রোটা ভাইরাস এখনও শিশুর জন্য বড় হুমকি
এক বছরের শিশু সুবর্ণার ডায়রিয়া হয়েছিল ভেবে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। দু’দিন চিকিৎসা দেয়ার পর উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখে চিকিৎসকরা তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়।
কিন্তু বাসায় যাওয়ার পর ওই রাতেই সে আবারো ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয় এবং হাসপাতালে নেয়ার আগেই শিশুটি মারা যায়। তখন চিকিৎসকরা সুবর্ণার বাবা-মাকে জানান, রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে।
কেবল সুবর্ণা নয়, বাংলাদেশে প্রতিবছর বহু শিশু রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। রোটা ভাইরাস হল বিশ্বব্যাপী শিশু ও নবজাতকের মারাত্মক ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার অত্যন্ত সাধারণ একটি কারণ। যেসব শিশু এর উপযুক্ত চিকিৎসা পাচ্ছে তারা মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে। আর যেসব শিশু চিকিৎসা পাচ্ছে না তাদেরকে চরম পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে।
রোটা ভাইরাস অর্গানাইজেশন অব টেকনিক্যাল অ্যালাইজ (আরওটিএ) পরিষদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ২৪ লাখ শিশু রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। এসব শিশুর অধিকাংশের বয়স তিন মাস থেকে দু’বছরের মধ্যে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, ডায়রিয়াজনিত রোগের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে রোটা ভাইরাস। এ রোগে আক্রান্ত শিশুদের দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে না পারলে তাদের মৃত্যু হতে পারে।
ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডায়রিয়াল ডিজিজ রিসার্চ, বাংলাদেশ (আইডিডিআর,বি)’র সর্বশেষ গবেষণা প্রতিবেদনে একই কথা উল্লেখ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও এ রোগে প্রাণহানির বিষয়টি তুলে ধরেছে।
সোঁয়াচে রোগ নিয়ন্ত্রণ ইউনিটের লাইন ডিরেক্টর ডা. তানিয়া তাহমিনা বলেন, ‘রোটা ভাইরাস হচ্ছে নবজাতক ও শিশুদের ডায়রিয়াজনিত রোগ ও পানিশূন্যতা প্রধান কারণ। আক্রান্ত হওয়ার ২-৩ দিন পর সাধারণত এ রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত শিশুর মারাত্মক ডায়রিয়া, বমি বমি ভাব, জ্বর ও পেট ব্যাথা হয়। রোটা ভাইরাসের সুনির্দিষ্ট কোন চিকিৎসা না থাকলেও পানিশূন্যতা রোধে বারবার পানি খাওয়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়।’
রোটা ভাইরাস নিয়ে সর্বশেষ গবেষণায় আরো দেখা যায়, ডায়রিয়াজনিত কারণে হাসপাতালে ভর্তি পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এবং ৬ থেকে ১১ মাস বসয়সী শিশুর প্রায় ৫০ শতাংশ রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত।
ডা. তাহমিনা বলেন, ‘ডায়রিয়াজনিত অন্যান্য রোগের চেয়ে রোটা ভাইরাসের চিকিৎসা সম্পূর্ণ আলাদা। আবার রোটা ভাইরাস টিকার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা রয়েছে। ভাইরাসগুলোর প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটছে। এটি অন্যান্য ভাইরাসের তুলনায় অনেকটা আলাদা ধাচের। এ রোগ প্রতিরোধে এখন দু’টি নতুন রোটা ভাইরাস টিকা আছে। আমরা আশা করছি এ টিকা ইপিআই (টিকাদান সম্প্রসারণ কর্মসূচি)’তে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।’
ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিয়োলজি, ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চের (আইইডিসিআর)’র তথ্যানুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডায়রিয়াজনিত অন্যান্য রোগ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেলেও বাংলাদেশে রোটা ভাইরাসের হুমকি এখনো অনেক বেশি।
কর্মকর্তারা জানান, ২০১২ সাল থেকে সরকারি কর্মসূচির আওতায় দেশব্যাপী সাতটি বিশেষায়িত হাসপাতালে মূলত এ রোগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা দেয়া হয়। এসব হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ১৫১ শিশুর ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা যায়, ১২৪ শিশু (৮২ শতাংশ) রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত। এদের অধিকাংশের বয়স ৬ থেকে ১৭ মাস।
জরিপে আরও দেখা যায় যে বিশেষ কিছু এলাকায় রোটা ভাইরাসের হুমকি তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। যেমন- চট্টগ্রামের বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শিশুর ৯১ শতাংশই রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত। অপরদিকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে এ হার ছিল ৬২ শতাংশ।
এছাড়া কিশোরগঞ্জের জহিরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শিশুর মধ্যে রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে ৭৯ শতাংশ। জালালাবাদ রাগিব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং দিনাজপুর ল্যাম্ব হাসপাতালের প্রতিটিতে ভর্তি হওয়া শিশুর রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার হার ছিল ৮৬ শতাংশ। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এ হার ছিল যথাক্রমে ৮৩ ও ৭৬ শতাংশ।
তালিকাভুক্ত এসব সরকারি হাসপাতাল ছাড়াও দেশের অন্যান্য হাসপাতালে রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত শিশুর সন্ধান পাওয়া যায়। ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত চালানো এক জরিপে দেখা যায়, হাসপাতালে ভর্তি পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর ৬৭ শতাংশ রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত।
বর্তমানে রোটা ভাইরাস প্রতিরোধে রোটারিক্স ও রোটাটেক নামের দু’টি টিকা রয়েছে। বাজারে রোটাটেকের দাম প্রায় এক হাজার ৬শ’ থেকে এক হাজার ৮শ’ টাকা এবং রোটারিক্সের দাম এক হাজার ৮শ’ থেকে দুই হাজার টাকা।
এ প্রসঙ্গে আইইডিসিআরের পরিচালক ডা. মীরজাদি সাবরিনা ফ্লোরা বলেন, ‘ইপিআই কর্মসূচির আওতায় আগামী বছর থেকে সাশ্রয়ী দামে এর টিকা পাওয়া যাবে। রোটা ভাইরাস প্রতিরোধের ক্ষেত্রে এটা বাংলাদেশের জন্য একটি সুসংবাদ।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীতকালে শিশুদের রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। বস্তি ও গ্রামীণ এলাকার পাশাপাশি অভিজাত এলাকার অনেক শিশুর রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত হতে দেখা যাচ্ছে। সাধারণত এ ভাইরাস মুখ দিয়ে শিশুর শরীরে প্রবেশ করে থাকে এবং অন্ত্রে ছড়ায়। আক্রান্ত শিশুর মলে রোটা ভাইরাসের অনেক জীবাণু থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, নোংরা হাত এবং খেলনা ও ডায়াপারের মতে শিশুর নাগালে থাকা বিভিন্ন বস্তুর মাধ্যমে খুব সহজে রোটা ভাইরাস ছড়াতে পারে। -বাসস
(ঢাকাটাইমস/০৮নভেম্বর/জেবি)