ইউনাইটেড গ্রুপের অনুমোদনহীন ভবন কেন ভেঙে ফেলা হবে না, রাজউকের নোটিশ

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) অনুমতি ছাড়া ভবন নির্মাণ এবং সেখানে প্রধান কার্যালয় গড়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে ইউনাইটেড গ্রুপ। তবে এই স্থাপনা কেন ভেঙে অপসারণ এবং মালিকদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না তা জানতে ইউনাইটেডকে চিঠি দিয়েছে রাজউক।
অভিযোগ আছে, বিগত সরকারের আমলে আইনের তোয়াক্কা না করে রাজধানীর ভাটারা থানাধীন মাদানী এভিনিউয়ে পাঁচতলা সুবিশাল ভবনটি নির্মাণ করা হয়। ১০০ ফুট রাস্তা নামে পরিচিত এই সড়কের পাশেই ইউনাইটেড সিটি। ২৫ বিঘা জমির ওপর গড়ে তোলা এই সিটিতে রয়েছে ইউনাইটেড গ্রুপের প্রধান কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থাপনা।
রাজউকের অনুমতি ছাড়া তৈরি স্থাপনা দ্রুত অপসারণে কাজ শুরু করা উচিত বলে মন্তব্য করেন নগর ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, মানুষকে নিয়ম মানাতে রাউজউকের যথেষ্ট সক্ষমতা রয়েছে।
আওয়ামী লীগ আমলে সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোর অন্যতম এই ইউনাটেড গ্রুপ। অনিয়ম আর আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ নানা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চালানোর অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। এই শিল্পগ্রুপের কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও অভিযোগের অন্ত নেই। অনিয়ম, দুর্নীতি, বিদেশে অর্থপাচার, শেয়ার কেলেঙ্কারি, আইন ভেঙে বিদ্যুৎখাতে লুটপাট, ইউনাইটেড হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু, নারী রোগীকে যৌন হয়রানিসহ নানান অভিযোগ থাকলেও তারা সব সময় থেকে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
সম্প্রতি ইউনাইটেডের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে অর্থপাচারের তদন্ত। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এরই মধ্যে অর্থপাচারের প্রাথমিক কিছু তথ্য পেয়েছে। এছাড়া ৩০ সেপ্টেম্বর ইউনাইটেড গ্রুপের কর্ণধার ও পরিচালকসহ তিনজনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা হয়। ছাত্র আন্দোলনে ঢাকার প্রগতি সরণিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত বাহাদুর হোসেন মনিরের বাবা আবু জাফর মামলাটি করেন।
কিন্তু এজাহারনামীয় আসামি হলেও ইউনাইটেড গ্রুপের প্রধান উপদেষ্টা হাসান মাহমুদ রাজা, চেয়ারম্যান ও এমডি মঈনউদ্দিন হাসান রশিদ ও গ্রুপের কর্মকর্তা কর্নেল (অব.) আফজাল রয়ে গেছেন গ্রেপ্তারের বাইরে। সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের নানান সুবিধাভোগী এই তিনজনকে এখনো বিশেষ কোনো সুবিধা দেওয়া হচ্ছে কি-না এমন প্রশ্নও উঠছে বিভিন্ন মহলে।
মাদানী এভিনিউর পাশে যে ইউনাইটেড সিটির কথা বলা হচ্ছে, সেখানে ইউনাইটেড গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ের পাশাপাশি আইটি পার্ক, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ইউনাইটেড ফার্মাসহ গ্রুপটির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ও রয়েছে।
কিন্তু সেখানে ভবন নির্মাণে রাজউকের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও ইউনাইটেড তার প্রয়োজনীয়তা মনে করেনি। নিয়মের তোয়াক্কা না করেই গড়ে তুলেছে গ্রুপের বিলাসবহুল অফিস ভবন।
অনুমোদনহীন পাঁচতলা সেই ভবন সরেজমিন করেছে ঢাকা টাইমসের অনুসন্ধান টিম। বিশাল আকারের চাকচিক্যময় পাঁচতলা ভবনটি নিরাপত্তার চাদরে মোড়ানো। আশপাশে কিছুটা ঘুরে দেখতেই অনুসন্ধান টিমের সামনে হাজির ইউনাইটেড গ্রুপের নিরাপত্তা বাহিনী। তারা তীক্ষ্ণ নজর রাখে টিমের ওপর। ভবনসহ আশপাশের ছবি-ভিডিও তোলায় বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে তারা।
অনুমোদনহীন পাঁচতলা ভবনটি নিয়ে ইউনাইটেড গ্রুপকে কারণ দর্শানো নোটিশ দিয়েছে রাজউক। ওই নোটিশের কপি হাতে পেয়েছে ঢাকা টাইমস। নোটিশে লেখা আছে, ‘ঢাকার মাদানী এভিনিউয়ের বড় কাঠালদিয়া মৌজায় রাজউকের মহাপরিকল্পনাভুক্ত এলাকায় ইউনাইটেড গ্রুপের একটি পাঁচতলা ইমারত (ভবন) রয়েছে। যা ড্যাপের আওতাধীন এলাকায় পাঁচতলা ভবনটি ইমারত নির্মাণ আইন, ১৯৫২ সালের ধারা-৩ এবং ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালা ২০০৮ লংঘন করে রাজউক হতে অনুমোদন না নিয়েই করা হয়েছে। উল্লেখিত ইমারত ব্যবহার আইন ও বিধির প্রতি অশ্রদ্ধার শামিল।’ নোটিশ পাওয়ার সাত দিনের মধ্যে ইউনাইটেড গ্রুপকে জবাব দিতে বলেছে রাজউক।
এই নোটিশের বিষয়ে রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ইমরুল হাসানের সঙ্গে কথা বলে ঢাকাটাইমস। তিনি বলেন, ‘বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে নোটিশের জবাব না এলে বিধিমালা অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
বিষয়টি নিয়ে ইউনাইটেড গ্রুপের সিনিয়র ম্যানেজার শীষ স্বপ্নিকের কাছে জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন, এই সংক্রান্ত কোনো তথ্য তার জানা নেই।
ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান ও এমডি মঈনউদ্দিন হাসান রশিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মোবাইল ফোনে কল ও খুদে বার্তায় সাড়া দেননি।
প্রশ্ন উঠেছে, এভাবেই কি তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকবে? প্রভাবশালীরা রাজউকের অনুমোদন ছাড়া রাজধানীর বুকে বড় বড় ভবন গড়ে তুলেছে, যা ভবিষ্যৎ ঢাকার জন্য ভয়াবহ। এর শেষ কোথায়?
নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা নির্মাণে আইন ও বিধি সবার জন্য সমান। যারা ইতোপূর্বে আইন মানেনি, ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে অনিয়ম করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে নজির তৈরি করতে হবে। তাহলেই এমন অপকর্ম রোধ করা সম্ভব।
রাজউকের অনুমতি ছাড়া তৈরি স্থাপনা দ্রুত অপসারণে কাজ শুরু করা উচিত বলে মন্তব্য করেন পরিবেশ আন্দোলন বাংলাদেশের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘এর আগে আমরা বহুতল র্যাংগস ভবন, বিজিএমইএ ভবন ভাঙতে দেখেছি।’ এই পরিবেশবিদ মনে করেন, মানুষকে নিয়ম মানাতে রাউজউকের যথেষ্ট সক্ষমতা রয়েছে।
ইউনাইটেড গ্রুপের অনিয়ম ও বেআইনি কর্মকাণ্ডের অনুসন্ধানে এর আগে বিদ্যুৎ খাতের ‘হঠাৎ মাফিয়া’ হিসেবে দেখতে পায় ঢাকাটাইমস। এ নিয়ে সম্প্রতি ঢাকাটাইমসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে অভিযোগ পাওয়া যায়, গ্যাসভিত্তিক দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অনুমতি না থাকলেও তারা উৎপাদন অব্যাহত রেখেছে। তৎকালীন সরকারের কাছ থেকে কম দামে গ্যাস কেনার বিশেষ সুবিধা পায় গ্রুপটির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড পাওয়ার। আবার উৎপাদিত বিদ্যুৎ বেশি দামে বেসরকারি খাতে বিক্রি করছে, যা আইনের লঙ্ঘন। গ্রুপটির এত অপকর্মের পরও তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থার নজির নেই।
অভিযোগ রয়েছে, ক্যাপটিভ ক্যাটাগরির হয়েও কম দামে গ্যাস কেনার তাদের আবেদনে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) আপত্তি ও আদালতে আবেদন নাকচ হওয়ার পরও বিশেষ সুবিধায় অন্যদের চেয়ে অর্ধেক দামে গ্যাস পাচ্ছে তারা। এই গ্যাসে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বেআইনিভাবে ইপিজেডের বিভিন্ন কারখানায় বিক্রি করছে আড়াই গুণ বেশি দামে। বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ও বেআইনি সুবিধা নিতে আইনাইটেড গ্রুপ ব্যবহার করে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে।
(ঢাকাটাইমস/০৯নভেম্বর/এসএস/মোআ)

মন্তব্য করুন