কিশোরগঞ্জের বিলে ভাসমান সবজি চাষে দিন বদলেছে কৃষকদের

আমিনুল হক সাদী, কিশোরগঞ্জ
 | প্রকাশিত : ০২ অক্টোবর ২০২৪, ১৪:৪৬

কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মডেল মহিনন্দ ইউনিয়নের কাশোরারচর বিলের পাশ দিয়ে এক যুগ আগেও পানির উপরে শুধুই কচুরিপানা দেখা যেত। এখন সেই কচুরিপানার মধ্যে বিষমুক্ত বিভিন্ন শাকসবজির পরিপাটি বাগান দেখে যে কারও চোখ জুড়িয়ে যাবে। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, পানিতে কোনো সবুজ গালিচা বিছানো।

কৃষি বিভাগের মাধ্যমে স্থানীয় চাষিদের প্রশিক্ষিত করে এই বিলের কচুরিপানার ওপর চাষ করা হয় সবজি। ভাসমান সবজি চাষে দিন বদলে গেছে কৃষকদের।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বিলের এক একর পরিমাণ জায়গায় পানির ওপর কৃষকরা তৈরি করেছেন ২০০টি বেড। প্রত্যেকে কাজ বণ্টন করে নিয়ে সবজি বেডের পরিচর্যা করেন। কেউ নৌকা নিয়ে, কেউ পানিতে নেমে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেন। আর এভাবে বিষমুক্ত সবজি চাষে লাভবান হচ্ছেন স্থানীয় কৃষকরা।

সবজি চাষে প্রায় ২৫টি পরিবার স্বাবলম্বী হয়েছে জানিয়ে কৃষকরা বলেন, তাদের দেখাদেখি জেলার অন্যান্য উপজেলার কৃষকদের মধ্যে ভাসমান সবজি চাষে আগ্রহ বাড়ছে। কিশোরগঞ্জ জেলার আশপাশসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার চাষি ও কৃষি গবেষকরা এই বিলের ভাসমান সবজি চাষ দেখে আপ্লুত। বিশেষ করে কৃষি মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও বিভিন্ন সময়ে পরিদর্শন করে সন্তোষ প্রকাশ করে চাষিদের পুরস্কৃত করেছেন।

জানা গেছে, ‘ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা ফসল চাষ, গবেষণা, সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এ প্রকল্পের আওতায় কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা কৃষি অফিস এ বছর মহিনন্দ ও কলাপাড়া ব্লকে ৭৩টি প্রদর্শনী বাস্তবায়িত করেছে। এরই অংশ কাশোরারচর বিলের ভাসমান সবজি বাগান।

কৃষকরা বলেন, কচুরিপানা জমা করে পচিয়ে লম্বা লম্বা ভাসমান বেড তৈরি করা হয়। পরে সেখানে চাষ করা হয়েছে শাকসবজিছ। এ পদ্ধতিতে চাষ করতে বাড়তি কোনো রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রয়োজন হয় না। ক্ষতিকর পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণে কিছু কিছু জায়গায় বসানো হয়েছে ‘সেক্স ফেরোমন ফাঁদ’। ভাসমান বেডের শাকসবজি জনস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ, তবে দাম কিছুটা বেশি বলে জানান তারা।

ভাসমান বেডে সবজি ও মসলা চাষ একটি প্রাচীন পদ্ধতি। বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে গবেষণার মাধ্যমে ৭৩টি বেড নির্ধারণ করেছে। ভাসমান সবজি চাষের ফলে রোগ ও পোকামাকড়ের আক্রমণ কম হয়, কীটনাশক লাগে না ও জৈবপ্রযুক্তির মাধ্যমে সহজে রোগ ও পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এই বেডে পাশাপাশি উচ্চ ফলনশীল শসা, বরবটি, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, ধুন্দল, করলা, ঢেঁড়স, লালশাক, পাটশাক, পালংশাক, পুঁইশাক আবাদ করা হয়েছে। সার কিংবা কীটনাশক ছাড়াই বর্ষা মৌসুমে বছরের প্রায় ৬ মাস এ পদ্ধতিতে আবাদ করা যায়।

আর পানি শুকিয়ে গেলে কচুরিপানার বেড জৈবসার হিসেবে অন্যান্য ফসলের জমিতে ব্যবহার করা যায়। এতে ফলন বেশি হয় এবং বাজারে দামও পাওয়া যায় বেশি। এ জন্য দিন দিন কৃষকরা ভাসমান পদ্ধতিতে সবজি আবাদে উৎসাহিত হচ্ছেন।

কৃষি বিভাগ জানায়, ভাসমান বেডে সবজি চাষ প্রকল্প বরাদ্দ দেওয়া হয় ৫০টি। মহিনন্দ ব্লকে বাস্তবায়ন করেছে ১২টি, কলাপাড়া ব্লকে ২৮টি। চলমান রয়েছে ১০টি মসলা প্রদর্শনী। ফ্লিপ প্রকল্পের বরাদ্দ ছিল ২০টি, এর মধ্যে ২০টিই কলাপাড়া ব্লকে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ময়মনসিংহ নিবিড়তা বৃদ্ধিকরণ প্রকল্পের বরাদ্দ তিনটি বাস্তবায়ন করা হয় কলাপাড়া ব্লকে। সব মিলিয়ে ৭৩টি প্রদর্শনী এ বিলে বাস্তবায়িত হয়েছে।

২০১২-১৩ অর্থবছরে এই বিলে সদর উপজেলা কৃষি বিভাগের মাধ্যমে প্রকল্পটি শুরু হয়। প্রথমে চংশোলাকিয়ার হারিছ উল্লাহ, ফয়েজ উদ্দিন, নুরুল ইসলাম, মজলু, মফিজ ভাসমান বেডে সবজি আবাদ করেন। বর্তমানে ২৫টি পরিবার বিলের ১ একর জমিতে বিভিন্ন জাতের সবজি আবাদ করেছেন। কৃষি বিভাগ বলছে, ভাসমান বেডে ৭ থেকে ১০ মেট্্িরক টন সবজি উৎপাদিত হয়েছে।

চংশোলাকিয়া এলাকার বাসিন্দা ফয়েজ উদ্দিন, নুরুল ইসলামসহ আরও কয়েকজন কৃষক কাশোরারচর বিলের পতিত ভূমিতে এক যুগ ধরে ভাসমান বেডে সবজি চাষ করে আসছেন। তারা জানান, ভাসমান বেডের সবজি বিক্রির টাকায় তাদের পরিবার-পরিজনের ব্যয় নির্বাহ করতে পারছেন। তাদের সাথে এখন মফিজ উদ্দিন পাঠান, রাজীব মিয়া, রুহুল আমিন, রোকন মিয়াসহ অনেক কৃষক সবজি আবাদ করেন।

তারা জানান, তাদের নিজস্ব জমি নেই। কৃষি অফিসের সহায়তায় হাজামজা বিলে ভাসমান বেডে শাকসবজির চাষ করেন। কৃষি অফিস বীজ, সেক্স ফেরোমন ফাঁদ, প্লাস্টিকের নৌকাসহ উপকরণ দিয়ে সহায়তা করেছে। ফলে ফলন ভালো হওয়ায় তারা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।

মহিনন্দ ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা উম্মে কুলসুম জেবুন্নেছা বলেন, তিনি প্রথমে চংশোলাকিয়া এলাকার দুজন কৃষক ফয়েজ উদ্দিন ও নুরুল ইসলামের মাধ্যমে কয়েকটি পরীক্ষামূলক বেড তৈরি করান। এতে ফলন ভালো হওয়ায় বর্তমানে চাষি ও বেডের সংখ্যা বেড়েছে।

মহিনন্দ ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. নাছিরুজ্জামান সুমন বলেন, ‘আমার ব্লকে কাশোরারচর বিলে ১২টি বেডে সবজি আবাদ করা হয়েছে।

বিলে ভাসমান সবজি চাষ প্রথম শুরু হয় কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার সাবেক কৃষি অফিসার বর্তমানে ঝিনাইদহ কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের ডিপ্লোমা এডুকেশনের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো. মনিরুল ইসলামের সময়। তিনি বলেন, ‘আমি যখন সদরের কৃষি অফিসার ছিলাম, তখনই এ প্রকল্পটি চালু হয়েছিল। শুরুর সময় চাষি ফয়েজ উদ্দিনকে আমার সময়েই কৃষি বিভাগ পুরস্কারে ভূষিত করে। মিডিয়ার মাধ্যমে এ বিলের ভাসমান সবজি চাষের সফলতা দেখে ভালো লাগে।’

কাশোরারচর বিলে বহু বছর ধরে অনেক জমি পতিত ছিল। সেসব ভূমিতে কৃষি বিভাগের সহায়তায় কৃষকদের প্রশিক্ষিত করে ভাসমান বেডে সবজি আবাদ করা হয়। বলছিলেন কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা কৃষি অফিসার ফাহিমা আক্তার ফাহিম।

সদর উপজেলা কৃষি অফিসার বলেন, ভাসমান সবজি প্রদর্শনী সাত মাসের প্রকল্প। বর্তমানে তিন মাস চলছে। এরই মধ্যে আশাতীত ফল পাওয়া যাচ্ছে। জমির শাকসবজি অতিবর্ষণ, বর্ষা ও খরায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু ভাসমান বেডের শাকসবজির কোনো ক্ষতি হয় না। ফলে জমির শাকসবজির যখন আকাল দেখা দেয়, তখন ভাসমান বেড থেকে বাজারে শাকসবজির জোগান পাওয়া যায়। এই পদ্ধতিতে শাকসবজি আবাদ করে কৃষকরা স্বাবলম্বী হচ্ছেন।

(ঢাকাটাইমস/২অক্টোবর/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :