ফেনীর নবাব নিজাম হাজারীর দুইশ কোটি টাকার বালাখানা

বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা টাইমস
  প্রকাশিত : ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:৫২| আপডেট : ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:২৯
অ- অ+

ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে হায়দ্রাবাদের নিজামের কথা শুনেছেন। নিজাম আসলে কোনো ব্যক্তির নাম ছিল না, এটি ছিল মুঘল ও ইংরেজ আমলে দক্ষিণ ভারতের হায়দ্রাবাদের শাসকের উপাধি। নিজাম-উল-মুলক, অর্থাৎ রাজ্যের শাসক।

বাংলাদেশেও একজন নিজাম ছিলেন। তিনি হচ্ছেন ফেনীর নিজাম উদ্দিন হাজারী। সরকারিভাবে তার কোনো রাজ্য ছিল না, তাই এই নিজাম তার কোনো উপাধিও নয়। কিন্তু পুরো ফেনী জেলাকেই বানিয়েছিলেন নিজের রাজ্য। বাদশাহি আমলের মতই নির্মাণ করেছিলেন নিজের বালাখানা। সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা আর ইউনিয়ন পরিষদের মত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিরাও যেন ছিল তার হুকুমের দাস। সাধারণ মানুষের কথা তো বলাই বাহুল্য। নিজাম হাজারী কিভাবে ফেনীর নিজাম হয়ে উঠেছিলেন, জানাচ্ছি সেই কথা।

ফেনীর বাসিন্দা নিজাম হাজারী তরুণ বয়সে থাকতেন চট্টগ্রামে, করতেন অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা। ১৯৯২ সালে এক অস্ত্র মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অল্প কিছুদিন হাজত খেটে জামিন নিয়ে বের হয়ে আসেন জেলখানা থেকে। ২০০০ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায়, তখন সেই মামলাতেই নিজাম হাজারীকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয় নিম্ন আদালত। হাইকোর্ট-আপিল বিভাগেও বহাল থাকে সেই রায়, সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি হিসাবে কারাগারে যান নিজাম হাজারী।

তবে নানা রকম ভেল্কি জানতেন নিজাম হাজারী। কারাগারের নিয়ম অনুযায়ী, যতদিন সাজাভোগ করার কথা, তার চেয়ে ২ বছর ১০ মাস কম সাজা খেটেই ২০০৫ সালে জেল থেকে বের হয়ে আসেন। কারাগারের নথিতে ভেল্কি দেখিয়ে এই অসাধ্য সাধন করেছিলেন তিনি।

এরপর ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। গুরু জয়নাল হাজারীকে কোনঠাসা করে ধীরে ধীরে নিজের আধিপত্য বাড়াতে থাকেন শিষ্য নিজাম হাজারী। অস্ত্র মামলায় সাজা ভোগ করার তথ্য গোপন করে ২০১১ সালের পৌর নির্বাচনে হয়ে যান ফেনী পৌরসভার মেয়র। এখানেই থেমে থাকেননি, মেয়রের পদে থেকেই ২০১৪ সালে বিরোধী দলবিহীন সংসদ নির্বাচনে ফেনী-২ আসন থেকে আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য হন। এবারও নির্বাচন কমিশনের হলফনামায় তথ্য গোপন করেন তিনি। সাজাভোগ করার বদলে হলফনামায় লেখেন মামলা নিষ্পত্তিতে মুক্তি পেয়েছেন তিনি।

সংসদ সদস্য হয়েই ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নেন নিজাম হাজারী। এবার আর তাকে পায় কে! এক সময় তিনি আর পাশের ফুলগাজী উপজেলা পরিষদেরে চেয়ারম্যান একরাম মিলে গুরু জয়নাল হাজারীকে কোনঠাসা করেছিলেন।

এবার ফেনীতে নিজের একচ্ছত্র রাজত্ব কায়েম করার পথের কাঁটা একরামুলকে সরানো দরকার। ২০১৪ সালের ২০ মে দিনেদুপুরে গুলি করে ও আগুনে পুড়িয়ে একরামকে হত্যা করে আততায়ীরা। বেশিরভাগ মানুষের বিশ্বাস, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিলেন নিজাম হাজারী। একরাম খুন হওয়ার পর নিজাম হাজারীকে চ্যালেঞ্জ জানানোর আর কেউ রইল না।

এবার নিজাম হাজারীর মনোযোগ শুধু টাকা কামানোর দিকে। রাস্তা মেরামত থেকে শুরু করে মসজিদ নির্মাণের টেন্ডার, নিজাম হাজারীকে কমিশন না দিলে কাজ পাবে না ঠিকাদার। ফেনী থেকে বাস চলবে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায়, এর জন্যও নিজাম হাজারীর বখরা চাই। এমনকি সিএনজি চালিত অটোরিকশা আর ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার স্ট্যান্ড থেকেও চাঁদা তুলতেন নিজাম হাজারী। তাকে চাঁদা না দিলে ফেনীতে কোনো কলকারখানাও করতে পারতেন না কোনো শিল্পপতি।

কেউ নিজের জায়গাতে বড় কোনো ভবন করবে, এজন্য নিজাম হাজারীকে চাঁদা দিতে হবে। তাকে টাকা না দিয়ে কোনো সালিশি-দরবারও হতো না। মোদ্দা কথা, ফেনীতে এমন কোনো জায়গা বাদ ছিল না, যেখান থেকে চাঁদা তুলতেন না সাবেক এই সংসদ সদস্য।

ফেনী শহরের মাস্টারপাড়ায় বিরাট এলাকা জুড়ে এক বাগানবাড়ি তৈরি করেন নিজাম হাজারী। বড় লেক, খেলার জায়গা, হেলিপ্যাড, দৃষ্টিনন্দন ভবন- কী ছিল না সেই বালাখানায়? এই বালাখানা বানাতে বেশিরভাগ জমি নামমাত্র মূল্য দিয়ে জোর করে হিন্দুদের কাছ থেকে নিয়ে নেন নিজাম হাজারী। দলিল করে না দিলে কোনো টাকা ছাড়াই দখল করেন জমি। এই বালাখানা নির্মাণে খরচ হয় কমপক্ষে দুইশ কোটি টাকা।

এই বাগান বাড়ি ছাড়াও ফেনীর বালিগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকায় নিজাম হাজারী নির্মাণ করেন আরও পাঁচটি বাড়ি। আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের জন্য ফেনী শহরে নিজেই নির্মাণ করেন বহুতল ভবন। নিজের ও স্ত্রীর নামে চট্টগ্রামে করেছেন দুটি লাইটারেজ জাহাজ। ছিল জনশক্তি রপ্তানির ব্যবসা, সেখানেও সিন্ডিকেট গড়ে কামিয়ে নিয়েছেন বিপুল অর্থ।

তবে এসবই তার ধনসম্পদের কিয়দংশ মাত্র। ফেনীর আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতারাই বলেন, নিজাম হাজারী তার প্রায় পুরো টাকা পাচার করেছেন দুবাই, আমেরিকা ও কানাডায়।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারতে পালিয়ে যান তিনবারের সংসদ সদস্য নিজাম হাজারী। সেখানে থেকে দুবাই। ফেনীর বিক্ষুব্দ মানুষ পুড়িয়ে দিয়েছে তার বালাখানা। সম্প্রতি নিজাম হাজারীর ৮২টি ব্যাংক একাউন্টে ৫৪৮ কোটি ৮০ লাখ টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর মধ্যে ১৮ কোটি ৭২ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক।

(ঢাকাটাইমস/২৬জানুয়ারি/আরবি)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা