কেন ভেঙে ফেলা হবে না তা জানতে চিঠি দেয় রাজউক। এরপর টনক নড়ে ইউনাইটেডের। তারা দৌড়ঝাঁপ শুরু করে রাজউকে।

এই গ্রুপের ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধেও নানা সময়ে চিকিৎসা অবহেলার অভিযোগ উঠেছে রোগীর স্বজনদের তরফে। সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালে মারা যায় শিশু আয়ান। শিশুটির বাবা শামিম আহমেদ ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঈন উদ্দিন হাসান রশিদ এবং সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনাইটেড মেডিকেল হাসপাতালের চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ রাজাসহ আটজনের বিরুদ্ধে ডিবিতে অভিযোগ করেন।

(ঢাকাটাইমস/১৮মার্চ/মোআ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
আধুনিক বিমান বাহিনী গড়ে তুলতে প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে: প্রধান উপদেষ্টা
বগুড়ায় অ‌টো‌রিকশা চালক হত্যার দায়ে দুজ‌নের মৃত্যুদণ্ড
রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন 
ক্রান্তিকালে দেশ, আয় কমছে শ্রমজীবী মানুষের: রিজভী
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা