স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সঙ্গে বামা’র প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলের সাক্ষাৎ

স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের সঙ্গে ইউনানী আয়ুর্বেদিক হারবাল ও হোমিওপ্যাথিক সেক্টরের দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত সমস্যা ও সংকট তুলে ধরে আশু সমাধানকল্পে সাক্ষাৎ করেছেন বাংলাদেশ আয়ুর্বেদিক মেডিসিন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন বামা’র প্রেসিডেন্ট ও বাংলাদেশ ইউনানী মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ড. হাকীম মো. ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া’র নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ বোর্ড অব ইউনানী আয়ুর্বেদিক সিস্টেমস্ অব মেসিডিনের চেয়ারম্যান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মিসেস মল্লিকা খাতুন।
প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আয়ুর্বেদিক মেডিসিন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন বামা’র সাধারণ সম্পাদক ডা. মিজানুর রহমান, হাকীম হাবিবুর রহমান ইউনানী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ আ.খ. মাহবুবুর রহমান সাকী, হামদর্দ বাংলাদেশের পরিচালক তথ্য ও গণসংযোগ আমিরুল মোমেনীন মানিক, পরিচালক হামদর্দ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ব্রি.জে.(অব.) মাহবুব আনোয়ার ও হামদর্দ বাংলাদেশের আইন উপদেষ্টা, সাবেক সিনিয়র জেলা জজ মোহাম্মদ কাওসার।
এ সময় ড. হাকীম মো. ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া বিকল্প চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য স্বতন্ত্র কাউন্সিল গঠন, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউনানী আয়ুর্বেদিক ফ্যাকাল্টি পুনর্বহাল করার যৌক্তিকতা তুলে ধরাসহ ১২ দফা দাবি উপস্থাপন করেন।
বৈঠককালে নূরজাহান বেগম বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ইউনানী আয়ুর্বেদিক হারবাল ও হোমিওপ্যাথিক সেক্টরের সমস্যাগুলো সমাধানে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে। খুব শিগগিরই এই সেক্টরের সংকটগুলো নিরসন করতে কাউন্সিল গঠনসহ অন্যান্য ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।উত্থাপিত দাবি ও প্রস্তাবনাসমূহ:
০১.
১৯৮২ সালের ড্রাগ অর্ডিন্যান্সে প্রচলিত এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থার পাশাপাশি চিকিৎসা সেবা সহজলভ্য করার স্বার্থে ইউনানী আয়ুর্বেদিক হারবাল ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থাকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। এই অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে প্রচলিত এবং বিকল্প উভয় চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সমমর্যাদা প্রদান এবং গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু হতাশার বিষয় এই যে, গত ৪৩ বছরে ইউনানী আয়ুর্বেদিক হারবাল ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করা হয়নি। তাই অবিলম্বে জরুরি ভিত্তিতে বিকল্প চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের জোর দাবি জানাচ্ছি।০২. ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর যে প্রক্রিয়া ও বিধিবদ্ধ আইনী কাঠামোয় এ্যালোপ্যাথিক সেক্টরকে নিয়ন্ত্রণ করে, একই প্রক্রিয়ায় ইউনানী আয়ুর্বেদিক হারবাল ও হোমিওপ্যাথিক সেক্টরকেও তদারকি করে। এ্যালোপ্যাথিক সেক্টর, তাদের ওষুধসমূহ বিদেশে রপ্তানি করে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ পেলেও এক্ষেত্রে ইউনানী আয়ুর্বেদিক হারবাল ও হোমিওপ্যাথিক সেক্টর বৈষম্যের শিকার। স্বাধীনতার ৫৪ বছরে, ইউনানী আয়ুর্বেদিক হারবাল ও হোমিওপ্যাথিক ওষুধ, বিদেশে রপ্তানি করার ক্ষেত্রে জটিলতা দূর করা হয়নি। তাই যত দ্রুত সম্ভব সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করে ইউনানী আয়ুর্বেদিক হারবাল ও হোমিওপ্যাথিক ওষুধ বিদেশে রপ্তানির সুযোগ দেওয়া হলে, বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।
০৩. স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন বিকাশ অগ্রগতির জন্য প্রতি অর্থবছরেই প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করে। পাশাপাশি বিদেশি অনেক সংস্থাও মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অনুদান প্রদান করে থাকে। কিন্তু এসব অনুদান ও বরাদ্দকৃত অর্থের সামান্য অংশও ব্যয় করা হয়না ইউনানী আয়ুর্বেদিক হারবাল ও হোমিওপ্যাথিক সেক্টরের জন্য। এ ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে এই সেক্টর তার কাক্সিক্ষত সফলতায় পৌঁছতে পারছেনা। অতএব, মহোদয়ের কাছে জোর দাবি, প্রতি অর্থ বছরেই ইউনানী আয়ুর্বেদিক হারবাল ও হোমিওপ্যাথিক স্বাস্থ্য খাতে প্রয়োজনীয় অর্থ অনুদান হিসেবে বরাদ্দ করলে এই খাত অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
০৪. প্রতি বছরই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বরাদ্দ দিয়ে থাকে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইউনানী আয়ুর্বেদিক হারবাল ও হোমিওপ্যাথিক সেক্টরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নামমাত্র বরাদ্দ পায়। ফলে কাক্সিক্ষত গবেষণা, শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং প্রয়োজনীয় দক্ষ চিকিৎসক তৈরিতে পিছিয়ে পড়ছে অলটারনেটিভ মেডিসিন এডুকেশন সেক্টর। চলতি অর্থ বছরে বেশ কয়েকটি ইউনানী আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা মেডিকেল কলেজ গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে অনুদানের আবেদন করেছে। এ বিষয়ে আপনার ইতিবাচক সুদৃষ্টি প্রত্যাশা করছি।
০৫.
এ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা ব্যবস্থার তদারকি এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য বিএমডিসি থাকলেও বিকল্প চিকিৎসা খাতের জন্য কোনো কাউন্সিল নেই। সে কারণে ভয়াবহ অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে এই স্বাস্থ্য খাতটি। ইতোমধ্যে এ স্বাস্থ্য খাতের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ও স্বতন্ত্র কাউন্সিল গঠনের আবেদন করা হয়েছে। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অবিলম্বে কাউন্সিল গঠন করে ইউনানী আয়ুর্বেদিক হারবাল ও হোমিওপ্যাথিক সেক্টরের অগ্রগতি উন্নয়নে মাইলফলক দৃষ্টান্ত স্থাপনের উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।
০৬.
ভারতে বিকল্প চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আলাদা গুরুত্ব দিতেই আয়ূশ নামে মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বাংলাদেশেও এই খাতের অপরিহার্যতা ও প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় একটি পৃথক হারবাল মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরি বিষয়।
০৭.
ইউনানী আয়ুর্বেদিক হারবাল ও হোমিওপ্যাথিক সেক্টরের চিকিৎসকদের নৈতিকতা, চিকিৎসার মান্নোয়ন এবং প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে সমমর্যাদা দিতে অবিলম্বে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বিধি বা নীতি তৈরি করা, যা ভবিষ্যতে এই স্বাস্থ্য খাতের চিকিৎসকদের উন্নয়ন অগ্রগতি সাধনে এবং সঠিক ব্যবস্থাপনায় রাখতে নির্দেশনা হিসেবে কাজ করবে।
০৮.
প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে সরকারি উদ্যোগে নানামুখী গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু ইউনানী আয়ুর্বেদিক হারবাল ও হোমিওপ্যাথিক সেক্টরের জন্য সরকার পরিচালিত কোনো ইনস্টিটিউট নেই। এই স্বাস্থ্য খাতের জন্য স্বতন্ত্র ইনস্টিটিউট থাকলে অলটারনেটিভ মেডিসিনের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী অগ্রগতি হবে।
০৯.
উপমহাদেশের ভারত ও পাকিস্তানে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের পাশাপাশি শত শত বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউনানী আয়ুর্বেদিক হারবাল তথা বিকল্প চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থার বিকাশে স্বতন্ত্র ফ্যাকাল্টি রয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতিক্রমে এবং ইউজিসির সিলেবাস অনুমোদন সাপেক্ষে হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে ইউনানী আয়ুর্বেদিক ফ্যাকাল্টি চালু হয়। কিন্তু সম্পূর্ণ নিয়ম নীতি লঙ্ঘন করে ২০২৩ সালে উক্ত ফ্যাকাল্টিকে ইনস্টিটিউটের অধীনস্থ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়, যা উচ্চশিক্ষার বিকাশে ভয়াবহ অন্তরায়। অতএব, সরকার অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইউনানী আয়ুর্বেদিক ফ্যাকাল্টি চালুর পূর্বের নিয়ম বহাল রাখার জোর দাবি জানাচ্ছি।
১০.
ইউনানী আয়ুর্বেদিক হারবাল ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা শিক্ষাসেক্টরে বিপুল পরিমাণে শিক্ষক নিয়োগের বিধান থাকলেও নিয়োগ হচ্ছে সীমিত পরিসরে। তাছাড়া মানোন্নয়ন ও সুনির্দিষ্ট নিয়োগ বিধি এবং পদোন্নতির কোনো ব্যবস্থা না থাকায় নিয়োগকৃতরা পূর্ণাঙ্গ মেয়াদে চাকুরি করার পরও তাদেরকে অবসরে যেতে হচ্ছে লেকচারার বা প্রভাষক হিসেবে। এমনকি তাদেরকে বিদায় নিতে হয় শূন্য হাতে, যা অত্যন্ত দু:খজনক, অসঙ্গতিপূর্ণ এবং বৈষম্যমূলক। অবিলম্বে এরকম ভয়াবহ বৈষম্য দূর করার জোর দাবি জানাচ্ছি।
১১.
বর্তমানে ইউনানী আয়ুর্বেদিক হারবাল ও হোমিওপ্যাথিক স্বাস্থ্য শিক্ষাখাতের ভর্তি পরীক্ষা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়। উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদেরকে ভর্তির জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক সিটের বিপরীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সরকারী ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের জন্য একটি মেধাতালিকা প্রকাশ করে। এক্ষেত্রে বাকি উত্তীর্ণদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়না। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে সরকারি ১টি প্রতিষ্ঠান ব্যতিত বেসরকারী পর্যায়ে সরকারী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ কর্তৃক অধিভূক্ত আরও ৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক ব্যাচেলর কোর্স পরিচালিত হচ্ছে। অতএব, সরকারী ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পাশাপাশি ওই ৩টি প্রতিষ্ঠানের জন্যও মেধাতালিকা প্রকাশ করে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের তালিকাভূক্তির প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করা হলে, এই চিকিৎসা শিক্ষাখাত অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
১২.
দেশের প্রত্যেক জেলা উপজেলায় বিকল্প চিকিৎসা বিভাগ থাকলেও তা যথাযথভাবে চালু হয়নি। এখানে নিয়মিতভাবে ইউনানী আয়ুর্বেদিক হারবাল ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক নিয়োগও দেওয়া হচ্ছেনা। ফলে সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিকল্প চিকিৎসা বিভাগে ভয়াবহ স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। অবিলম্বে এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করে জেলা উপজেলা এবং প্রত্যেক ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে একজন করে ইউনানী আয়ুর্বেদিক বা হোমিও চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।(ঢাকা টাইমস/০৩জুলাই/এসএ)

মন্তব্য করুন