শিক্ষায় উন্নতির পথেই দেশ

মো. মশিয়ার রহমান
| আপডেট : ২১ জানুয়ারি ২০১৭, ১৮:২৯ | প্রকাশিত : ২১ জানুয়ারি ২০১৭, ১৮:২০

২০০৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ৬ জানুয়ারি সরকার গঠন করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন শেষে গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক ধারা অক্ষুণ্ন রাখার লক্ষ্যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নিরষ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর ১২ জানুয়ারি টানা দ্বিতীয় দফা সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।

১৯৯৬ সালের হিসেব ধরলে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর ও নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন জাতিগঠনে পুরা শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করে সরকার। শিক্ষাক্ষেত্রে দীর্ঘ দিনের জঞ্জাল দূর করতে থাকে ধারাবাহিকভাবে। অন্যক্ষেত্রে সফলতার পাশাপাশি শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক সফলতা পায় সরকার। শিক্ষাক্ষেত্রের উল্লেখযোগ্য সাফল্য ও যেসব প্রশংসনীয় উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়েছে তা নিম্নে দেয়া হল:

১) শিক্ষা খাতে বাজেট: মানব সম্পদ ও শিক্ষা নিশ্চিত করতে সুযোগের পাশাপাশি সম্পদের প্রয়োজন। ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে সরকার জাতীয় বাজেটের ১৫ দশমিক ৬৭ শতাংশর বরাদ্দ দিয়েছে শিক্ষাখাতে। টাকার অঙ্কে যা আগের বছরের তুলনায় বেড়ে দাড়িঁয়েছে ১১ হাজার ৯ শত ৮ কোটি টাকা।

২) বিনামূল্যে বই বিতরণ: ২০১০ সাল থেকে বছরের প্রথম দিন (১ জানুয়ারি) শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়ার মহতী উদ্যোগ গ্রহণ করে সরকার। শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের সাফল্যের বড় একটি দিক। এর ফলে এখন আর কোন শিক্ষার্থী মাঝপথে ঝরে পড়ছে না। দরিদ্র পরিবারের সন্তানেরাও পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারছে। এ উদ্যোগ নি: সন্দেহে প্রশংসনীয়। এ বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থীর হাতে ২৯১ টি বইয়ের ৩৬ কোটি ২১ লাখ ৮২ হাজার ২৪৫ কপি পাঠ্যবই বিতরণ করে সরকার। প্রথমবারের মতো দেশের তিনটি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর হাতে তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় বই দেয়া হয়। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের দেয়া হচ্ছে ব্রেইল পদ্ধতির বই এবং প্রথমবারের মতো সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির জটিলতা নিরসনে শিক্ষকদের গাইডলাইন সরবরাহ করা হচ্ছে। দেওয়া হবে প্রাথমিক শিক্ষদের জন্য ৬০ লাখ ১২৪ টি ও মাধ্যমিকের শিক্ষকদের জন্য ৪৬ লাখ ৬৬ হাজার ৬৬৪ টি গাইড বই। এ ধরনের কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করতে গেলে ভুল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এ বছর কিছু অনাকাক্সিক্ষত ভুল হয়েছে; যা কোনভাবে কাম্য নয়। আশা করি সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এ ধরনের ভুলত্রুটি সংশোধন করে এ মহতী উদ্যোগ সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

৩) শিক্ষানীতি প্রণয়ন: মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়, তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর ও নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন জাতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০১০ সালে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০’ প্রণয়ন করে সরকার। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৪০ বছরে বাংলাদেশের কোন স্থায়ী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় শিক্ষামন্ত্রণালয়ের সহায়তায় জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন করতে সক্ষম হয় সরকার। জাতীয় শিক্ষানীতি- ২০১০এর আলোকে সরকার শিক্ষা আইন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনে কোচিংকে ছায়া শিক্ষা হিসেবে ও নোট গাইড বইকে অনুশীলন বই হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব থাকায় দেশের শিক্ষাবিদরা উদ্বিগ্ন। বিতর্কিত ধারাগুলো বাদ দিয়ে একটি আধুনিক ও সময়োপযোগী শিক্ষা আইন প্রণয়ন করবে- এটাই দেশবাসীর প্রতাশা।

৪) পিইসি ও জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা চালু: পরীক্ষা ভীতি দূর, স্বীকৃতি প্রদান ও সকলকে সমান গুরুত্ব প্রদানের লক্ষ্যে- ২০০৯ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও ২০১০ সালে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা চালু করে সরকার। এর আগে বিশেষ শিক্ষার্থীদেরকে বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ প্রদান করা হত। ফলে সকল শিক্ষার্থীদের প্রতি সমান গুরুত্ব সম্ভব হত না। তাছাড়া বৃত্তির সংখ্যাও বাড়িয়ে দেয় সরকার।

৫) বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ: স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ ঘোষণা করেন। এর ধারাবাহিকতায় ১০ জানুয়ারি ২০১৩ বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেসরকারি ২৫ হাজার ২ শত ৪০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করে। ফলে প্রায় ১ লাখ শিক্ষকের চাকুরী রাজস্ব খাতে নেয়া হয়।

৬) বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস: ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস করার মাধ্যমে দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। আইনের দুর্বলতার কারণে নানা অনিয়ম, সনদ বাণিজ্য, আউটডোর ক্যাম্পাস চালু, ভাড়া বাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা, শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ইত্যাদি কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমালোচনার মুখে পড়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০১০ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়ন করে সরকার। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ৩৮ ধারা বলে সকল সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান যাচাইয়ের জন্য অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করে সরকার। ইতোমধ্যে এটি মন্ত্রীসভায় অনুমোদিত হয়েছে। আশা করি শিগগিরই এটি জাতীয় সংসদে পাস হবে। এর ফলে উচ্চ শিক্ষায় শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। সনদ বাণিজ্যের অন্যতম কারিগর দারুল ইহ্সান বিশ্ববিদ্যালয়কে বন্ধ করে দিয়ে সকল মহলের প্রশংসা কুড়িয়েছে সরকার।

৭) শিক্ষা নীতির আলোকে কারিকুলাম প্রণয়ন: জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর নির্দেশনার আলোকে ২০১২ সালের জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে ৯-১০ শ্রেণির শিক্ষাক্রম পরিমার্জন ও উন্নয়ন এবং সে অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করে।

৮) বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ: দীর্ঘ দিন ধরে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ করা হত ম্যানেজিং/গর্ভনিং বডির মাধ্যমে। এর ফলে শিক্ষক নিয়োগে দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি, টাকার বিনিময় নিয়োগ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সমালোচনা চলে আসছিল অনেক দিন ধরে। ফলে মেধাবীরা এই পেশায় আসতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ২০১৫ সালে NTRCA এর মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের পরিকল্পনা গ্রহণ করে সরকার। ইতোমধ্যে ১৫ হাজার শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়েছে। এটি সর্বমহলে প্রশংসিত হয়।

৯) ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা: বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষক-শিক্ষার্থী, আলেম ও পীর মাশায়েখদের দীর্ঘ দিনের দাবী ছিল দেশে ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যলয় প্রতিষ্ঠা করা। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ২০১৩ সালে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ কর্তৃক ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১৩ বিল আকারে জাতীয় সংসদে উথাপিত হয়। অতঃপর ২৫ শে সেপ্টেম্বর ২০১৩ খ্রি. তারিখ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতীয় সংসদে এ বিল পাস হয়। ২০১৩ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রম শুরু করে।

১০) মাদ্রাসা শিক্ষায় আধুনিকায়ন: সরকার মাদ্রাসায় ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষায় জ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষাকে সম্পৃক্ত করেছে। সাধারণ শিক্ষার অনুরুপ মাদ্রাসা শিক্ষায় বিজ্ঞান শাখা ও তথ্য-প্রযুক্তি বিষয় চালু করা হয়। মাদ্রাসা শিক্ষায় বিদ্যমান সমস্যা সমাধান ও আধুনিকায়নে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। মাদ্রাসা শিক্ষা পরিচালনা করার জন্য সরকার ২০১৫ সালে মাদ্রাসা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করে। এছাড়া দেশের ৫২টি মাদ্রাসায় বিভিন্ন বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু করা হয়েছে।

১১) তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয় আবশ্যিক করা: বর্তমান যুগ তথ্য-প্রযুক্তির যুগ। তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর জাতি গঠনে তথ্য প্রযুক্তি শিক্ষার বিকল্প নেই। তাই ২০১২ সালে ৬ষ্ঠ শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীকে তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয় বাধ্যতামূলক করা হয়। এছাড়া ক্যারিয়ার সচেতন ও আত্মনির্ভরশীল জাতি গঠনের জন্য ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত জীবন ও কর্মমূখী শিক্ষা, নবম-দশম শ্রেণিতে ক্যারিয়ার শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়।

১২। পাঠ্যবইয়ের ইতিহাস বিকৃতি রোধ: বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে পাঠ্যবইয়ের ইতিহাস বিকৃতি হয়েছে। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্নভাবে ভুল ইতিহাস জেনে আসছিল। পাঠ্যবইয়ে ইতিহাস বিকৃতি প্রতিরোধে প্রতিথযশা ইতিহাসবিদদের নিয়ে সংশোধন করে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সংযোজন করে সরকার। ফলে বর্তমান প্রজন্ম স্বাধীনতা সংগ্রাম ও জাতীয় বীরদের ইতিহাস জানতে পারছে।

এছাড়াও নতুন MPO নীতিমালা জারি, প্রত্যেক উপজেলায় ১টি করে স্কুল ও কলেজ সরকারিকরণ, শিক্ষকদের কোচিং নীতিমালা প্রণয়ন, ৬০ দিনে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ, উচ্চ শিক্ষায় সেশনজটমুক্ত করার কার্যকরী উদ্যোগ, সরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদাদান ছিল বর্তমান সরকারের উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।

বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে সমস্যা থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সমস্যা মোকাবেলা করে অব্যাহতভাবে এ কাজ চলতে থাকলে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ শুধু মধ্যম আয়ের দেশ হবে না, শিক্ষার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ একটি মধ্যম সারির দেশ বলে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করবে।

মো. মশিয়ার রহমান : শিক্ষক

সংবাদটি শেয়ার করুন

শিক্ষা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিক্ষা এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :