বয়লার বিস্ফোরণ: দিনাজপুরের চেহেলগাজীতে শোকের মাতম

শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর
 | প্রকাশিত : ২৭ এপ্রিল ২০১৭, ২০:১৯

দিনাজপুর সদর উপজেলার চেহেলগাজী ইউনিয়নের উত্তর ভাবনীপুর ও আশেপাশের গ্রামগুলোতে চলছে শোকের মাতম। শেষ নেই আহাজারির। প্রতিদিন কোনো না কোনো বাড়িতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে কুলখানি। পাশাপাশি চলছে দাফন কাজও।

দিনাজপুরে বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনায় অগ্নিদগ্ধদের মধ্যে বুধবার পর্যন্ত ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন বাড়ছে চিকিৎসাধীন দগ্ধদের মৃতের সংখ্যা।

সর্বশেষ বুধবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে এনামুল হক মারা যান। মঙ্গরবার রাত সাড়ে ১১টায় মারা যান মাজেদুল ইসলাম।

সোমবার সকালে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মনোরঞ্জন রায়ের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৫ জনে দাঁড়ালো।

এর আগে ১৯ এপ্রিল বিকাল ৫টায় অঞ্জনা দেবী নামে এক নারীসহ ওই দিন রাত ৮টার দিকে মোকছেদ আলীর, ২০ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আরিফুল হক এবং ২২ এপ্রিল সকাল সাড়ে ১০টায় রুস্তম আলীর মৃত্যু হয়। পরে ওই দিন অটোমেটিক রাইস মিলের ম্যানেজার রনজিৎ বসাককে এবং দেলোয়ার হোসেনকে শনিবার সন্ধ্যায় উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার রাত ১টার দিকে রনজিৎ এবং শুক্রবার বেলা দেড়টার দিকে দেলোয়ার মারা যান। এছাড়াও রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার ভোরে শফিকুল ইসলাম এবং রবিবার দুপুর ১২টার দিকে উদয় চন্দ্র, ২টার দিকে দুলাল চন্দ্র, রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে মুকুল ও সাড়ে ৭টার দিকে মুন্না রমেকের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এবং রিপন সাড়ে ৬টায় দিনাজপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

নিহতদের মধ্যে মোকছেদ, রুস্তম ও দেলোয়ার আপন ভাই। তাদের আরেক ভাই বাদলও দগ্ধ হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। ওই চার ভাই দিনাজপুরের ভবানীপুর গ্রামের জহির উদ্দীনের ছেলে।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. মারুফুল ইসলাম দুর্ঘটনায় ১৫ জনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চত করেছেন।

গত ১৯ এপ্রিল দুপুর সাড়ে ১২টায় দিনাজপুরের সদর উপজেলায় গোপালগঞ্জের শেখহাস্থ যমুনা অটোমেটিক রাইস মিলের বয়লার বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ২৮ জন শ্রমিক আহত হন।

এ ঘটনার পর দিনাজপুর সদর উপজেলার চেহেলগাজী ইউনিয়নের উত্তর ভাবনীপুর ও আশেপাশের গ্রামগুলোতে চলছে শোকের মাতম আর আহাজারি। প্রতিদিন কোনো না কোনো বাড়িতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে কুলখানি। পাশাপাশি চলছে দাফন কাজও।

সরেজমিনে সদর উপজেলার ভবানীপুর গ্রামে দেখা গেছে, মৃত্যুবরণ করছে এমন পরিবারের সদস্যদের ভবিষ্যত নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছে তাদের স্বজনরা। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে নির্বাক তারা। এখনো বেঁচে থাকা মানুষগুলোর চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার দাবি স্বজনদের।

মারা যাওয়া রুস্তম আলীর ছেলে সেলিম হোসেন জানান, তাদের সম্পূর্ণ পরিবারটিই তার বাবার ওপর নির্ভর ছিল। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে এখন চোখে মুখে অন্ধকার দেখছেন তারা। পাশাপাশি পরিবারের অতি আপনজনকে হারানোর শোক কোনোভাবেই ভুলতে পারছেন না তারা। একই অবস্থা মকছেদ আলীসহ অন্যন্য নিহত পরিবারের।

সদর উপজেলার যেসব গ্রামের লোকজন আহত অবস্থায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে, সেসব গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, তাদের স্বজনেরা রয়েছেন উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায়। কখন যে কার মুত্যুর খবর আসে-এ নিয়ে তারা নির্ঘুম সময় কাটাচ্ছেন। পাশাপাশি কোন বাড়িতে চলছে কুলখানি। আবার কোনো কোনো বাড়িতে চলছে লাশ দাফনের প্রস্তুতি।

এসব গ্রামে হতাহতদের বাড়িতে গিয়ে অভিযোগে জানা গেছে, মিল মালিকের প্রতি তারা বেশ ক্ষুব্ধ। যেই রাইস মিলে কাজ করতে গিয়ে তাদের এমন পরিণতির শিকার হতে হয়েছে, সেই মিল মালিক সুবল ঘোষ তাদের কোনো খোঁজ-খবরই নিচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন তারা।

নিহত মোকছেদ আলীর ছেলে মতিউর রহমান জানান, ক্ষতিপূরণ বা সাহায্য তো দূরের কথা-তাদের শোকাহত পরিবারের একটিবারও খবর নেননি মিল মালিক। অথচ ত্রুটিপূর্ণ ও জরাজীর্ণ মিলে কাজ করিয়ে তার বাবার প্রাণটি কেড়ে নিয়েছে মিল মালিক সুবল ঘোষ।

আহত শহীদুলের স্ত্রী পারভীন বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানালেন, তার স্বামী শ্রমিক হওয়ায় ন্যুনতম চিকিৎসার ব্যবস্থা করেননি মিল মালিক। তবে চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য তিনি স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান বাদশা ও প্রশাসনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।

দিনাজপুর জেলা চাতাল শ্রমিক ইউনিয়নের আহ্বায়ক সাইফুর রাজ চৌধুরী জানান, ত্রুটিপূর্ণ বয়লারের বিষয়ে মিল মালিকদের বারবার অভিযোগ করা হলেও তারা তাতে কর্ণপাত করেননি। এ জন্য দায়ী মিল মালিকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করে তাকে গ্রেপ্তারের দাবি জানান এই চাতাল শ্রমিক নেতা।

পাশাপাশি তিনি ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ বৃদ্ধির দাবি জানান। সেই সাথে এ জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্তের পাশাপাশি শ্রমিক হত্যাকারী সুবল ঘোষকে অবিলম্বে আইনের আওতায় নিয়ে আসার দাবি জানান তিনি।

দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক মীর খায়রুল আলম জানান, হতাহতদের পরিবারকে তাৎক্ষণিক কিছু আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়েছে। এছাড়া এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সহায়তা চাওয়া হবে বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, দিনাজপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে গঠিত ৬ সদস্যের তদন্ত কমিটি ঘটনা তদন্তে কাজ করছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্টের পর পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।

(ঢাকাটাইমস/২৭এপ্রিল/নিজস্ব প্রতিবেদক/এলএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :