অবৈধভাবে পাথর তুলে ক্ষত-বিক্ষত জাফলং, দিনে লাখ লাখ টাকা চাঁদাবাজি

সুয়েব আহমদ, সিলেট
  প্রকাশিত : ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৬:১০
অ- অ+

দেশের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি। মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশ ঘেরা এ জনপদ ও প্রকৃতিকন্যা জাফলংয়ের মোহনীয় দৃশ্য দেখতে দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসে ভ্রমণপিপাসু হাজারও মানুষ। কিন্তু একদল পাথর ব্যবসায়ীর কারণে ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে জাফলং, হারাচ্ছে তার চিরায়ত সৌন্দর্য।

পরিবেশ ও পর্যটনকেন্দ্র রক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা কোয়ারিতে জমে আছে বিপুল সাদা পাথর। বন্ধের সুযোগ কাজে লাগিয়ে উপজেলা প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল অবৈধভাবে পাথর তুলছে। পাথর বহনকারী গাড়ি থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা আদায় করছে একটি চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট। কিন্তু এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে উপজেলা প্রশাসন ও থানার পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

ওই পাথর কোয়ারির পাহারায় নিয়মিত দায়িত্ব পালন করছেন থানার পুলিশ ও আনসার সদস্যরা। কিন্তু তারা পাথর উত্তোলনকারীদের কোনো বাধা দেননি।

সিন্ডিকেটের চাঁদাবাজির একটি অংশ স্থানীয় কিছু সাংবাদিকও পান বলে প্রচার আছে। তবে ঢাকাটাইমস এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ তৃতীয় কোনো সূত্র থেকে নিশ্চিত হয়নি।

সিলেটের একটি দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর মাস খানেক আগে একটি অভিযান পরিচালনা করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। পাথর লুট ও চাঁদাবাজি নিয়ে দৈনিক আলোকিত সিলেট এবং আরও কয়েকটি অনলাইন মিডিয়ায় ধারাবাহিক সংবাদ প্রকাশিত হয়। কিন্তু টনক নড়েনি প্রশাসনের।

জানা গেছে, বেপরোয়া এই সিন্ডিকেটের প্রধান হলেন বহিষ্কৃত বিএনপি নেতা শাহ আলম স্বপন। তিনি গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরই জাফলং কোয়ারি এলাকায় একটি চক্র তৈরি করেন। তার বলয়ে ছিলেন জেলা বিএনপির সহ-সম্পাদক রফিকুল ইসলাম শাহপরান। পাথর লুটপাটের অভিযোগে শাহপরানের দলীয় পদ স্থগিত করে বিএনপি। এরপর তিনি এই সিন্ডিকেট থেকে সরে দাঁড়ান।

বর্তমানে জাফলং এলাকায় স্বপনের একক রাজত্ব তৈরি হয়েছে। তার রয়েছে বিশাল লাঠিয়াল বাহিনী। এই বাহিনীর সদস্যরা সব সময় এলাকায় প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দেয়।

সবশেষ জাফলংয়ের নয়াবস্তি এলাকার গ্রামপুলিশ ও শারীরিক প্রতিবন্ধী মো. ইউসুফ আলীর জমি দখল নিয়ে ঘটেছে লঙ্কাকাণ্ড। রাতভর অস্ত্রের মহড়া দেখেছে জাফলংবাসী। এ ঘটনায় জাফলংয়ে পাথর খেকো লুটপাটকারী শাহ আলম স্বপন ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে থানায় লিখিত অভিযোগ করেন পূর্ব জাফলং ইউনিয়নের মৃত ইব্রাহিম আলীর ছেলে মো. ইউসুফ আলী। অভিযোগ দায়েরের ১২ দিনের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত অভিযোগটি এফআইআর হিসেবে রেকর্ড করেনি গোয়াইনঘাট থানা।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়- মামলার আসামিরা ইউসুফ আলীর মালিকানাধীন বালুরচর দখল করতে যান। বাদী এতে বাধা দিলে আসামিরা বাদিসহ তার আত্মীয়-স্বজনের ওপর হামলা করেন। এ ঘটনার পরদিন মঙ্গলবার দিবাগত গভীর রাত ২টার দিকে স্বপন বাহিনী আবার অস্ত্রের মহড়া দিয়ে বাদিপক্ষের ওপর সশস্ত্র হামলা করে। এতে জাফলংজুড়ে নগদ ৩ লক্ষ ৭২ হাজার টাকা ও ৪ ভরি স্বর্ণালঙ্কার লুটপাট করা হয়।

স্বপন বাহিনী প্রতিদিনই জাফলং এলাকায় এ রকম নৈরাজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। এই ভয়ে কেউ মুখ খুলে প্রতিবাদ করে না।

ইউসুফ আলীর মামলা রেকর্ড না হওয়া নেপথ্যে প্রধান আসামি শাহ আলম স্বপন। তিনি ছিলেন গোয়াইনঘাট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। সেই সুবাদে পুলিশ তার বিরুদ্ধে মামলা রেকর্ড করছে না বলে দাবি মামলার বাদির। এই মামলায় অন্য আসামিরা হলেন উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মিজানুর রহমান হেলয়ার, যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ইউসুফ আহমদ, পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন ছাত্রদলের বহিস্কৃত সভাপতি আজির উদ্দিন সহ একদল সন্ত্রাসী।

জাফলংয়ের এক পাথর ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন,‘বর্তমান সময়ের বিএনপির এই চাদাঁবাজ সিন্ডিকেটের চেয়ে ভালো ছিলো আওয়ামী লীগের চাঁদাবাজরা। আগে আওয়ামী লীগের চাঁদাবাজদের ১৩শ টাকা করে দিয়ে গাড়ি পাস করছি। এখন বিএনপির স্বপন সিন্ডিকেটকে ২৫শ টাকা করে দিতে হয়। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভাবছিলাম পাথর কোয়ারীতে চাঁদাবাজি বন্ধ হবে। কিন্ত না এখন চাঁদাবাজির মাত্রা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

জাফলং বল্লাঘাট বল্লাপুঞ্জি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উত্তর সীমানার পাশে পরিবেশ অধিদপ্তরের জ্ঞাতসারে গর্ত করে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় প্রভাবশালী বহিষ্কৃত বিএনপি নেতা শাহ আলম স্বপন চক্রের বিরুদ্ধে। এতে জাফলং হারাচ্ছে অপরূপ সুন্দর্য। এই চক্রের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। জোরপূর্বক মানুষের জমি থেকে যন্ত্রদানব ব্যবহার করে উত্তোলন করছেন পাথর। পরিবেশের শাপাপাশি হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের ঘরবাড়ি ও সরকারি স্থাপনা।

এই চক্রটি জোর করে পাথর উত্তোলনের পাশাপাশি নিরীহ মানুষের জায়গা দখলে নিচ্ছেন। সেই জায়গা থেকে পাথর উত্তোলন করে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছেন এবং পাথরবোঝাই গাড়ি থেকে ২৫০০-৩০০০ টাকা করে আদায় করছেন- এমনই অভিযোগ স্থানীয়দের।

সরেজমিনে জানা গেছে, বল্লাপুঞ্জি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর ঘেঁষা মরিয়ম রেস্টুরেন্টের পূর্ব পাশে স্বপনের নেতৃত্বে ফেলুডার দিয়ে মাটি কেটে বড় বড় গর্ত করে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করছে স্থানীয় এলাকার আব্দুর রহিম মাস্টারের দুই ছেলে মানিক মিয়া ও ইসরাত মিয়া। পাথর উত্তোলনের ফলে ঝুঁকিতে রয়েছে বল্লাঘাট পর্যটনকেন্দ্রের দোকানপাট, বল্লাপুঞ্জি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ আশপাশের এলাকা।

অবৈধ পাথর উত্তোলনের বিষয়ে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে মানিক মিয়া বলেন, ‘আমাদের রেকর্ডীয় জমি থেকে পাথর উত্তোলন করছি। পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালকের সঙ্গে আমাদের সমঝোতা হয়েছে। উনি আশ্বাস দিয়েছেন তাই পাথর তুলছি।’

এ বিষয়ে জানতে শাহ আলম স্বপন ও রফিকুল ইসলাম শাহপরানের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তারা পাথর তোলায় তাদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেন।

এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের সহকারী পরিচালক বদরুল হুদা জানান, ‘তিনি অবৈধ পাথর উত্তোলনের জন্য কাউকে আশ্বাস দেননি এবং এ বিষয়ে কারও সঙ্গে সমবোঝতাও হয়নি। অবৈধ পাথর উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে পরিবেশ ধ্বংসের অভিযোগে মামলা প্রস্তুতি চলমান রয়েছে।

গোয়াইনঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সরকার তোফায়েল আহমদ জানান, অবৈধ পাথর উত্তোলন বন্ধে পুলিশি অভিযান চলছে।

সিলেটের জেলা প্রশাসক শের মোহাম্মদ মাহবুব মুরাদ জানান, গত ৫ আগস্টের পর প্রকৃতি-কন্যা জাফলংয়ের পাথর কোয়ারীতে ব্যাপক লুটপাট হয়েছে শোনেছেন। ইতোমধ্যে পাথর লুটপাটে জড়িতদের বিরুদ্ধে স্ব স্ব থানায় মামলা হয়েছে। দ্রুত তাদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানান তিনি।

(ঢাকাটাইমস/১০জানুয়ারি/মোআ)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
সিআইডির সাবেক প্রধান মোহাম্মদ আলীর বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা
হামলা-লাঞ্ছনা, অতঃপর পুলিশের হস্তক্ষেপে বায়রার সংবাদ সম্মেলন
ইশরাককে  শপথ পড়ানো সম্ভব নয়, যদি...
কুষ্টিয়ায় ট্রাক্টর চাপায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা