অনিয়ম-দুর্নীতিতে পাক্কা একশ আতিক রূপ ধরতেন ধোয়া তুলসীর

সুন্দর কথায় ভোলাতেন। সুযোগ পেলেই গাইতেন গান। অতিকথনে নানা সময়ে সমালোচিতও হয়েছেন। মেয়র আনিসুল হকের অকাল মৃত্যুতে তার নগর পিতা হওয়ার স্বপ্নও পূরণ হয়। তবে ঢাকা উত্তর সিটির বাসিন্দাদের কতটা স্বপ্ন পূরণ করেছেন তিনি?
বলা হচ্ছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের কথা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর একে একে প্রকাশ্যে এসেছে তার নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি। ৫ আগস্টের পর লুকিয়ে থাকা সাবেক এই মেয়র অবশেষে পড়েছেন ধরা।
বুধবার রাজধানীর মহাখালী ডিওএইচএস এলাকা থেকে সাবেক মেয়র আতিককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বিষয়টি নিশ্চিত করে ডিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানায় করা তিনটি মামলার আসামি আতিকুল ইসলাম। এর ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাকে। বৃহস্পতিবার তাকে আদালতে তোলা হবে।
মোহাম্মদপুর থানা সূত্রে জানা গেছে, বুধবার সন্ধ্যা ছয়টার দিকে আতিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর তাকে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনারের কার্যালয়ে নেওয়া হয়।
মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুতে ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ডিএনসিসির উপনির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হন সাবেক বিজিএমইএ সভাপতি আতিকুল ইসলাম। এরপর ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ভোটে আবার মেয়র নির্বাচিত হন কুমিল্লার তিতাস উপজেলার এই সন্তান।
দুর্নীতিতে আতিকের তেলেসমাতি
দুর্নীতির সিন্ডিকেট গড়ে কয়েক শ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ আছে সাবেক মেয়র আতিকের বিরুদ্ধে। ডিএনসিসির ছোট-বড় সব খাতেই হাত পড়েছে লুটপাটের। বাদ যায়নি বস্তি উন্নয়নের টাকাও। ঠিকাদারদের কাছ থেকে কমিশন, নিয়োগ, বদলি ও ময়লা বাণিজ্যসহ ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে অনিয়ম-দুর্নীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেন রাজধানীর উত্তর সিটির সেবাদানকারী এ প্রতিষ্ঠানকে।
মেয়ে বুশরা আরেফিনকে হিট অফিসার নিয়োগ, ভাতিজাকে সিটি করপোরেশনের উপদেষ্টা ও ভাগনেকে দিয়ে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণের সিন্ডিকেট বানিয়ে ডিএনসিসিতে আতিক গড়ে তুলেছিলেন লুটপাটের রাজত্ব। ভাগনে তৌফিক পরিচিত ছিলেন সেকেন্ড মেয়র হিসেবে। করপোরেশনের কাউন্সিলর বা কর্মকর্তা না হয়েও আন্তবিভাগীয় সভায় উপস্থিত থেকে কর্মকর্তাদের শাসাতেন তিনি। সরকারি খরচে বিদেশ ভ্রমণ, কর্মশালায় অংশগ্রহণ ও প্রশিক্ষণ নিতেন ভাগনে। এ ছাড়া টেন্ডার ফাইল নিয়ন্ত্রণ, পছন্দের ঠিকাদারকে বিনা টেন্ডারে কাজ দেওয়াসহ তার বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ। এভাবেই টানা চার বছর ডিএনসিসিতে চলেছে আতিকের অনিয়ম ও দুর্নীতি।
সিটি করপোরেশনের ইতিহাসে নজিরবিহীনভাবে জনগণের ট্যাক্স এবং সরকারের দান-অনুদানের কয়েক শ কোটি টাকা লোপাটের রেকর্ড সৃষ্টি করেন আতিক ও তার সহযোগীরা।
২০২১ সালে ‘ঠিকানা রিসোর্ট’-এ একটি মতবিনিময় সভায় খরচ হয় ১০ লাখ টাকা। কিন্তু আতিক সিন্ডিকেট ২৯ লাখ টাকা বিল দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করে। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের দিন ডিএনসিসির বিভিন্ন সড়কে আলোকসজ্জার মাধ্যমে প্রায় ৭০ লাখ টাকার বেশি খরচ দেখিয়ে আত্মসাৎ করেন আতিক ও তার সিন্ডিকেট।
মেট্রোরেল প্রকল্পের উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত যাত্রী পরিবহন উদ্বোধন উপলক্ষে সমাবেশের আয়োজনের নামে প্রায় ৫০ লাখ টাকার খরচ দেখিয়ে আত্মসাৎ করা হয়। একইভাবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধানী অনুষ্ঠানের নামেও প্রায় অর্ধকোটি টাকার বিল বানিয়ে আত্মসাৎ করা হয়।
ডিএনসিসির নিজস্ব নগর ভবন এবং এতে সুন্দর সুন্দর কয়েকটি হলরুম থাকা সত্ত্বেও ডিএনসিসি কাউন্সিলর ও কর্মকর্তাদের নিয়ে ‘করপোরেশনের বোর্ড’ সভার নামে মুন্সীগঞ্জে মাওয়া রিসোর্টে সভা করে প্রায় ৬০ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে।
এছাড়া হিট অফিসারের পরামর্শে নগরীর বিভিন্ন আইল্যান্ডে কিছু গাছ লাগান আর নগরবাসীকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য প্রধান প্রধান সড়কে গাড়ি থেকে ওপরের দিকে পানি ছিটানোকে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর গল্প বানানো হয়। গরমে সড়কে গাড়ি থেকে পানি ছিটানোর নামে প্রায় ২ কোটি টাকা খরচ দেখিয়ে ভুয়া বিল-ভাউচারে কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়।
একইভাবে গুলশানে নগর ভবনের সামনে অসহায় ও ছিন্নমূল লোকজনের ইফতার এবং প্যান্ডেলের খরচ বাবদ প্রায় সোয়া কোটি টাকা খরচ দেখিয়েছেন আতিকুল ইসলাম। এর মধ্যে খাবারের বিল দেখানো হয় ৪৮ লাখ টাকা।
নথি সরাতে এসে পালান পেছনের দরজা দিয়ে
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত ১৯ আগস্ট ঢাকাসহ সব সিটি করপোরেশনের মেয়রদের সরিয়ে প্রশাসক নিয়োগ দেয়।
তার আগের দিন (১৮ আগস্ট) রাতে মেয়র আতিক গোপন নথিপত্র সরিয়ে নিতে চুপিসারে ঢুকেছিলেন নগর ভবনে। কিন্তু দ্রুত ঘটনাটি জানাজানি হলে বিক্ষুব্ধ কর্মচারীরা জড়ো হন নগর ভবনে। বাইরে বিক্ষোভ দেখান জনতা। উপায়ন্তর না দেখে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যান সাবেক মেয়র।
(ঢাকাটাইমস/১৬অক্টোবর/এসএস/এমআর/মোআ)

মন্তব্য করুন