বন্ধুর প্রয়াণে

আমার জীবনের দীর্ঘতম বন্ধুত্বের স্মৃতি যাকে নিয়ে সেই বন্ধু, যার সম্পূর্ণ নাম মোঃ আশরাফুল আলম, অনেক বেশি পরিচিতি ডাকনাম বাচ্চু দিয়ে। এভাবে আমাকে শেষ চমক দিয়ে চলে যাবে আমি কখনো ভাবতে পারিনি। সারা জীবন সে আমাকে অনেক চমক দিয়েছে কিন্তু আমাদের দুজনের এই পরিণত বয়সেও সে আমার আগে জীবন থেকে বিদায় নিবে আমার কল্পনার অগোচরে ছিল। তার স্বভাবই ছিল চমকে দেওয়া, সেই তার ছাত্র জীবন থেকে। আমরা দুজনে ছিলাম ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে।
আমরা দুজনেই শিক্ষক বাবার বড় সন্তান। ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে সপ্তম শ্রেণীতে উঠতে বাচ্চু তৃতীয় হন। শিক্ষক বাবার সাফ কথা প্রথম হতে পারলেনা! তোমাকে এই স্কুলে পড়াবোই না, হোক সেটা জামালপুর সদরের সেরা স্কুলের মধ্যে অন্যতম ! ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে এডমিশন নেন। সেখানে প্রতিটি ক্লাসে দারুন রেজাল্ট করে সে, আমাদের সাথে সবসময় যোগাযোগ রাখে। এসএসসি তে আমরা একই ধরনের রেজাল্ট করে আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হই। আকুয়া, শানকি পাড়া, গোহাইলকান্দি অনেকগুলো মেস হয়ে কলেজের মুসলিম হোস্টেলে আমরা একই রুমে উঠি।
ইন্টারমিডিয়েট রেজাল্ট এর পর থেকে আমরা যার যার নিজের পথ ধরেছি। আমরা কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, কেউ বুয়েট বিআইটি আবার কেউ মাদ্রাজসহ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছি।
তিন দশকের বন্ধুত্ব আমাদের, একসাথে অনেক স্মৃতি। ঘটনাবহুল আর সমৃদ্ধ আমাদের ক্যারিয়ার। কিন্তু একটা ট্রেন দুর্ঘটনা! আজ যেন আমাদের দুজনের মাঝে এক আলোকবর্ষের সমান দূরত্ব। আজ মৃত্যু সীমার উপরে থাকা বাচ্চুকে ভেবে আরো কত শত স্মৃতি স্মরণে আসছে তা সঠিকভাবে বলতে পারবো না।
আমি কখনো শিক্ষকতার বিকল্প কিছু ভাবিনি ক্যারিয়ার হিসেবে। বাচ্চু শিক্ষকতা না করলেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেস্টিজিয়াস ডিপার্টমেন্টে কন্ট্রোলার হিসাবে তার চাকরি হয়। এর আগে কয়েকটি ব্যাংক এবং পাট গবেষণা কাউন্সিলে চাকরি করেন।
তার মৃত্যুতে সব ব্যক্তি সব মহল যে কথাটা বলেছে, সে সবার ছিল এক পরম আস্থা ভরসা কেন্দ্র। মানুষের সঙ্গে প্রাণ খুলে মিশতে পারতো। সব সময় নিজের সুবিধার চাইতে অন্যের সুবিধার দিকেই দৃষ্টি ছিল তার বেশি। কথাটা একটুও মিথ্যা নয়। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দৃষ্টি রেখেছে সব ঘটনার উপর। নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে রাখেন নি। আপনজন পরিবার বন্ধুবান্ধব সবার মাঝে নিজেকে তিনি বিলিয়ে দিয়েছেন। নিজেকে সরিয়ে দিয়েছেন অন্যের মধ্যে। সব জায়গায় যায়নি, সবার সঙ্গে মেশেনি, তবে নিজেকে সবার থেকে দূরবর্তীও করেনি।
বাচ্চু সবার মধ্যে একজন,
সবার জন্য একজন!
এই পরিচয়টাই রেখে গেল।
বন্ধু যেখানে থাকো ভালো থেকো। শান্তিতে থেকো।
আমরা তোমাকে সহজে ভুলবো না।
লেখক: পুলিশ কর্মকর্তা

মন্তব্য করুন