নিজাম হাজারীর নামে ১৩০০ শতক জমি, ফ্ল্যাট-বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পেয়েছে দুদক

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা টাইমস
  প্রকাশিত : ০৫ মে ২০২৫, ১৭:৫৭
অ- অ+

দেশজুড়ে আলোচিত-সমালোচিত ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীর আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিবিহীন বিপুল অর্থসম্পদের উৎসের অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন— দুদক।

দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে ইতোমধ্যে তদন্ত দল নিজাম উদ্দিন হাজারীর নামে যেসব অর্থসম্পদ সন্ধান পেয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে- ফেনীতে ১৩৮ দলিলে ১ হাজার ৩০০ শতক জমি ক্রয়, রাজধানীর গুলশান, মোহাম্মদপুর, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে ফ্ল্যাট ও জমির মালিকানা অর্জন, গার্ডেন সিটিতে একই ফ্লোরে আটটি বাণিজ্যিক দোকান, ৫৫০ কোটি টাকার ব্যাংক লেনদেন, বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে ১২ কোটি ৬১ লাখ টাকা স্থিতি, নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন ছয়টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে ১২ কোটি টাকার শেয়ার বিনিয়োগ এবং ফেনীতে শতকোটি টাকা ব্যয়ে হেলিপ্যাড সম্বলিত বিশাল অট্টালিকা।

দুদক বলেছে, তথ্য-উপাত্তে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হচ্ছে, তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত অবৈধ অর্থ সম্পদ গড়ে তুলেছেন।

দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ৮২টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ৫৫০ কোটি টাকার অবৈধ ও সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য পেয়েছে দুদক। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ৩০ শতক বাস্তুভিটার উপর ভর করে চলা নিজাম হাজারী ২০১৪ সালের পর থেকে মাত্র ১০ বছরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুরে ফ্ল্যাট, জমি, বাণিজ্যিক দোকান-ঘরের মালিকানা অর্জন ছাড়াও ফেনী পৌরসভায় নিজ নামে ১ হাজার ৩০০ শতক জমি ক্রয় ও স্ত্রী-কন্যাসহ আত্মীয়-স্বজনের নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন।

দুদক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নিজাম হাজারীর স্ত্রীর নামেও গুলশান তিনটি ফ্ল্যাট, মোহম্মদপুরে ৫০ শতাংশ জমি, কেরাণীগঞ্জে বাগানবাড়ি, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, খাগড়াছড়িতে বিপুল সম্পদ ও প্রায় ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ স্থিতির সন্ধান পেয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগের ১৪ বছরের শাসনামলে ফেনী জেলা কেন্দ্রিক আওয়ামী রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ, ভূমিদস্যুতা, চাঁদাবাজি, ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণসহ নানা অভিযোগ রয়েছে নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে। প্রতিপক্ষের প্রতি রাজনৈতিক হামলা, গুম, খুনসহ বিভিন্ন অভিযোগে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বিচার প্রশাসনে অভিযোগ ও মামলা বিচার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। নিজাম হাজারী ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় নির্বাচিত ১৫৩ সংসদ সদস্যের একজন। গত ১০ বছরে নিজাম হাজারী ফেনীর রাজনীতিতে একক অধিপতির ভূমিকা পালন করেছেন। এই ১০ বছরের ফেনী পৌরসভায় ১৩৮টি পৃথক দলিল রেজিস্ট্রিমূলে ১ হাজার ২৯৬ শতক জমির মালিকানা অর্জন করেছেন। এসব দলিলকৃত সম্পদের মৌজা মূল্য দেখিয়েছেন ৫৪ কোটি টাকা। অথচ ফেনী পৌরসদরের এসব জমির প্রকৃত বাজার মূল্যে ১০ গুণ বেশি। স্থানীয়দের সঙ্গে দুদক কর্মকর্তারা কথা বলে জানতে পেরেছেন, এসব সম্পদে ক্রয়মূল্য আনুমানিক ৫০০ কোটি টাকা হতে পারে।

দুদকের উপ-পরিচালক ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মোহাং নুরুল হুদা বাসসকে জানান, প্রাথমিক অনুসন্ধানে দুদক যেসব তথ্য-উপাত্ত পেয়েছে সেগুলো আমরা নথিভুক্ত করে আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক স্থাবর সম্পদ ক্রোক ও অস্থাবর সম্পদ অবরুদ্ধ করেছি। জমির রেজিস্ট্রি মূল্য ধরেই আমরা আপাতত হিসাব-নিকেশ করছি। অবশিষ্ট হিসাব আদালতে বিচার্যসময়ে বিবেচনায় নেয়া হবে।

তিনি জানান, নিজাম হাজারী মাত্র ১৪ বছরে আওয়ামী শাসনামলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি বিহীন জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করায় দুদক আইন ২০০৪ এর ২৭(১) এবং মানিলন্ডারিং

দুদক নিজাম হাজারীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধের আবেদন জানালে ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ মো. জাকির হোসেনের আদালত এসব অবৈধ সম্পদ ও ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের আদেশ দিয়ে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রচারের নির্দেশ দেন।

দুদক কর্মকর্তা জানান, আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তার স্ত্রী ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের তথ্য অনুসন্ধানে নেমেছে তারা। দুদক অনুসন্ধান তথ্যে দেখা যায়, এ পর্যন্ত ৮২টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ৫৪৯ কোটি ২৮ লাখ ৪৫ হাজার ৫০৪ টাকা লেনদেন করেছেন। ১১টি পৃথক ব্যাংকের ৩৬টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা স্থিতি রয়েছে ১২ কোটি ৬০ লাখ ৯৫ হাজার ৪৫০ টাকা।

দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হওয়ার আগে ২০১৩ সালে পাঁচটি পৃথক দলিলে মাত্র ১১ দশমিক ৩১ শতাংশ জমি ক্রয় করেছেন। এমপি নির্বাচিত হওয়ার মাত্র একমাস পর ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ঢাকার গুলশানে নিজাম হাজারী ও তার স্ত্রী নুরজাহান বেগমের যৌথ নামে বরাদ্দকৃত (১০৬ নম্বর সড়কের ১৮/ডি প্লট) এমপরি লেক ফ্রন্ট আবাসিক ভবনের ৬ষ্ঠ তলায় ২ হাজার ৪৭০ বর্গফুটের এ-৫ নং ফ্ল্যাট ও গাড়ি পার্কিং। এর মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ৭৪ লাখ ১০ হাজার টাকা।

২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত ৬ মাসে ১১টি পৃথক রেজিস্ট্রি দলিলে একটি ছকে ৭৭ দশমিক ১৩ শতাংশ জায়গা ক্রয় করেছেন ফেনী পৌরসভার সহদেবপুর এলাকায়। যেখানে নিজাম হাজারী সুদৃশ্য একটি ট্রিপ্লেক্স অট্টালিকা নির্মাণ করেছিলেন। যেটি ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর স্থানীয় অধিবাসীদের ক্ষোভের রোষানলে পড়ে ভস্মীভূত হয়েছে। যেখানে ভবনের ছাদে হেলিপ্যাড পর্যন্ত নির্মাণ করা হয়েছিল। আয়কর নথিতে ট্রিপ্লেক্স ভবনটির নির্মাণ ব্যয় দেখানো হয়েছে সাড়ে ১০ কোটি টাকা এবং অতিথিশালার (গেস্টহাউস) নির্মাণ ব্যয় দেখানো হয়েছে দেড় কোটি টাকা। এছাড়াও প্রায় ৫ একর এলাকাজুড়ে সুসজ্জিত বাগান, বিনোদন উপকরণসহ নানারকম দৃষ্টিনন্দন সাজসজ্জা ছিল। লোকমুখে প্রচলিত আছে এই অট্টালিকা নির্মাণে প্রায় শতকোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।

নিজাম হাজারীর নামে মোহাম্মদপুর কাটাসুর মৌজায় ১৫ মার্চ ২০১৮ সালে ২১৩০ নং দলিল মূলে ৩০ কাঠা নাল জমি ক্রয় করেছেন। ‘গার্ডেন সিটি’ নামে নির্মাণাধীন একটি ১৭ তলা বিশিষ্ট আবাসিক কাম-বাণিজ্যিক ভবনের দ্বিতীয় তলার বাণিজ্যিক ফ্লোরে প্রতিটি ২৫০ বর্গফুট আয়তনের আটটি দোকান রয়েছে। ভবনের দ্বিতীয় তলায় দোকানগুলো হচ্ছে, বি-১১১, বি-১১২, বি-১১৩, বি-১১৪, বি-১১৫, বি-১১৬, বি-১১৭ এবং বি-১১৮। এখানে তিনটি গাড়ি পার্কিং রয়েছে। দোকানগুলো ২০২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ৮২১ নং দলিল মূলে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে নামজারি খতিয়ান করা হয়েছে। এসব দোকানের মূল্য বাবদ পরিশোধিত অর্থ দুদকের অনুসন্ধানে উল্লেখ করা হয়নি।

এছাড়াও, ২০২০ সালে আটটি পৃথক দলিল মূলে ফেনী পৌরসভার সহদেবপুরে প্রায় ৬০ শতক জমি রেজিস্ট্রি নিয়েছে। পরবর্তী দুইবছরে আটটি পৃথক দলিল মূলে ফেনী পৌরসভায় জমি কিনেছে সাড়ে ৭৮ শতাংশ। এভাবে ২০১৪ সালের পর থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১৩৮টি দলিল মূলে ৫৪ কোটি টাকার ১ হাজার ২৯৬ শতক জমি ও সম্পদ ক্রয় দেখিয়েছেন।

চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানার পূর্ব পাহাড়তলী মৌজায় ২৫ মে ২০০০ সালে ২৯৯৫ নং দলিল মূলে আটশতক জমি ক্রয় করেছেন। যার দলিল মূল্য দেখিয়েছেন মাত্র ১ লাখ ২০ হাজার টাকা।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, নিজাম হাজারীর নামে ৩ লাখ টাকা মূল্যের একটি শর্টগান রয়েছে। স্নিগ্ধা ইক্যুইটিজ লিমিটেডে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকার শেয়ার, স্নিগ্ধা ফিশিং এন্ড হ্যাচারিতে ১ কোটি ৯৯ লাখ ৮০ হাজার টাকার শেয়ার, ফাল্গুনী এয়ার ইন্ট্যারন্যাশনাল-এ ৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা, স্নিগ্ধা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট লিমিটেডে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, স্নিগ্ধা ডিজাইন লিমিটেডে ৫ লাখ টাকা, স্নিগ্ধা ওভারসিজ লিমিটেডে ১০ লাখ টাকার শেয়ার আমানত রয়েছে।

নিজাম হাজারী উত্তরাধিকার সূত্রে মাত্র ৩০ শতক বাস্তুভিটা পেলেও অনুসন্ধান রিপোর্টে দেখা যায়, হাজারী তার মেয়ে নূর রাহাত জাহান স্নিগ্ধাকে চারটি পৃথক হেবা দলিলে ৪৮২ দশমিক ৫৪ শতাংশ জমি হেবাদান করেছেন।-বাসস

(ঢাকাটাইমস/০৫মে/এমআর)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
কলাবাগান ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় নতুন ওসি
শরীয়তপুরে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে নির্মাণশ্রমিকের মৃত্যু
হিথ্রো বিমানবন্দরে খালেদা জিয়া, গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গেলে তারেক রহমান
ট্রাফিক ইন-সার্ভিস সেইফ ড্রাইভিং কোর্সের উদ্বোধন
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা