আপসহীন মনোভাব এবং সুকৌশলেই হতে পারে মাদকমুক্ত বাংলাদেশ

ড. আনোয়ার হোসেন
  প্রকাশিত : ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৫:২৬
অ- অ+

প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে অনিয়ন্ত্রিত মাদকদ্রব্য সমস্যা ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েই চলেছে। এ কারণে পরিবারগুলো অসহায় হয়ে পড়ছে। কোনো বাড়িতে মাত্র একজন মাদকাসক্ত মানেই পুরো বাড়িতে অশান্তির কালো ছায়া নেমে আসা। আজকের মাদকাসক্ত ব্যক্তি আগামী দিনের মাদক ব্যবসায়ী। মাদকাসক্ত বেড়ে যাওয়া মানে আমাদের মা-বোনেরা বেশি নির্যাতিত হওয়া। মাদকের টাকার জন্য মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা নারীদের ওপর বেশি নির্যাতন করে থাকে। আত্মহত্যার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা তুলনামূলকভাবে বেশি আত্মহত্যা করছে। স্বামী-স্ত্রীর তালাকের পরিসংখ্যানেও মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা এগিয়ে। নগণ্য সংখ্যক হলেও বর্তমানে নারীরাও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছেন। এ তালিকায় কোমলমতিরাও রয়েছেন। ইভটিজিং, যৌতুক ও নারী নির্যাতন সংক্রান্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এসব কার্যক্রমে মাদকাসক্তরা কয়েক ধাপ এগিয়ে রয়েছে। মানব পাচার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এদের অধিকাংশ সদস্যই মাদকাসক্ত। আদালতের মামলার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মাদকাসক্ত বিষয়ক মামলা ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে চলছে। দেশের থানাগুলোতে মামলা, অভিযোগ ও জিডি করার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা কয়েক ধাপ এগিয়ে। সরকার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ করতে সবচেয়ে বেশি কর্তৃপক্ষ নিয়োগ করে রেখেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সুরক্ষা সেবা বিভাগের অধীনস্থ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এ অধিদপ্তরের অধীনস্থ বাংলাদেশের সকল জেলায় কার্যালয় রয়েছে। যদিও জনবল ঘাটতির কারণে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় একজন সহকারী পরিচালক/উপ-পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তা একাধিক জেলার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন। বর্তমানে প্রতিটি জেলায় এ অধিদপ্তরের নিজস্ব ইন্সপেক্টর, সাব-ইন্সপেক্টর, প্রসিকিউটর, সহকারী উপ-পরিদর্শক, হিসাবরক্ষক, অফিস সহকারী, সিপাই, অফিস সহায়ক এবং ওয়্যারলেস অপারেটর রয়েছে। প্রতিটি বিভাগে একজন অতিরিক্ত পরিচালক পদমর্র্যাদার কর্মকর্তার নেতৃত্বে কার্যালয় রয়েছে। বিভাগীয় কর্মকর্তা বিভাগীয় সমম্বয়ক হিসেবে কাজ করেন। বিভাগীয় কমিশনার বিভাগীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কমিটির সভাপতি। জেলা প্রশাসক জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কমিটির সভাপতি এবং এ বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উপজেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কমিটির সভাপতি। বাংলাদেশ পুলিশের মাঠ পর্যায়ে প্রায় প্রতিটি কার্যালয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে কাজ করে থাকেন। বাংলাদেশের থানাগুলোতে মোট মামলার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মাদকদ্রব্য সংক্রান্ত। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ নিয়মিত মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে থাকেন। মাদকদ্রব্য একটি স্বাস্থ্যগত সমস্যা হওয়ায় স্বাস্থ্য বিভাগের চিকিৎসা কার্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে। সরকারি ও বেসরকারি মাদক পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলো মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কার্যক্রম করে যাচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ নিয়মিত মাদকাসক্তদের চিকিৎসা দিয়ে আসছেন। জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে মানুষিক ভারসাম্যহীনদের জন্য পরিচালিত পাবনাসহ বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, ভর্তিকৃত রোগীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই মাদকাসক্ত রোগী।

উপরোক্ত কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার প্রতি বছর হাজার কোটি টাকা ব্যয় ও হাজারো জনবল নিয়োগ করলেও মাদক সেবনকারী, মাদক ব্যবসায়ী ও আন্তর্জাতিক চোরাকারবারীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে দেশটি। যার অন্যতম কারণ হলো অরক্ষিত সীমান্ত, রক্ষক নিজেই ভক্ষক বনে যাওয়া। রাজনীতিবিদ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ মাদক ব্যবসায় জড়িত থাকা।

অনিয়ন্ত্রিত মাদকদ্রব্যের সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে গণসচেতনতামূলক কার্যক্রম নিতান্তই লোক দেখানো এবং যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বাংলাদেশ সরকার সচেতনতামূলক কার্যক্রমকে তুলনামূলক কম গুরুত্ব দিয়ে বলপ্রয়োগ করার ওপর নির্ভর করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল নিচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন করার লক্ষ্যে শতাধিক পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যার অধিকাংশই ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দার। অনেক পুনর্বাসন কেন্দ্রে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা প্রদানের পরিবর্তে অমানবিক নির্যাতন করে থাকে। পরিবারগুলো অতিষ্ঠ হয়ে সন্তানদেরকে এসব কেন্দ্রে দিয়ে যায়, এসব কেন্দ্রে ব্যয়ও যথেষ্ট বেশি। কিছু সংখ্যক পুনর্বাসন কেন্দ্র নিজেদের পকেট ভারী করা ব্যতীত অন্য কোনো কাজ নেই। কতক মাদক পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিদিন রুটিনমাফিক গড়ে তিন বেলা ভর্তিকৃত মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে পিটিয়ে নিস্তেজ করে ইনজেকশন পুশ করে ঘুম পাড়িয়ে রাখাটাই তাদের ভালো চিকিৎসা। তবে হাতেগোনা কয়েকটি ভালো পুনর্বাসন কেন্দ্র রয়েছে।

করোনা ভাইরাসসহ ইতিহাসের যত দুরারোগ্য মহামারি বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে, তার কোনোটাই শক্তিশালী ট্যাবলেট, ক্যাপসুল বা অন্য কোনো বলপ্রয়োগের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। কেবলমাত্র টিকা বা এন্ট্রি বডি দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। সচেতনতার মাধ্যমে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হলে এটা এন্ট্রিবডি হতেও বেশি কার্যকর হবে। বলপ্রয়োগ করে শত্রুতা সৃষ্টি না করে গণসচেতনতামূলক কার্যক্রমের মতো সহজ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে হাতে হাত রেখে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তুলনামূলক কম খরচে সফলভাবে মাদক মুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হতে পারে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৮ কোটি ছাত্রছাত্রী রয়েছে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে এতসংখ্যক জনসংখ্যাও নেই। প্রায় ৮ কোটি কোমলমতিকে ক্ষতিকর নেশাবিরোধী কার্যক্রমের মাধ্যমে সচেতন করার জন্য বেসরকারি পর্যায়ের বাংলাদেশে মাত্র দুটি দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক গভর্নমেন্ট রিকমেনডেড ও অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। দেশীয় সরকার অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানটির নাম প্রতিভা অ্যাডুকেশন ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ওয়েলপেয়ার সোসাইটি। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানটির নাম ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্ট্রি অ্যালকোহল। প্রতিষ্ঠান দুটির কাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো লোক দেখানো নয়, বরং ক্ষতিকর নেশা (মাদকসহ) মুক্ত শিক্ষাঙ্গন গড়া। প্রতিষ্ঠান দুটি সস্তা জনপ্রিয়তার মেশিন ফেসবুক ও ইউটিউবে প্রচারণা করে না। প্রতিষ্ঠান দুটি ইতিমধ্যে প্রায় ২ কোটি বিনামূল্যে লিফলেট বিতরণ করেছে বাংলাদেশে। প্রতিষ্ঠান দুটি আলোচনা, র‌্যালি, কাউন্সিলিং, সেমিনার, প্রজেক্টরের মাধ্যমে মাদকবিরোধী ভিডিও ফুটেজ প্রদর্শনের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে মাদকবিরোধী মনোভাব গড়ে তুলতে কাজ করে থাকে। প্রতিষ্ঠান দুটির আরেকটি ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য হলো তারা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহের অনুমোদন, রিকমেনডেশন এবং সংশ্লিষ্টতা ব্যতীত কোনো ধরনের কার্যক্রম করে না।

আমি এ প্রতিষ্ঠানে কার্যক্রম করতে গিয়ে ২০১১-১২ খ্রিষ্টাব্দে আমার জীবনের বাঁক পরিবর্তনের কিছু বিষয় সবিনয়ে তুলে ধরব। ঐ সময় আমার বয়স খুব কম ছিল। আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী একটি সংগঠনের দায়িত্ব পেয়ে আমার ভারতবর্ষে রাজ্য হতে রাজ্যে, এক দেশ হতে অন্য দেশে ছোটাছুটি এবং বাংলাদেশেও এক জেলা হতে আরেক জেলায় মাদকমুক্ত বিশ্ব গড়তে নিরলসভাবে কার্যক্রম করতে হয়। আমার অভিজ্ঞতা খুব কম থাকায় হেকমত বা কৌশল অবলম্বনের পরিবর্তে আবেগ ও কট্টর হয়ে পড়ায় এক শ্রেণির দুর্বৃত্তের রোষানলে পড়তে হয়। এ ঘটনায় দীর্ঘদিন দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে হয় আমাকে। এসব দুর্বৃত্ত ক্ষমতাসীন সরকারের শীর্ষ ব্যক্তির ডান হাত হওয়ায় রাষ্ট্রের বাঘা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারাও এদের নিকট অসহায়। যখন যে সরকার ক্ষমতাসীন হয় এমন কিছু ব্যক্তি তাদের ছত্রছায়ায় থাকে, যারা প্রতিনিয়ত ধরাকে সরাজ্ঞান করে থাকেন।

ইয়াবা মাদক হিসেবে তখন মাথাচাড়া দিচ্ছিল নতুন করে। তৎকালীন সংবাদপত্রে দেখতে পেতাম ইয়াবা সুন্দরীর গল্প। অর্থাৎ মেয়েরাও ইয়াবা সেবন শুরু করেছে মাত্র। আমার কর্মসূচিতে মাঝেমধ্যে অস্বস্তিতে পড়তে হতো, কর্মসূচি চলাকালীন সংশ্লিষ্ট এলাকার চেয়ারম্যান বা অন্য কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব স্টেজে আমার সঙ্গে বসে অস্বাভাবিকভাবে পাগলের মতো নিজের শরীর চুলকাচ্ছে। আবার এক ধরনের ব্যতিক্রমী গন্ধ শরীর হতে বের হচ্ছে। পরবর্তীতে শুনতে পেলাম ঐ ব্যক্তি ইয়াবা সেবক নারী ও ইয়াবাকারবারী। আমি মাদকবিরোধী কনসার্ট করতাম। আমার বক্তব্যের মাধ্যমে কনসার্ট শুরু হতো। এক পর্যায়ে আমি ইয়াবাকারবারীদের বিরুদ্ধে সরব হতে শুরু করলাম। স্টেজ প্রোগ্রামেও সরব হতে শুরু করলাম। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কর্মসূচি দিতে শুরু করলাম।

কোনো একদিন এক ব্যক্তি কক্সবাজার হতে আমার সেলফোনে কল দিয়ে বললেন তিনি দেখা করতে চান। ইন্টারন্যাশনাল রোমিং হয়ে কল হয়। আমি তখন ফিলিপাইনে। তিনি বললেন আমার সঙ্গে চুক্তি করতে চান। আরো বললেন তারা বড় অঙ্কের অর্থনৈতিক সহযোগিতা করতে ইচ্ছুক। আমি ভাবলাম মাদকবিরোধী কর্মসূচিতে হয়তো বা সহযোগী হতে ইচ্ছুক তারা। আমি ঢাকা আসার পর তাকে দেখা করতে বললাম। তিনি দেখা করেই বললেন আপনার প্রতি অনুরোধ ইয়াবার বিরুদ্ধে কর্মসূচি করবেন না। মদ, গাঁজা, ফেনসিডিলসহ সবকিছুর বিপক্ষে বলবেন, আমরাও আপনার সঙ্গে আছি। বিনিময়ে এ চেকটি গ্রহণ করুন। আমি চেকটি হাতে নিয়ে তাজ্জব। এত টাকা আমার লাইফে কোনো একটি চেকে আমি কখনোই দেখিনি এবং চিন্তাও করিনি। আমি তৎক্ষণাৎ চেকটা চার টুকরা করে ছিঁড়ে তার মুখে নিক্ষেপ করলাম। তাকে বসতে বললাম। মোবাইল হতে পুলিশকে কল করা মাত্রই সে ভো দৌড় দিয়ে পালাতে লাগল। আমি বিষয়টি তৎকালীন বাংলাদেশ পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেলকে অবহিত করলাম। তিনি তিনদিন পর আমাকে জানালেন তাদের হাত অনেক শক্তিশালী। আমাকে দেখেশুনে সাবধানতার সঙ্গে পা বাড়াতে পরামর্শ দিলেন। অন্যদিকে আমার নিজ উপজেলা হতে একাধিক শুভাকাক্সক্ষী কল করে জানালেন বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদরা আমার বিরুদ্ধে বিষোদগার করছে। তারা বলছেন ২৪ বছরের পুঁচকে ছেলে অধিকাংশ কর্মসূচিতে প্রধান অতিথি হয়। আমরা ৩০ বছর পর্যন্ত রাজনীতি করে আঙ্গুর চুষব কি?

২০১২ সালের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে অর্থাৎ ঈদ পরবর্তীতে দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ জেলার দাউদপুর ডিগ্রি কলেজে মাদকবিরোধী কনসার্র্ট আয়োজন করা হয়েছে ফ্রীডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহলের সৌজন্যে। ঐ কর্মসূচিতে আমি অংশগ্রহণ করব বলে নিশ্চিত করেছিলাম। হঠাৎ ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখা হতে আমাকে কল দিয়ে বললেন নিরাপত্তা ব্যতীত কোনো কর্মসূচিতে যাতে অংশগ্রহণ না করি। আমি দাউদপুর ডিগ্রি কলেজের কর্মসূচি আয়োজকদেরকে বললাম লোকাল থানায় আমার চিঠি যেন পৌঁছে দেয় এবং ডিএমপির গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে বিষয়টি অবহিত করলাম। কর্মসূচি শুরু হতেই সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমার পাশে এসে বসলেন। অনুরোধ করলেন ওটা হিলি সীমান্ত এলাকা এবং আমার বক্তব্য ১৫ মিনিটের মধ্যে শেষ করতে। তিনি আরো বললেন কনসার্ট শেষ হওয়া পর্যন্ত তিনি নিজে কমপক্ষে চারটি গান পরিবেশন করার সুযোগ যেন পান। আমি লোকাল কর্তৃপক্ষকে তার চারটি গান পরিবেশন করার পারমিশন দিয়ে দিলাম। তবে আমি তার কথায় পাত্তা না দিয়ে ২৫ মিনিট বক্তব্য রাখলাম। হিলি সীমান্তে অধিকাংশ মানুষ পেটুক এবং পিঠের স্বাস্থ্য ভালো, এ বিষয়টি আমি তুলে ধরলাম। অর্থাৎ ভারত হতে চোরাইমাল এদের পেট এবং পিঠে বাঁধা ছিল বিষয়টি আমি বক্তব্যে উল্লেখ করলাম। এখানে আমার ভুল ছিল। কারণ এগুলো আমার কাজের মধ্যে ছিল না, সচেতন করাটাই আমার কাজ। তিনি কনসার্টের শেষ দিকে আমাকে জড়িয়ে ধরে অনুরোধ করলেন আমি যেন ঢাকা তৎক্ষণাৎ রওয়ানা দিই এবং তার থানা এলাকা স্কট করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেন। ঢাকা পৌঁছা মাত্রই ঈদ পরবর্তী হওয়ায় আমার সঙ্গীরা ছুটির আবদার করলেন। আমি সবাইকে ছুটি দিয়ে পরবর্তী কর্মসূচি সিলেটের উদ্দেশে রওয়ানা দিয়ে দিলাম। উপশহরের হোটেল স্টারে উঠলাম। হোটেল হতে এমসি কলেজে কর্মসূচিতে যাওয়ার পথে আমি অপহরণ হলাম। পুলিশ ও র‌্যাব আমার পরিবারকে বললেন পরিস্থিতি ঘোলাটে, আমরা অভিযান পরিচালনা করে উদ্ধার করতে পারব, তবে জীবিত উদ্ধার করতে পারব কি না সন্দেহ রয়েছে। কারণ আন্তর্জাতিক মাদক চোরাকারবারী চক্র এ ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে। আমার পরিবার অভিযানের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। যেহেতু পুলিশ এবং র‌্যাব জীবিত উদ্ধার নিয়ে সন্দিহান ছিল। অপহরণকারীরা আমার ল্যাপটপ, মোবাইল ও ই-মেইল আইডিগুলো নিয়ন্ত্রণে নেয়। সিলেটের তামাবিল ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়ে আমার চোখের বাঁধন খুলে দেয়। পুনরায় চোখের বাঁধন দিয়ে দীর্ঘ ১৬ ঘণ্টা পর যশোর সীমান্তে দিয়ে ভারতে নিয়ে যায়। আমাকে আন্তর্জাতিক মাদক কারবারীরা নেশাগ্রস্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রতিবারই আমার বমি হয়ে যায়। আমি বারবার আল্লাহু আকবার বলতে থাকি। শেষ অবধি তারা ব্যর্থই হয়। তারা আমার বোকাল কর্ড (ষড়যন্ত্র) নষ্ট করার চেষ্টা করে। আমি শারীরিক ও মানুষিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। তারা আমার আন্তর্জাতিক ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ড কবজায় নিয়ে সব টাকা নিয়ে যায়। আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদেরকে ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা দেয় আমার মুক্তির জন্য। তাদের দেওয়া উপহার হিসাবে আমার গলার বোকাল কর্ডে একাধিক বর্ণ ও অক্ষরের উচ্চারণ ভুল নিয়ে আমি আজও কার্যক্রম করে যাচ্ছি। মাদক চোরাকারবারীরা আমাকে মুক্তির জন্য কয়েকটি শর্ত প্রদান করে। তার মধ্যে আমার আঁতে ঘা লাগে যখন তারা আমাকে বলে মাদকদ্রব্যের ক্ষতিকর দিক ও মাদকাসক্তদের করুণ জীবন নিয়ে আমার যে ৩টি উপন্যাস লেখা হয়েছিল, এগুলো কখনোই মুদ্রণ করা যাবে না। তার মধ্যে একটি ছিল ইংরেজিতে লেখা যার নাম অ্যালকোহল ইজ কুল, ইট মেইকস এ ম্যান লাইক এ ফুল। এ উপন্যাসটির পেছনে আমার অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়েছে। আমাকে আরো শর্ত দিয়েছিল যে, উপন্যাসগুলোর কনটেন্ট স্থায়ীভাবে ধ্বংস করে ফেলতে হবে। আমি রাজি হয়ে গেলাম। কারণ যখন আমার মাথায় আসল হুদাইবিয়ার সন্ধি নামক অসম চুক্তি, যা ৬ষ্ঠ হিজরীর জিলকদ মাসের (মার্চের ৬২৮ খ্রি.) মদিনা শহরবাসী ও কোরাইশ গোত্রের মধ্যে সম্পাদিত একটি সন্ধি। এটি একটি অসম সন্ধি ছিল। যাতে মুসলমানদের স্বার্থ চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছিল। সাহাবীগণ দুমড়েমুচড়ে পড়েছিল। তবুও হুজুর (সা.) এ চুক্তি সম্পাদন করতে সম্মত হয়েছিলেন।

ভারত সরকার আমাকে উদ্ধার করে। তাদের তত্ত্বাবধানে আমার চিকিৎসা ও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়। এক পর্যায়ে সকল পক্ষ হতে পজেটিভ প্রতিবেদন পেয়ে ভারত সরকার আমাকে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা করে এবং বাংলাদেশে স্বসম্মানে ফেরত প্রদান করে। এ ঘটনাকে নিয়তি হিসেবেই নিলাম। আমি তাবলীগ জামাতে তিন চিল্লা সময় শেষ করে এসে অপহরণকারীদেরকে ক্ষমা করে দিলাম। আল্লাহতালা সবাইকে হেদায়েত দান করুক। আমিন।

বাংলাদেশে আমি ফেরত আসা মাত্রই সকল শিক্ষা অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রতিষ্ঠানটির মাদকবিরোধী কর্মসূচি একযোগে রাষ্ট্রীয়ভাবে অনুমোদন ও রিকমেনডেশন প্রদান করেন। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, স্পেশাল ব্রাঞ্চ এবং ঢাকা মহানগর পুলিশ দীর্ঘদিন তদন্ত করে উক্ত প্রতিষ্ঠানের এবং আমার নিরাপত্তা প্রদানের জন্য সুপারিশ প্রদান করেন। প্রতিবেদনে সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয় যে, এ দুটি প্রতিষ্ঠানই বাংলাদেশের একমাত্র ক্যাম্পাস ভেইজড গভর্নমেন্ট রিকগনাইজড অর্গানাইজেশন। তারা সুস্পষ্টভাবে প্রতিবেদনে অপহরণজনিত ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন। প্রতিবেদন গ্রহণ করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের অঞ্চলসমূহ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন উক্ত প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের নিরাপত্তা প্রদান এবং আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা প্রদানের জন্যও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সকল শাখাকে অনুরোধ করেন। পরবর্তীতে পুনরায় ২০২২ খ্রিস্টাব্দে পুলিশ হেড কোয়ার্টার্স ঢাকা মহানগর পুলিশের মাধ্যমে আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্ট থানাকে নির্দেশনা প্রদান করেন।

সুপ্রিয় পাঠক। আপনারা জেনে আনন্দিত হবেন যে, অপহরণকারী চক্র অধিকাংশই সদ্য সাবেক পতিত সরকারের দোসর হলেও তাদের রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন থাকাকালীনই তারা দেশ হতে পালাতে হলো। আল্লাহতালা কোরআনে বলেন, বান্দা তোমরা কৌশল করো, আমি আল্লাহ তোমাদের চেয়ে বড় কৌশলী। আমি তরুণ প্রজন্মকে বলবো আমার মতো এরকম কট্টর আপসহীন না হয়ে সুকৌশলী হয়ে কাজ করুন। সুকৌশল অবলম্বন করা ইসলামের জায়েজ। তবে কোনো অবস্থাতেই অপকৌশল, চালাকি বা ষড়যন্ত্র নয়। আসুন আমরা সবাই সৎ সাহসী হই। মনে রাখবেন চালাক নয়, বরং বুদ্ধিমানদের জন্যই এ সুন্দর পৃথিবী।

কেউবা আমাকে বলেন আমি সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত নবীন সরকারি কর্মকর্তা ঊর্মির বিষয়টি আমার লেখনীতে নিয়ে আসি কেন। আমার মাত্র ২৩, ২৪ ও ২৫ বছর বয়সের শিক্ষাটা ঊর্মি এবং নবীনদের মাঝে শেয়ার করতে ছাই। কারণ একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের জন্য কান্নার কারণ হতে পারে। আমাদের পূর্ববর্তী জীবনে শিক্ষাটাই আগামী দিনের দাওয়াত ও তাবলীগের উপকরণ। আসুন কোনো কাল্পনিক জিন-ভূতের গল্প নয় বরং সত্য ঘটনা হতে শিক্ষা গ্রহণ করি। মনে রাখতে হবে আমরা সবাই এ দেশের নাগরিক, ক্ষমতাসীন সরকার আলাদা কোনো গ্রহ থেকে নাজিলকৃত কিছু নয়। কাজেই উভয় একে অপরকে বোঝার চেষ্টা করি। সমঝোতার চেষ্টা করি। সরকার মনে করলে বিষয়টিতে তাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে পাবে। আশা করি আমার জানামতে আলোচিত একজন নবীন নারী সরকারি কর্মকর্তার মামলা পজেটিভ পরিণতির দিকে যাবে।

তবে এ ঘটনায় আমার সান্ত্বনার জায়গাটি হলো এদেশের মানুষকে যারাই বেশি ভালো বেসেছিল যেমন নবাব সিরাজউদ্দৌলা, তার পূর্বেকার এবং পরবর্তী সময় অনেক বড় দেশপ্রেমিককে তাদের ভালোবাসার মানুষগুলোই খুন করেছে। আমি তো নগণ্য ব্যক্তি।

পরিশেষে বলা যায় আপসহীন মনোভাব এবং সুকৌশলেই হতে পারে মাদকমুক্ত বাংলাদেশ।

লেখক: আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী সংগঠন ফ্রিডম ইন্টারন্যাশনাল এন্টি অ্যালকোহলের প্রেসিডেন্ট

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ‘স্বতন্ত্র’, অন্যদের ওপর নির্ভর করে না: জয়সওয়াল
শ্রমজীবী মানুষের সমস্যা সমাধানই হবে এবি পার্টির শ্রমিক রাজনীতি: মজিবুর রহমান মঞ্জু 
কোকোর কবরে বিএনপি নেতা জনির শ্রদ্ধা
বাংলাদেশে জলবায়ু সংকটে ৩ কোটি ৩০ লাখ শিশুর শিক্ষা ব্যাহত: ইউনিসেফ
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা