নিজের মুখোমুখি: প্রসঙ্গ আত্মসমীক্ষণের আয়নায় স্ববিশ্লেষণ

আবদুল্লাহ আল মোহন
  প্রকাশিত : ০১ জুন ২০২৪, ০৯:৫২
অ- অ+

নিজের মুখোমুখি হতে ভয়? কিন্তু নিজেকে চিনতে, জানতে কে না চায়? আত্মসমীক্ষণের আয়নায় নিজেকে দেখার, আত্ম-উপলব্ধির মাধ্যমে নিজের মতোন করে বাঁচতে চাইলে একান্ত মনের অন্দরে কিছু অনিবার্য প্রশ্ন চলে আসে, আসে সংশয়, হতাশা, অসহায়ত্ব এবং অবশ্যই স্বপ্নগুলোও হানা দেয়। তখনই প্রয়োজন পড়ে আয়নার। দার্শনিক ভলতেয়ার যেমনটি বলেছিলেন- ‘দর্পণ এক মূল্যহীন উদ্ভাবন। নিজেকে ঠিকঠাক দেখতে হলে অন্যের চোখে আপনার প্রতিফলন দেখুন।’ আপন দর্পণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ইচ্ছাশক্তির আর আনন্দশক্তির জোরে জীবন ও জগৎটাকে অনুসন্ধানকালে সজাগ-সতর্ক থেকে আত্মজ্ঞান সমৃদ্ধতর হয়। ফলে নিজের অস্তিত্বের সাথে সমগ্র বিশ্বই হয়ে ওঠে ভাবনার বাগান। নিজের সেই বাগান চাষাবাদে নিবিড়ভাবে মন দেওয়া, শত ফুল ফোটানোর আপ্রাণ প্রচেষ্টায় নিরলস কৃষক মনে হয়।

কখনো সখনো গভীরভাবে অনুধাবন করি সুখসন্ধানী সেই মাতালের মতো যিনি নিজের বাড়ি খুঁজে পান না কিন্তু তিনি নিশ্চিত যে বাড়ি একটা রয়েছে কোথাও তার। ঘর-মন-জানালার টানে সচেতনতায় এবং অজ্ঞানতার আনন্দে মেতে ওঠার সুখানুভব স্মৃতির নোটবুকে স্থান পায়। জ্ঞানের এবং কল্পনার চোখ খুলে তাকালেই দেখা মেলে আলোর, মঙ্গলালোকের। সেই আনন্দলোকেই নিজের ভেতরের ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত সময়ের সাথে সাথে মনের মতো বাঁচতে চাই স্বরূপের সন্ধান। সেই প্রক্রিয়ায় পরচর্চা নয়, স্ব-চর্চাই আমাদের প্রধান কর্তব্য বিবেচনায় স্মরণ রাখি বলেই আপনার স্বরূপ অনুসন্ধানে গুরু সক্রেটিস যেমনটি বলেছিলেন ‘নিজেকে জানো’। দ্বিপদ প্রাণীর মধ্যে চক্ষুষ্মান যুক্তিবাদী প্রাণী কিংবা মানুষ হিসেবে চেনা-অচেনা নানা প্রসঙ্গ যেমন হানা দেয়, তেমনি প্রশ্ন-তর্ক-ভাবগুলোও তাড়িত করে। আলোর দিশার প্রত্যাশায় সেই জানার প্রচেষ্টায় যখনই মনের আয়নার নিজের মুখোমুখি দাঁড়াই, তখনই ভর করেন কবিগুরু। স্মরণ করান, গভীর প্রত্যয়ে জানান দেন অনিন্দ্য চরণে-

‘আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না।

এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা ॥’

২.

অজ্ঞতা শেখানোর জন্য কোনো শিক্ষকের প্রয়োজন নেই জানি। দার্শনিকদের মতে, জগতের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ জ্ঞান হলো নিজেকে জানা। ‘আমি’ সবার ভিতরের কর্তা। ‘আমি’ সকলের মাঝে থাকা সত্তা। ‘আমি নিত্য’। ‘আমি’ সত্য। ‘আমি’ একক। ‘আমি’ অদ্বিতীয়। কিন্তু ‘কে আমি’ তার কতটুকু জানি! এই আমার আমিকে চেনার তাগিদ দিয়েছিলেন সক্রেটিস। বলেছেন- ‘নো দ্যাইসেল্ফ’, ‘নিজেকে জানো’। এতটুকু কথা আলোড়ন তুলেছিল তাঁর কালে এবং এখনো এই জানা বেশ প্রাসঙ্গিক। সক্রেটিসের মূল কথাটা হলো- ‘টু নো দাইসেলফ ইজ দ্য বিগিনিং অব উইজডম।’ এর মানে, নিজেকে জানার মধ্য দিয়ে বিশেষ জ্ঞান পাওয়া শুরু হয়। পরবর্তীকালে আধুনিক চিন্তাবিদ রেনে দেকার্তে বলছেন- ‘আমি ভাবি তাই আমি আছি।’ এমন শুনে অন্য একদল তর্ক তুললো- না, বরং ‘আমি আছি তাই ভাবি।’ সবমূলে আসলে একটা ‘আমি’।

জানা বা সাধনার মূলে প্রথম যে প্রশ্নটি আসে সেটি হলো- আমি কে? এই ‘আমি’-কে জানার আগ্রহ সেই অনেককাল থেকেই। সাধক হাছন রাজা বলে গেছেন, ‘বিচার করি চাইয়া দেখি, সকলেই আমি।’ সাধক লালন সাঁইজি বললেন ‘আমি কী তাই জানলে সাধনসিদ্ধ হয়।’ লালন আরো বলেছেন, ‘আত্মতত্ত্ব যে জেনেছে, দিব্যজ্ঞানী সেই হয়েছে’। অর্থাৎ আমি নামের যে সত্তাকে ঘিরে আমাদের এত আয়োজন, সেই আমি কে? আমি কে তা আগে জানতে হবে। নিজেকে জানলেই অপরকে জানা হয়ে যায়। সকলকে জানা যায়। সুফি সাধকেরা বলেছিলেন, ‘যা কিছু আছে এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে, তার সবই বিরাজে মানবকাণ্ডে!’ অর্থাৎ মহাবিশ্বে যা কিছুর অস্তিত্ব আছে, তার সব কিছুরই প্রতিচ্ছবি মানব দেহে বিরাজ করে। শুধু দেখা ও উপলব্ধি করার মতো অন্তর্চক্ষু ও মন থাকা চাই। এই ‘আমি’-এর সন্ধান পাওয়া কতটা সহজ বা কঠিন? বিদ্রোহী কবি নজরুল কি নিজেকে চিনেই বলে ফেলেছেন- ‘আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ!’

৩.

জগতে যত প্রকার জ্ঞান আছে তার মধ্যে সর্বোত্তম জ্ঞান হলো নিজেকে চেনা। যে একবার সঠিকভাবে নিজেকে চিনতে পারে, তার জন্য জগতের আর কোনো জ্ঞান বাকি থাকে না। তাই সবার আগে নিজেকে চেনার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। নিজের মাপ ও মান বুঝতে হবে। ‘নিজে ঠিক তো জগৎ ঠিক’- এই প্রবাদের মতোই নিজের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে এগিয়ে যেতে হবে। সত্যিকারের জ্ঞানী হওয়ার পথে এগুনো সম্ভব তখনই, যখন আমি জানবো যে আমি কী জানি, আর কী জানি না। ‘আপনারে আপনি চিনি নে’বলেই নিজেকে চেনার চেষ্টা করাটা সবচেয়ে জরুরি বিবেচিত হয়ে থাকে। দৈনন্দিন জীবনের নানারকম ঝুটঝামেলা থেকে মানসিকভাবে মুক্তি পেতে হলেও নিজেকে শান্ত থাকা চাই। আর এটি সম্ভব হবে নিজেকে নিজে কতটা জানি। কিছু অভ্যেস মেনে চললেই নিজের কাছে নিজে তো বটে, সবার কাছে হয়ে উঠতে পারেন অন্যতম ব্যক্তিত্ব। আর তাই আপন দর্পণের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করি প্রতিনিয়ত এ রকমের অজস্র বিষয়:

-আমি কী ভালোবাসি?

-আমার স্বপ্ন কী?

-মানুষের কাছে কী রেখে যেতে চাই?

-আমার সবচেয়ে বড়ো সমালোচনা কী হতে পারে?

-জীবনে আমি কী কী ভুল করেছি?

-অন্যেরা আমাকে কীভাবে নিচ্ছে?

-আমার আদর্শ কী?

-মানুষের জন্য আমি কী করছি?

৪.

‘জীবনে প্রথম পদক্ষেপ সেটাই হওয়া উচিত যার ওপর আমাদের বাকি দিনগুলি নির্ভর করতে পারে।’ বলেছিলেন দার্শনিক ভলতেয়ার। জীবনের সূচনায় আপন প্রবণতাসমূহ না চিনতে পারলে, নিজের সীমানা না জানলে মানুষ পদে পদে ভুল করে। ‘নিজেকে জানো’ নিয়ে গল্পকার তারাপদ রায় যেমনটি লিখেছিলেন- উপনিষদে অনেক ভালো ভালো কথা লেখা আছে। তার মধ্যে একটা হলো নিজেকে জানো। মূল কথাটি বোধহয় ‘আত্মানং বিদ্ধি’। কে আমি? আমি কোথা থেকে এলাম, কোথায় যাচ্ছি। এই বিশাল বিশ্বে আমাদের কী কাজ, কী ভূমিকা; এইসব নিয়ে প্রাচীন ঋষি আমাদের মাথা ঘামাতে, চিন্তা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। নিজেকে জানতে বলেছেন। এ অবশ্য খুবই জটিল ভাবনা। এর কোনো সোজা উত্তর নেই। ভাবার কোনো শেষ নেই, ইচ্ছে করলে ভাবতে ভাবতে পাগল হয়ে যাওয়া যেতে পারে। পাগল হওয়ার ব্যাপারটা আপাতত স্থগিত থাক। আমরা এবার নিজেকে জানায় মনোনিবেশ করি। আর তখনই বাংলার উনিশ শতকীয় মরমি কবি হাসন রাজার এই গানের বাণী কানে বাজে-

‘রূপ দেখিলাম রে নয়নে, আপনার রূপ দেখিলাম রে

আমার মাঝত বাহির হইয়া দেখা দিল আমারে’

প্রশ্ন জাগে নিজের ভেতর থেকে যে নিজ বেরিয়ে আসে- সে কে? তাই তো- ‘কে আমি?’ বিশ্লেষণ করে নিজেকে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে প্রয়োজন আত্মানুসন্ধান। সেই বিবেচনায় নিজের মুখোমুখি হতে পারাটাও কিন্তু বড়ো যোগ্যতার ব্যাপার। নতুন ভাবনাকে নিজের ভাবনায় নিয়ে সেটিকে প্রশ্নের মুখোমুখি করতে পারার সক্ষমতা একটি বিশাল গুণ। এই গুণ কিংবা সক্ষমতা সব মানুষের থাকে না। কিন্তু কিছু মানুষ এই সক্ষমতা অর্জনের চেষ্টাটা করে যান। আমাদের এই নিজেকে জানা-বোঝার চেষ্টা আসলে নিজের সক্ষমতা বাড়ানোরই চেষ্টা। নিজের চিন্তার সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা। একজন মানুষের চিন্তা যদি শক্তিশালী না হয়, বৈচিত্র্যকে ধারণ করার সক্ষমতা অর্জন না করে, তাহলে সেই মানুষ তো বদ্ধ জলাভূমির মতো। সময় তো জীবনেরই অংশ। কেন, কীসের জন্য, কী কাজে সময় ব্যয় করছেন, তার যথার্থ একটা উত্তর আপনার কাছে থাকা দরকার। কোনো একটা কাজে সময় ব্যয় করার পর আপনার যদি মনে হয়, সময়টা নষ্ট হলো, কারো সঙ্গে, এমনকি টেলিফোনে কথা বলার পর যদি মনে হয়- এতক্ষণ অহেতুক সময় কাটালেন, নিদেনপক্ষে, আপনার মনে কিছুটা হলেও ফুরফুরে ভাব তৈরি না হয়, তাহলে আপনাকে অবশ্যই আপনার নিজের মুখোমুখি হতে হবে। নিজের মুখোমুখি হতে পারাটাও কিন্তু বড়ো যোগ্যতার ব্যাপার।

৫.

‘বর্তমানের গর্ভে থাকে ভবিষ্যৎ’ ধারণাকে স্বীকার করে প্রজ্ঞান ব্যক্তিত্বগণ বলেছেন- আগে নিজেকে জানুন পরে অন্যকে জানান। অনেককিছুই করতে পারি আমরা অনেকেই। কিন্তু নানা অজুহাতে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে চান। নিজেকে প্রকাশ করুন আর বুঝিয়ে দিন আপনি কত কী পারেন! বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম তো প্রতিদিনই আপনাকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে! আপনি নিজেকে শূন্য ভাবলে চলবে না। যখন অন্যরাও আপনার গুরুত্ব বুঝবে, তখনই তা কাজে আসবে। এই পৃথিবীর কেউই পরিপূর্ণ নয়, প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু দুর্বলতা আছে। নিজেকে জানুন, কোন কোন কাজে আপনি বেশি সামর্থ্যবান আর কোন কোন কাজে আপনি দুর্বল এবং সেসব দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করুন। দুর্বলতা আমাদের সবারই আছে, কিন্তু যে যতটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে পারে সেই তত বেশি সফল হতে পারে।

নতুন কোনো কাজকে এড়িয়ে যাবেন না, চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করুন। আপনার অব্যাহত চেষ্টা আপনাকে অন্য এক উচ্চতায় যেতে সাহায্য করবে। চ্যালেঞ্জ নিয়ে সফল হলে আপনার আত্মবিশ্বাস যেমন বেড়ে যাবে বহুগুণ, অন্যের কাছেও আপনার যোগ্যতা আপনি প্রমাণ করতে পারবেন। আপনি যে ক্ষেত্রে কাজ করছেন, সেই ক্ষেত্রে হয়তো আগে কেউ সফলভাবে কাজ করে গেছেন অথবা করছেন। আমরা সর্বদা যে ভুলটা করি তা হলো তার গতিবিধি, কর্মপদ্ধতি থেকে কিছু শেখার চেষ্টা না করে তাকে হিংসা করা শুরু করি। আর এখানেই আমরা পিছিয়ে পড়ি। আমরা খুব অনায়াসে তার সফলতাকে আমাদের অনুপ্রেরণায় রূপান্তরিত করতে পারি। তার পথ অনুসরণ করতে পারি। অথবা আমাদের পথের অনেক আগাম সমস্যা এবং সমাধান আমরা তাকে অনুসরণ করে আগে থেকেই সমাধান করতে পারি, আর সমাধান করতে না পারলে অন্তত প্রস্তুত তো থাকা যাবে।

৬.

‘বুদ্ধিহীন মূঢ় নিজেই নিজের শত্রুর মতো জীবন কাটায়, পাপকর্মের দ্বারা সে তিক্ত ফল দেয়।’ মহামতি বুদ্ধের বচন স্মরণ না করে পারি না। পৃথিবীর প্রাতঃস্মরণীয় মনীষীরাও যুগে যুগে বলেছেন- নির্বোধ থেকো না। চিন্তা করো। নিজের ভিতরে খুঁড়িয়া দেখো- কে তুমি? বিশ্লেষণ করো নিজেকে। মূলে যাও, উৎসে যাও। পরিস্থিতির ওজন না বুঝে যা খুশি বলো না। যা কিছু চেয়ো না। চিন্তা করো। ভাবো, আরও আরও ভাবো। ভাবতে শেখো। গভীরভাবে আত্মবিশ্লেষণ করো। পরিস্থিতিকে সন্ধিবিচ্ছেদ করো। বুঝিয়া দেখো- যা চাইছো, তা কেন চাইছো? কেবল চাইতে হবে বলে কি চাইছো? যা করছো, তা কি ঠিক করছো? এ সকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজে তারপর পদক্ষেপ ফেলো। না হলে পদচ্যুতি ঘটবে, পতন ঘটবে। গর্তে পড়ার পূর্বে বরং ভেবে কাজ করো, করে ভেবো না।

ধরুন আপনি সিঁড়ি দিয়ে একটা ভবনের ত্রিশ তলায় উঠবেন। যখন পাঁচতলায় উঠলেন, কিছুটা ক্লান্ত আপনি। যখন দশতলায় উঠলেন তখন আপনি যতটা না ক্লান্ত তার চেয়ে বেশি ভেঙে যাবে আপনার মনোবল যখন মনে হবে আরও বিশতলা বাকি। কিন্তু আপনি যদি আপনার সেই একই পথ একই কষ্ট মেনে শুধু ভাবনা অথবা দৃষ্টিভঙ্গিটাকে পাল্টে ফেলতে পারেন। একবারে ত্রিশ তলা হিসেব না করে ১০ তলা করে তিনবার ভাবুন। তখন ১০ তলাতে ওঠার পর আপনার মনে হবে তিন ভাগের এক ভাগ শেষ করে ফেলেছি আর মাত্র ২ ভাগ বাকি। পেরে যাবো। গাণিতিকভাবে ঘটনা সমান হলেও মনস্তাত্ত্বিকভাবে আপনার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাবে। ঠিক একইভাবে, প্রফেশনাল সেক্টরটাকেও ভাগ করে নিন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে। তখন কী পারিনি তার চেয়ে বেশি মনে হবে কতটুকু পেরেছি। প্রভাবিত করতে পারে এমন উক্তি পড়ুন। পথচলায় ভুল হতেই পারে। এটার জন্য ভেঙে পড়ার কিছু নেই। এরকম হাজারো উক্তি পাওয়া যাবে যা নিয়মিত পড়লে আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন, যারা সফল হয়েছে তারা সবাই আপনার আমার মতো সাধারণ মানুষ। আপনার আমার মতোই সমস্যা ও ভুলের মধ্যে থেকেই তারা এগিয়ে গিয়েছেন। তাই আপনিও পারবেন এগিয়ে যেতে। পারব না- এই কথাটাকে না বলুন। সমস্যা আসবে। প্রতিটা সমস্যা অনেক কষ্ট দিবে। সফলতাটাকে দূরে ঠেলে দিবে। কিন্তু সমস্যাটা নিজেকেই অতিক্রম করতে হবে। বসে থাকলে সমস্যার সমাধান হবে না। আপনার সমস্যা এবং আপনার স্বপ্ন দুটোই আপনার। তাই ‘না’-কে না বলতে শিখুন। দেখবেন আত্মবিশ্বাস চলে আসবে অনায়াসে। মাঝে মাঝে ভিন্ন কিছু করুন যা আপনার ভালো লাগে, যা আপনার শখ। নিজেকে মাঝে মাঝে সময় দিলে আপনি সপ্তাহের বাকি কর্মদিবসগুলোতে কর্মস্পৃহা ফিরে পাবেন। জীবন অথবা ক্যারিয়ার যেখানেই সফল হতে চান, তার জন্য আগে নিজেকে তৈরি করুন, নিজেকে ভালোবাসুন এবং নিজেকে জানুন পরে অন্যকে তা জানান। নিজেকে তৈরি করতে পারলে দেখবেন শুধু ক্যারিয়ার নয়, আপনার জীবনের সবকিছুই আপনার নিয়ন্ত্রণে চলে আসছে।

৭.

এবার আত্মমূল্যায়ন ও আত্মশুদ্ধির দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। আমরা জানি, ব্যক্তি থেকে পরিবার-সমাজ বিবর্তিত হয়ে আজকের রাষ্ট্র ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্র সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হবস, লক ও রুশোর মতবাদে বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্র সৃষ্টির আগে মানুষ প্রকৃতির রাজ্যে বাস করত। কিন্তু সেখানে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় তারা পারস্পরিক চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্র সৃষ্টি করে। এ নীতি অনুযায়ী ব্যক্তি এই শর্তে নিজেকে শাসন করার অধিকার ত্যাগ করে এক বা একাধিক ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করে যেন অন্যরাও তাদের অধিকার পরিত্যাগ করে তার বা তাদের কাছে অর্পণ করে। এভাবে চুক্তির ফলে কেউ নিজেদের অধিকার হারায়নি বরং জনগণ যে অধিকার সমর্পণ করেছে; রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে সবাই সেটা আবার ফেরত পেয়েছে। এই নীতির মূল অর্থ হলো ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে সংখ্যাগরিষ্টের স্বার্থকে বড়ো করে দেখা এবং এর মাধ্যমে নিজেদের সার্বিক কল্যাণ সাধন করা। পৃথিবীর প্রতিটা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির পিছনে এই নীতি কাজ করেছে। একটা দেশের জনগণ যদি ঐক্যবদ্ধ হয়, পরিশ্রম করে, সৎ নেতৃত্বের অনুসারী হয়, আইন মেনে চলে এবং নিজেদের দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করে তাহলে সেই দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অবধারিত। আর জনগণ যদি বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে পরশ্রীকাতরতা-দলাদলি-দ্বন্দ্ব সংঘাতে লিপ্ত হয়, তাহলে সেই দেশের উন্নয়ন দূরে থাক, জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাপন করাই অসম্ভব হয়।

৮.

মানুষ যত সভ্য হয়েছে, ততই মানুষ ‘নিজেকে জানো’ বাণীর মর্ম গভীরভাবে উপলব্ধি করছে। এটি ব্যক্তির জীবনের জন্য যেমন, তেমনি রাষ্ট্রীয় জীবনের জন্যও একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বাণী। কেউ যদি নিজেকে জানতে পারে, সে বুঝতে পারবে কী চায়, তার কী চাওয়া উচিত এবং কী করা উচিত। ঠিক একইরকমভাবে একটি জাতিরও বুঝতে হবে- তারা কী চায়। এর সাথে জাতিকে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিদের জানতে হবে আরো শক্ত করে যে, তারা কী চায়। যদি কোনো জাতি বুঝতে পারে, যদি তাদের নেতৃবৃন্দ বুঝতে পারেন- কী তারা চান, তা হলে সেই জাতির সিদ্ধান্তসমূহ হবে মজবুত-টেকসই। একটি জাতিকে অবশ্যই যেকোনো বিষয়ে দৃঢ়তার সাথে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তা না হলে জাতির ভবিষ্যৎ দুর্বল হয়ে পড়ে। আর এই দৃঢ় সিদ্ধান্তের জন্য পূর্বে প্রয়োজন নিজেকে জানা। একসময়ের বিখ্যাত চীনের সেনাপতি, সমরবিদ ও দার্শনিক সান জু তাহার ‘আর্ট অব ওয়ার’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘তুমি অন্যকে জানার পাশাপাশি নিজেকেও জানো। যদি জানিতে পারো তাহলে মাঠের যুদ্ধই হোক আর জীবনের যুদ্ধই হোক- কোনো ক্ষেত্রে পরাজিত হবে না।’

৯.

ব্যক্তিজীবনে এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে আমরা অনেক কিছু ঝোঁকের মাথায় করে ফেলি, যা অদূরদর্শিতারই শামিল। আমাদের এই সকল সিদ্ধান্তের পিছনে কখনো কখনো অজ্ঞানতাও কাজ করে থাকে। ঝোঁকের মাথায় আবেগের বশবর্তী হয়ে গ্রহণ করা কোনো কোনো সিদ্ধান্ত হতে হঠাৎ করে ভালো ফল পাওয়া যায়। তখন আমরা ভেবে থাকি, ‘সঠিক সিদ্ধান্তই হয়েছে’। কেউ কেউ একে নাম দেন, ‘সুচিন্তিত’ সিদ্ধান্ত। আসলে ভালো করে খোঁজ নিলে দেখা যাবে, সিদ্ধান্তটি ‘রাগ, ক্ষোভ অথবা প্রীতির বশবর্তী’ হয়ে নেওয়া হয়েছিল; কিন্তু ভালো ফল মিলেছে। কিন্তু আমাদের সকলের বুঝা উচিত, এইরূপ ঝোঁকে নেওয়া, আবেগের বশবর্তী হয়ে নেওয়া সিদ্ধান্ত কখনো শক্তিশালী হয় না। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থেও প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে নিজেকে জানবার উপর ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া আছে। দেশ যারা পরিচালনা করেন তাদের জন্য এটা আরো গুরুত্বপূর্ণ। একটি জাতিকে পথ দেখাতে হলে নেতৃত্বদানকারীদের বাস্তবতার নিরিখে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয় এবং সিদ্ধান্তে অটল থাকতে হয়।

১০.

সক্রেটিসের বক্তৃতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হচ্ছে,‘জ্ঞানেই পুণ্য’। এই নীতি অনুযায়ী ভালোকে জানা মানেই ভালো কাজ করা। মানুষ খারাপ কাজ করে শুধুমাত্র তার অজ্ঞতার জন্য। যদি জ্ঞানেই পুণ্য লাভ হয়, ভালোকেই জানার অর্থ যদি হয় ভালো কাজ করা, তা হলে একজন লোক তখনই কুকর্মে থাকবে যখন সে ভালোকে জানতে ব্যর্থ হবে। এখানেই সক্রেটিস সেই বিখ্যাত উক্তিটি করেন, ‘কেউ স্বেচ্ছায় কুকর্ম করে না।’ ভালোকে জানার পর কেউ স্বেচ্ছায় মন্দ বেছে নেয় না। কিন্তু আমরা প্রায়শই বলি- ‘জেনেশুনে অন্যায় কাজটি করলাম।’ অথবা চাইলেই ভালো কাজটি করতে পারতাম। সক্রেটিসের বিবেচনায় এটা একেবারেই অসম্ভব; যদি সত্যিই কেউ ‘ভালো’কে জানে তা হলে সে ভালো কাজটিই করবে। মানুষের জন্য কী ভালো এবং কীসে মানুষের সুখ, তার জীবনযাপন পদ্ধতি কী হওয়া উচিত এবং কীভাবে সে সেটা আয়ত্ত করবে তা জানার জন্য প্রথমে মানবচরিত্র বুঝতে হবে। মানুষ যদি তা বোঝার চেষ্টা না করে, যদি কোনোদিন না জানে কোনটি তার জন্য ভালো তাহলে সুখী হওয়ার সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হবে। এ ধরনের জীবনকে সক্রেটিস অপরীক্ষিত জীবন বলে উল্লেখ করেছেন। তার অন্যতম বিখ্যাত উক্তি, ‘অপরীক্ষিত জীবন ভালো জীবন নয়।’ এক ধরনের জানা এরকম যে, প্রত্যেকে তার মাঝে যেসব গুণ আছে, তার যে কাজ করার ক্ষমতা আছে তা বুঝে নিতে পারা। এই জানা এমন- আপনার ঘনিষ্ঠ কেউ, মা বাবাও নিশ্চিত কিছু বলতে পারবেন না আপনার নিজের এই জানা সম্পর্কে, যতটুকু আত্মবিশ্বাস নিয়ে আপনি আপনার নিজের কাজের ক্ষমতা বোঝেন, অন্য কেউ অত নিশ্চিত হতে পারে না।

১১.

‘যে লোকটা হেরে যাচ্ছে / সে তো আর তার জ্ঞানকে এড়িয়ে যেতে পারে না।

ডুবে যাও / ভয় যদি পাও তো পাও। তবু ডুবে যাও।

একেবারে তলদেশে গিয়ে দেখবে / তোমার জ্ঞান

তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।’ -বার্টোল্ট ব্রেখট

আর তাই যথার্থই বলা হয়ে থাকে- লক্ষ্যগুলো তখনই অসম্ভব হয়ে উঠবে, যখন আমরা অসম্ভব মনে করবো। আর সেই বিবেচনাতেই নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমাদের সংকটগুলিকে চেনা-জানার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করা, সমস্যাসমূহ মোকাবিলায় সাহায্য করতে চিন্তাচর্চার মুক্ত আলোচনার প্রচেষ্টাটা জরুরি।

আবদুল্লাহ আল মোহন: লেখক, গবেষক ও সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ভাসানটেক সরকারি কলেজ, ঢাকা

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
আ.লীগ নিষিদ্ধসহ তিন দফা দাবি: শাহবাগে দ্বিতীয় দিনের মতো চলছে বিক্ষোভ
পাকিস্তানের গোলাবর্ষণে ভারতীয় কর্মকর্তার মৃত্যু
বরেণ্য সংগীতশিল্পী মুস্তাফা জামান আব্বাসী আর নেই
ভারতের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের দাবি পাকিস্তানের
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা