এহসান মাহমুদে বিব্রত বিএনপি, যেভাবে দলে ঢোকেন তিনি

বাম-আওয়ামী ঘরানার আদর্শে অনুপ্রাণিত এহসান মাহমুদ নামের স্বল্প পরিচিত এক সাংবাদিককে নিয়ে বিব্রত অবস্থায় পড়েছে বিএনপি। সম্প্রতি চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে জুলাই অভ্যুত্থান স্মরণে দলটির আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে তাকে দলটির নেতারা নামিয়ে নিতে বাধ্য হন, যখন উপস্থিত সারি থেকে এহসানকে কেন্দ্র করে ‘ফ্যাসিস্ট’, ‘ফ্যাসিস্ট’ শব্দ উচ্চারিত হয়। ওই অনুষ্ঠানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভারচুয়ালি যুক্ত ছিলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এহসান মাহমুদের সাথে বিএনপির সংযোগ ঘটে ২০২৩ কিংবা ২২ সালের দিকে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বিরোধী একটি বলয়ের হাত ধরে তার দলটিতে অনুপ্রবেশ ঘটে। তারেক রহমানকে নিয়ে আর্টিকেল লেখায় একটি পত্রিকা থেকে তিনি চাকরি হারিয়েছেন, এটি ছিল বিএনপির সাথে এহসান মাহমুদের মেলবন্ধনের একটি উপলক্ষ। বিএনপির সাথে সম্পর্ক তৈরি হওয়ার পর তার অতীত ভূমিকা পেছনে পড়ে যায়। রাতারাতি কয়েকটি কমিটিতেও তার জায়গা হয়।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এহসান মাহমুদের বেশ কিছু ছবি এবং ফেইসবুক পোস্ট ভাইরাল হয়। এতে দেখা যায়, এহসান মাহমুদের সাথে আওয়ামী-বাম ঘরানার লোকজনের ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। অন্তত এটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, বিএনপি-বিরোধী আদর্শের প্লাটফর্ম থেকে এসেছেন তিনি।
ছবি ও ফেইসবুক পোস্টের সূত্র ধরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এহসান মাহমুদ শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা বইয়ের সম্পাদনা থেকে শুরু করে পতিত আওয়ামী লীগের আমলে ১৪ দলীয় জোটের বাম ঘরানার নেতাদের সঙ্গে ছিল তার নিবিড় উঠাবসা। বিশেষ করে বিএনপিকে ‘অগ্নিসন্ত্রাস’ হিসেবে তুলে ধরার প্রচারক সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে সখ্যকে কাজে লাগিয়ে অনেককে অর্থের বিনিময়ে চাকরি দেন তিনি।
এছাড়াও শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার বন্দনা করে একাধিক কলাম লেখা, প্রতিনিয়ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আওয়ামী লীগের গুণগান করতেন এহসান।
২০২১ সাল পর্যন্ত ফেইসবুকে তার কয়েকটি পোস্টের আংশিক ছিল এ রকম :
এক. প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) একজন বাঙালি মায়ের চিরায়ত রূপ।
দুই. খালেদা জিয়া তার দলের দুইজন নেতাকে পাঠিয়েছেন ড. ইউনূসের কাছে......তারা ইউনুসের সাথে দেখা করে বলেছেন বিএনপি আপনার সাথে আছে। বিএনপি যে ইউনুসের পাশে আগেও ছিল তা কি এতোদিন ইউনূস সাহেব জানতেন না? এখন কেন ফটোসেশন? সেটা কি ওনারা যাদের বোকা জনগণ মনে করেন, তাদের দেখানোর জন্য।
তিন. হাসিনা, খালেদা, এরশাদ- এরা আলোচনার যোগ্য নয় এদেশের জন্য। ১০০ বছর পরে এদের কথা কেউ মনে রাখবে না।
চার. শেখ হাসিনা সরকারের একটি প্রশংসনীয় কাজ-প্রধানমন্ত্রীর দহগ্রাম সফর। জয়তু হাসিনা।
পাঁচ. পবিত্র কেতাবের সুরা ‘লাহাবের’ শেষ বাক্যটি আজকাল যখন-তখন মনে ভেসে আসে......আমার মনে যখন-তখন ভেসে আসে কে কুৎসাকারিনী হাসিনা না খালেদা?
ছয়. মুজিবের জন্ম না হলে, বাংলাদেশের জন্ম হতো না।
জানা গেছে, ২০১৩ সালের দিকে এহসান মাহমুদ গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আওয়ামী লীগের আমলের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর ঘনিষ্ঠ হওয়ায় এহসান আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক উইংয়ের সাথে জড়িত ছিলেন এবং বহুদিন আওয়ামী লীগের পারপাস সার্ভ করেছেন। ইনুর হাত ধরে ২০১৬ সালে বিটিভির চট্টগ্রাম কেন্দ্রে চাকরিও নেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে এহসান মাহমুদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য মেলেনি। ঘনিষ্ঠজনরাও বলতে পারছেন না কোনো বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজে তিনি লেখাপড়া করেছেন। তবে একটি সূত্রে জানা গেছে, এহসান মাহমুদ এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন।
জানা গেছে, এহসান মাহমুদের গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনিতে। জামায়াত ঘরানার পরিবারে বেড়ে ওঠা এহসানের সখ্য অবশ্য আওয়ামী লীগ ও বাম ঘরানার মানুষের সঙ্গে। তার চাচা স্থানীয় জামায়াতের নেতা। ব্যক্তিজীবনে বিবাহিত এহসান মাহমুদের স্ত্রী এলাকায় একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। দুই সন্তান নিয়ে তিনি মাদারীপুরে থাকলেও পরিবারের বিষয়ে পুরোপুরি উদাসীন এহসান মাহমুদ। এ নিয়ে ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে তার স্ত্রী অভিযোগ করলেও এসব থোড়াই কেয়ার করেন তিনি।
বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে ঢাবির একজন ছাত্রদল নেত্রীর সঙ্গে এহসান মাহমুদের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। তাদের দুজনের হোয়াটসআপে অশ্লীল ক্ষুদেবার্তাও প্রকাশ পেয়েছে। এহসান মাহমুদের স্ত্রী বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের কাছে নিজেই এমন অভিযোগ করেন।
বিএনপিতে যেভাবে ঢুকলেন এহসান মাহমুদ
জানা গেছে, বিএনপিতে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে এক-এগারোর সময় মাইনাস করার প্রক্রিয়ায় জড়িতদের হাত ধরে ২০২৩ সালে মূলত বিএনপিতে আসা এহসান মাহমুদের।
২০২৩ সালে নয়াপল্টনে একটি সমাবেশে দীর্ঘদিন পর ভার্চুয়াললি বক্তব্য দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সমাবেশের শেষ দিকে এসে বিএনপির মহাসচিব চমক আছে এমন কথা বলার পর পর্দায় আসেন তারেক রহমান। তখন উল্লাসে ফেটে পড়েন বিএনপির নেতাকর্মীরা।
সেই সমাবেশকে ঘিরে নেতাকর্মীদের উৎফুল্লতার কথা তুলে ধরে তখনকার কর্মস্থল একটি দৈনিকে মন্তব্য প্রতিবেদন লেখেন এহসান মাহমুদ। কথিত আছে এহসান মাহমুদ এরপর ওই পত্রিকা থেকে চাকরি হারান।
জানা গেছে, ওই পত্রিকার চাকরি হারানোর পর বিএনপির কারো কারো সুপারিশে আরেকটি দৈনিকে চাকরি পান এহসান মাহমুদ। কিন্তু সেখানেও নানা অপেশাদার আচরণের জন্য চাকরিচ্যুত হন তিনি।
এহসান মাহমুদ তার ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে নিজেকে বিএনপির বুদ্ধিভিত্তিক কাজে সহযোগিতা করেন বলে দাবি করে আসছেন। সবশেষ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময়ও আন্দোলনে থাকা ছাত্রদের পাশাপাশি বিএনপির হয়ে কাজ করেছেন এমনটা দাবি করছেন এহসান মাহমুদ। অবশ্য কবি-সাহিত্যিকদের সাথে একদিন প্রতিবাদ কর্মসূচি ছাড়া তাকে রাজপথে দেখার তথ্য কেউ দিতে পারছেন না।
এদিকে সম্প্রতি এহসানের আওয়ামী লীগ ও বামদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি সামনের এলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খোদ বিএনপির নেতাকর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। সাংবাদিকদের মধ্যেও অনেকে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এর প্রেক্ষিতে বিএনপির মহাসচিব তার পক্ষে সাফাই গেয়ে মঙ্গলবার রাতে বিবৃতি দিয়েছেন।
নিজের স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর লেখেন, ‘সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাংবাদিক ও লেখক এহসান মাহমুদকে নিয়ে মিথ্যাচার করা হচ্ছে। একটি মহল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই অপপ্রচার চালাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের পূর্বেও গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে, রাজপথে উপস্থিত থাকার পাশাপাশি সভা-সেমিনারের আয়োজনের উদ্যোক্তাও ছিল এহসান মাহমুদ। এহসান মাহমুদ জুলাই-আগস্টে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে লেখালেখি ও রাজপথে সোচ্চার ছিলেন। তার বিরুদ্ধে পরিকল্পিত এই প্রচারণার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।’
হঠাৎ করে এমন বিতর্কিত ব্যক্তির জন্য বিবৃতি দেয়ায় নেতাকর্মীরা অনেকে মহাসচিবের সমালোচনা করছেন।
(ঢাকাটাইমস/৩জুলাই/জেবি/মোআ)

মন্তব্য করুন