বইঃ আমার কথা
‘আমার আদর্শ আমার নায়ক’
সৈয়দ আবুল হোসেন বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘আমার কথা’। এই বইয়ে তিনি নিজের চিন্তা, কর্মকান্ড, মূল্যবোধ, নানা অভিজ্ঞতা ও পরিকল্পনা সম্পর্কে লিখেছেন। এটি পড়লে তাকে যারা পুরোপুরি চিনেন না তাদের সুবিধা হবে। বইটি ‘ঢাকাটাইমস২৪ডটকম’ ধারাবাহিকভাবে ছাপছে। বইটির আজকের পর্বে থাকছে- ‘আমার আদর্শ আমার নায়ক’
আমি নিজে নিজেই ভাবি- আচ্ছা কখনও কি এমন হয়েছে যে নিজের অজান্তেই আমি কাউকে আমার আদর্শ ব্যক্তি বা নায়ক মনে করি? কেউ কেউ আমার কাছ থেকে জানতে চায়, কে আমার জীবনের নায়ক বা হিরো। উত্তরে আমি বলি, আমার অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন- আমাদের নবী হযরত মোহাম্মদ (স.)। নেতাদের মধ্যে যাঁরা আমাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রাণিত করেছেন, আমার জানা মতে, নিঃসন্দেহে তাঁরা হচ্ছেন, হযরত আবু বকর (রা.), হযরত ওসমান (রা.), হযরত ওমর ফারুক (রা.), হযরত আলী (রা.), জর্জ ওয়াশিংটন, আব্রাহাম লিংকন, মার্টিন লুথার কিং, নেলসন ম্যান্ডেলা, মহাত্মা গান্ধী, মাও সেতুং, কামাল আতাতুর্ক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ হাসিনা, আমার পিতা সৈয়দ আতাহার আলী এবং আমার আব্বা হুজুরপাক এনায়েতপুর দরবার শরিফের গদিনশিন হুজুরপাক হযরত খাজা কামাল উদ্দিন নুহ মিয়া। অধিকন্তু আরও অনেক নেতা-নেত্রী আছেন, যাঁরা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন, যাঁদের নিকট থেকে আমি শিখেছি অনেক কিছু এবং প্রতিনিয়ত শিখে যাচ্ছি।
ছোটবেলায় বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি মাদারীপুরে। তিনি মাঝে মাঝে মাদারীপুর যেতেন বেড়াতে এবং রাজনীতিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণ করতে। বঙ্গবন্ধু মাদারীপুর আসবেন সংবাদ পেলে ছুটে যেতাম সেখানে। দেখতাম তাঁর অঙ্গভঙ্গি, কথা, তর্জনীর ঊর্ধ্বমুখিনতা এবং উদার-বজ্রকণ্ঠের সাহসী বাণী। সবকিছু ছিল যেন স্বপ্নের মতো। অভিভূত হয়ে দেখতাম বঙ্গবন্ধুকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন বঙ্গবন্ধু-পরিবারের অনেকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ঢাকা থাকার সুবাদে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যবর্গকে আরও নিকট থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। এ শুধু সুযোগ নয়, বরং বিরল অভিজ্ঞতাও।
আমি অবাক বিস্ময়ে মুগ্ধচোখে চেয়ে থাকি সৌম্য, লম্বা, ঋজু ও অসম্ভব আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বময় চেহারার অধিকারী অবিংসবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের দিকে। তিনি ঢেউ-প্রবল নদী, আমরা সেই নদীর স্রোতস্বিনী পানি। প্রবল আবেগে সবাই ধেয়ে চলছে একমাত্র তাঁকে লক্ষ্য করে।বঙ্গবন্ধুকে দেখা- আমার জীবনের এক নাটকীয় ঘটনা, অবিস্মরণীয় মুহূর্তের কালজয়ী স্মৃতি। সেই ছোটবেলায়, মহান স্বাধীনতা অর্জনের অনেক আগে বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখি। দেখেছি মাদারীপুরের বিশাল এক জনসভায়। আমার বাবার হাত ধরে গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুকে দেখতে, দেশ-কাঁপানো নেতা বঙ্গবন্ধু, সবার প্রিয় মুজিব ভাইয়ের কথা শুনতে। সে জনসভায় অনেক নেতা বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তাঁরা তেমন মনোযোগ টানতে পারেনি, শিশু আমি, অত অনুধাবনেরও যোগ্যতা হয়নি। চারদিকে লোকজনের কথায় নেতাদের বক্তৃতা আরও অস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা দিতে আসছেন- ঘোষণা আসার সঙ্গে সঙ্গে চারদিক মুহূর্তের মধ্যে পিনপতন স্তব্ধতায় সুনসান হয়ে উঠল। হাজার হাজার শ্রোতার পিনপতন নিরবতায় বঙ্গবন্ধু ভাষণ শুরু করলেন। বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের অমিয়বাণী ছাড়া আর কোথাও কোনো শব্দ নেই। পৃথিবীতে এখন যেন একটাই শব্দ। বাকি সব স্তব্ধ। স্তব্ধ হয়ে গেছে পুরো প্রকৃতি, আকাশ, হাওয়া, পাখির কূজন; এমনকি পাতার মর্মর শব্দ পর্যন্ত থেমে গেছে। আমি অবাক বিস্ময়ে মুগ্ধচোখে চেয়ে থাকি সৌম্য, লম্বা, ঋজু ও অসম্ভব আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বময় চেহারার অধিকারী অবিংসবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের দিকে। তিনি ঢেউ-প্রবল নদী, আমরা সেই নদীর স্রোতস্বিনী পানি। প্রবল আবেগে সবাই ধেয়ে চলছে একমাত্র তাঁকে লক্ষ্য করে। একজন মানুষ কেবল বক্তৃতা দিয়ে কীভাবে মানুষকে বিমোহিত করে দিতে পারেন, সেদিন টের পেয়েছিলাম। মূলত সেদিনই বঙ্গবন্ধু আমার অন্তরে চিরদিনের জন্য চিরস্থায়ী হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁকে ছাড়া রাজনীতির ক্ষেত্রে আর কোনো বিকল্প ভাবতেও পারিনি, বাংলার মানুষও পারেনি। তিনি হয়ে ওঠেন আমার অবিসংবাদিত নেতা।
আমার সময়ের ভালো স্কুল-কলেজে পড়াশুনা করেছি আমি । কিন্তু জ্ঞান অর্জনের এমন কোনো প্রতিষ্ঠান পাইনি, যা অভিজ্ঞতা ও পরিবেশের চেয়ে বেশি জ্ঞান বিতরণ করতে সক্ষম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। সেখানে অনেক কিছুই শিখেছি। তবে জীবনের বড় একটা জিনিস শিখেছি রাজনীতি করতে এসে। ঘাত-প্রতিঘাত ও জীবনবোধের নানা অভিজ্ঞতায় রাজনীতি আমাকে বিরল অর্জনে সমৃদ্ধ করেছে। বিশ্ব-নেতৃবৃন্দের জীবনীপাঠ আমাকে দিয়েছে অফুরন্ত চিন্তার নিষ্ঠাবান প্রত্যয়, যাতে আমি সাঁতরে বেড়াচ্ছি এখনও।
আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন বাবার সঙ্গে বিভিন্ন সময় ভ্রমণে তাঁর সঙ্গী হতাম। সেখানেও অনেক স্মৃতি আছে। অনেক কিছুই শিখেছি বাবার কাছ থেকে। পিতা আমার যেমন ছিলেন ধার্মিক, তেমনি ছিলেন দূরদর্শী। তিনি ছিলেন সমাজসংস্কারক, বিচক্ষণ, উদার ও অসাম্প্রদায়িক। নিজের চেতনার সঙ্গে ধর্মীয় অনুভূতি এবং দেশীয় ঐতিহ্যের সমন্বয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন এক সম্পূর্ণ আলাদা জগৎ। এখানে মানুষে মানুষে ছিল না কোনো ভেদাভেদ, ধর্মের মাঝে পূর্ণ সমাহারে আমার পিতা সৈয়দ আতাহার আলী হয়ে উঠেছিলেন একজন পরিপূর্ণ মানুষ।
একটি অসাম্প্রদায়িক খাঁটি বাঙালি পরিবেশে আমি মানুষ হয়েছি এবং সে শিক্ষাই ধারণ করে চলেছি এখনও। সেই শিক্ষাই ধারণ করে চলব আমৃত্যু। ইসলামের শাশ্বত ঘোষণা, ‘হুব্বুল ওয়াতানে মিনাল ইমান’, অর্থাৎ দেশকে ভালবাসা ইমানের অঙ্গ। মহানবি (স.) ছিলেন দেশপ্রেমের অগ্রদূত। স্বদেশের প্রতি ভালবাসাকে চিরন্তন অঙ্গীকার হিসাবে ইসলামে দিঙ্নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ্পাক বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য স্বীকার করো এবং তোমাদের ন্যায়পরায়ণ শাসকের আদেশ মেনে চলো’।৫১ রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘দেশ রক্ষার্থে একদিন এক রাতের প্রহরা- ক্রমাগত এক মাসের নফল রোজা এবং সারা রাত ইবাদতে কাটিয়ে দেওয়ার চেয়ে উত্তম (মুসলিম শরিফ)।’ দেশের স্বাধীনতা রক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করে রাসুল (স.) আরও বলেছেন, যে চোখ দেশের সীমান্ত রক্ষায় বিনিদ্র থাকে, সে চোখকে জাহান্নাম স্পর্শ করবে না। প্রিয় ধর্ম ইসলামের আদর্শ, প্রিয় নবির নির্দেশনা, পিতার শিক্ষা এবং আজন্ম লালিত দেশপ্রেমবোধ আমাকে প্রণোদিত করেছিল, উদ্বুদ্ধ করেছিল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে।
এরপর আমি যখন রাজনীতিতে জড়ালাম, রাষ্ট্রপতি ও সরকারপ্রধানসহ সবার সঙ্গে আমার পরিচয় আরও ঘনিষ্ঠ হলো। সৌভাগ্য ঘটে তাঁদের সঙ্গে কাজ করার। এরপর মন্ত্রিসভায় যোগ দিই এবং রাষ্ট্রীয় কাজে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করি। বিভিন্ন সময় দেশ-বিদেশের বহু নেতার সঙ্গে ইউরোপ এবং আমেরিকার শহরগুলোতে সফরসঙ্গী হিসাবে ভ্রমণ করেছি। ভ্রমণে যাওয়ার ফলে, আমি গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয় শিখেছি, বৈচিত্র্যময় অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি এবং জীবনের সৌন্দর্য সম্পর্কে জানতে পেরেছি। জানতে পেরেছি জীবনের অন্ধকার দিক সম্পর্কেও। নেলসন মেন্ডেলার সঙ্গে পরিচয় ও তাঁর সঙ্গে আলাপ আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল জনপ্রেমে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার চেতনায়। ব্যবসা ও মন্ত্রীত্বের সুবাদে আমি পৃথিবীর বহুদেশ ঘুরেছি। নানাজাতের, পেশার লোকদের সাথে পরিচিত হয়েছি। সেদেশের সংস্কৃতি কাছ থেকে দেখেছি। কিন্তু আমার দেশের মতো প্রাণচাঞ্চল্য আর কোথাও দেখিনি। যত বেশী দেশ ঘুরেছি- নিজের দেশের প্রতি মমত্ববোধ ও ভালবাসা শতগুণে বেড়েছে।দেশে-বিদেশের এসব ভ্রমণ আমার জন্য ছিল শিক্ষার ক্লাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ- যেখান থেকে জীবন-ব্যবস্থা, জীবন-পরিচালনা পদ্ধতি, নেতৃত্ব দেওয়ার কৌশল এবং প্রশাসন পরিচালনা সম্পর্কে অনেক বিষয় অবগত হয়েছি। আমি শিখেছি শুধু অধ্যয়ন বা আনুষ্ঠানিক আলোচনার মাধ্যমে নয়, প্রশ্নের মাধ্যমে কথায় কথায় উদাহরণ দিয়ে কীভাবে জানার পরিধিকে ঋদ্ধ করতে হয়। আমি প্রায়ই পর্যবেক্ষণ করতাম বিশ্ব-নেতৃবৃন্দের কাজ, দৃষ্টিভঙ্গি, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব এবং কীভাবে মানুষের সঙ্গে আচরণ করতে হয়। তাঁদের কাছ থেকে আমি শিখেছি কীভাবে সামলাতে হয় ব্যস্ত সময়সূচি। পিতা আমার যেমন ছিলেন ধার্মিক তেমনি ছিলেন দূরদর্শী। তিনি ছিলেন সমাজসংস্কারক, বিচক্ষণ, উদার ও অসাম্প্রদায়িক। নিজের চেতনার সঙ্গে ধর্মীয় অনুভূতি এবং দেশীয় ঐতিহ্যের সমন্বয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন এক সম্পূর্ণ আলাদা জগৎ। এখানে মানুষে মানুষে ছিল না কোনো ভেদাভেদ, ধর্মের মাঝে পূর্ণ সমাহারে আমার পিতা সৈয়দ আতাহার আলী হয়ে উঠেছিলেন একজন পরিপূর্ণ মানুষ।
আমার শ্রেষ্ঠ নেতা ও শ্রেষ্ঠ আদর্শ মহানবি (সা.)। তাঁর জীবনী পড়ে যতটুকু জেনেছি, তিনি সবসময় ইসলামি পদ্ধতিতে সমস্যা মোকাবিলা করতেন। বিচক্ষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন অবস্থা সামলে নিতেন। তিনি অত্যন্ত হার্দিকভাবে তাঁর সাহাবা, অনুসারী ও বিরোধীদের পরিচালনা করতেন। তিনি ছিলেন উচ্চমর্যাদাশীল, নীতিবান এবং চরিত্রবান। এ প্রসঙ্গে ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মহানবি (সা.)-সৃষ্ট ‘মদিনা সনদে’র কথা উল্লেখ করা যায়। মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরী ‘মানব মুকুট’ গ্রন্থের প্রস্তাবনায় লিখেছেন, “যে সকল মহাপুরুষের আবির্ভাবে এই পাপ-পঙ্কিল পৃথিবী ধন্য হইয়াছে, যাহাদিগের প্রেমের অমৃত সেচনে, দুঃখতপ্ত মানবচিত্ত স্নিগ্ধ হইয়াছে, যাহারা মানবসমাজের যুগ-যুগান্তরের কুক্ষিগত কালিমা রশ্মির মধ্য হইতে সূর্যের ন্যায় উত্থিত হইয়া পাপের কুহক ভাঙিয়াছেন, ধর্মের নবীন কিরণ জ্বালাইয়াছেন ও পতিত মানবকে সত্য ও প্রেমে সঞ্জীবিত করিয়া নবীন জীবন পথে টানিয়া লইয়া গিয়াছেন, ইসলাম ধর্মের প্রচারক হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁহাদের অন্যতম।”৫২ শুধু তাই নয়, তিনি ছিলেন বিশ্বের মহান রাষ্ট্রনায়ক। ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২২ অথবা ২৪ সেপ্টেম্বর (১২ রবিউল আউয়াল) মদিনা সনদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি পৃথিবির প্রথম কার্যকর লিখিত সংবিধান প্রতিষ্ঠা করে নিজেকে শ্রেষ্ঠতম রাষ্ট্রনায়কের চিরন্তন আসনে অধিষ্ঠিত করে গিয়েছেন।৫৩ এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হলো জনগণের সম্মতিভিত্তিক, কল্যাণমুখী গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্র। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক শক্তির যে সকল দেশ তাঁর বিরোধিতা করছিল সবাই তার বিচক্ষণতার কাছে নত স্বীকার করতে বাধ্য হয়। তিনি পুরো বিশ্ব-পরিবেশটাই নিজের অনুকূলে নিয়ে এসেছিলেন। মদিনা সনদ এবং মহানবির রাষ্ট্রনায়কোচিত শ্রেষ্ঠতম সিদ্ধান্তগুলো আমাকে সরকারে থাকাকালীন সিদ্ধান্ত গ্রহণে নির্দেশনা দিয়েছে নানাভাবে। তাই আমি কোনো অপশক্তির কাছে নতি স্বীকার না করে দেশের কল্যাণে কাজ করেছি সর্বোচ্চ সততায়।
সরকারে থাকাকালীন আমি রাষ্ট্রীয় অর্থ-ব্যবস্থাপনায় সর্বদা খলিফা ওমরের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছি। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা বলা যায়। খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রা.) [৫৭৭-৬৪৪ খ্রিস্টাব্দ] রাতে মোমবাতি জ্বালিয়ে কোষাগারের হিসাব করছিলেন। এ সময় তাঁর দুই ঘনিষ্ঠ আত্মীয় কক্ষে প্রবেশ করল। তাঁরা প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে খলিফা মোমবাতি নিভিয়ে অন্য আরেকটা মোমবাতি জ্বালিয়ে আত্মীয়দের স্বাগত জানালেন। কা- দেখে দুই আত্মীয়ের একজন মোমবাতি জ্বালানো-নিভানোর কারণ জানতে চাইলে হযরত ওমর (রা.) বললেন, “তোমরা ঘরে প্রবেশের পূর্বে আমি রাষ্ট্রের কাজ করছিলাম, তাই রাজকোষ থেকে প্রাপ্ত মোমবাতি জ্বালানো আমার জন্য জায়েজ ছিল, কিন্তু তোমরা যখন ঘরে প্রবেশ করলে তখন তোমাদের সঙ্গে আলাপে ওই মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখা আমার জন্য জায়েজ হতো না। তাই ঐ মোমবাতি নিভিয়ে আমি ব্যক্তিগত রোজগারে অর্জিত মোমবাতি জ্বালিয়েছি।” সরকারে থাকাকালীন আমি ব্যক্তিগত কাজে কখনও সরকারি যান ব্যবহার করিনি, কখনও সরকারি অর্থে নিজের কাজে বিদেশ ভ্রমণ করিনি। পরোক্ষভাবেও যদি কোনো কাজে ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িত থাকত, তো সে কাজে আমি কখনও রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যবহার করতাম না।
দারিদ্র্য বিমোচনে আমি নিজেকে নিয়োজিত রাখার চেষ্টা করেছি। এ ব্যাপারে ইসলামের চার খলিফাসহ আধুনিক বিশ্বনেতৃবৃন্দের কর্মকা- আমাকে প্রেরণা দিয়েছে। শিক্ষার মাধ্যমে আমি দারিদ্র্যবিমোচনের মূলোৎপাটনের চেষ্টায় আমার এলাকাসহ সারা দেশে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছি। নানাভাবে নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তা করেছি এবং করে যাচ্ছি। আমার মনে পড়ে ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রা.)-এর জীবনের একটি ঘটনা। আবু বকর সিদ্দিক (রা.) মদিনার বাইরে একটি তাঁবুতে যেতেন। তিনি তাঁবুতে প্রবেশ করে সেখানে কিছু সময় কাটাতেন। আবু বকর (রা.)-এর মৃত্যুর পর হযরত ওমর (রা.) ওই লোকটিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করলেন। তাঁবুতে গিয়ে তিনি অন্ধপ্রায় এক বৃদ্ধা মহিলাকে দেখতে পেলেন। ওমর (রা.) বৃদ্ধার কাছে লোকটি সম্পর্কে জানতে চাইলেন। বৃদ্ধা বললেন, ‘আমি এক অসহায় বৃদ্ধা। আমার কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। আমি আমার ভেড়া নিয়ে একা এ তাঁবুতে থাকি। প্রতিদিন মদিনা থেকে একজন লোক এসে আমার তাঁবু ঝাড়ু দিয়ে দিতেন, খাবার রান্না করে দিতেন, ভেড়া থেকে দুধ দোহন করে দিতেন এবং সেগুলোর যত্ন নিতেন। তারপর চলে যেতেন। তাঁর পরিচর্যা ছাড়া এতদিন আমার পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব ছিল না।’ ওমর (রা.) প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কি জানেন উনি কে ছিলেন?’ বৃদ্ধা বললেন, “না। তিনি কখনও আমার কাছে নিজের পরিচয় দেননি।” ওমর (রা.) বললেন, “তিনি ছিলেন খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.)।”
তাঁরাই আমার আদর্শ যাঁরা বিশ্বের কল্যাণে নিবেদিত। তাঁরাই আমার নায়ক যাঁরা সাধারণ মানুষের কল্যাণে সর্বদা নিজেদের উৎসর্গিত করার আনন্দে উন্মুখ হয়ে থাকতেন। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত আমার পিতা আমাকে এমন বোধে উদ্বুদ্ধ করেছেন- যাতে আমি সাধারণ মানুষের কল্যাণে সবসময় প্রস্তুত থাকি ও কাজ করি। তিনি আমাকে ইসলামি মূল্যবোধের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধের ধারণা দিয়েছেন। আমার জীবনবোধ, চিন্তা-চেতনা ও সাফল্যের জন্য আমি তাঁদের সবার কাছে ঋণী। মুলত আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যবস্তু ঠিক করে কাজ করতে হয়। আদর্শ ও লক্ষ্যবস্তু ঠিক করে কাজ করলে- সে কাজে সফলতা আসে।
আগামীকাল কাল থাকছে - “সময় শ্রম ও অধ্যবসায়” আরও পড়ুন - ‘ধৈর্য পরীক্ষা’, ‘খেলাধুলা ও বাংলাদেশ’ ‘অধ্যয়ন, লেখালেখি ও নেতৃত্ব’ ‘নারীর ক্ষমতায়ন ও বাংলাদেশ’, ‘সাফল্যের স্বর্ণদ্বার’ , ‘ঐক্যবদ্ধ শক্তি সাফল্যের মেরুদণ্ড’ ‘পদ্মা সেতু’, `বিজয়চিহ্ন 'V' প্রকাশে ভিন্নতা', ‘উন্নয়ন ও অগ্রাধিকার’ , ‘ইতিবাচক ভাবনা সাফল্যের চাবিকাঠি’ , ‘ভবিষ্যতের সরকার কেমন হবে’ ‘মাতৃভাষার প্রতি মমতা’, ‘সুখ ও শান্তি : আমাদের করণীয়’ , ‘নেতৃত্বের শক্তি’, ‘আদর্শ জীবন গঠনে মূল্যবোধ’, ‘আমার প্রাত্যহিক জীবন’, 'আমার অনুভব'।
মন্তব্য করুন