আওয়ামী লীগ ছাড়া কি আসলে কোনো বিকল্প আছে?
আমাদের যাদের জন্ম ১৯৮০ এর দশকে তারা এখন বাংলাদেশকে কীভাবে দেখছেন। যদিও আমাদের সমবয়সী অনেকেই বাংলাদেশে কিছু হবেনা ভেবে, বা চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে পরদেশে পাড়ি দিয়েছেন, আমরা যারা আছি তাদের কী ভাবনা? ছোটবেলার বাংলাদেশ আর বর্তমানের বাংলাদেশ এর মধ্যে কি কোনো পার্থক্য তৈরি হয়েছে? অর্থনৈতিক উন্নয়ন আর রাজনৈতিক সংস্কৃতির মানদণ্ডে বাংলাদেশ কি কোনো পরিবর্তন অর্জন করেছে? সামনে ২০১৯ সালের নির্বাচন। দীর্ঘদিন হল ক্ষমতায় নেই বিএনপি আর যুদ্ধাপরাধীদের দল জামাত। বিএনপি-জামাত তো বটেই, সুশীল বলে পরিচিত দেশের শিক্ষিত মানুষের একটা অংশ চায়, দেশের শাসন কাঠামোর পরিবর্তন আসুক। দেশের মানুষ কী চায়? ধরা যাক, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে গিয়ে বিরোধী দলে চলে গেল, ক্ষমতায় আসল খালেদা জিয়ার দল বিএনপি আর যুদ্ধাপরাধী জামাত। তাহলে কি কী অবস্থা হবে দেশের? যারা বিএনপি-জামাত করেন তারাও প্রশ্নগুলো খেয়াল করবেন।
২০০৮ সালের নির্বাচন ছিল এরশাদ শাসনামল-উত্তর ‘গণতান্ত্রিক’ বাংলাদেশের জন্য এক অগ্নিপরীক্ষা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুগত প্রধান বানাতে গিয়ে বিএনপি-জামাত সরকারের হঠকারী নানা সিদ্ধান্ত আর তৎকালীন বিরোধী শক্তি আওয়ামী লীগ এর কঠোর আন্দোলনে রাষ্ট্রীয় অচলাবস্থা তৈরি হলে দৃশ্যপটে সরাসরি হাজির হয় সামরিক শক্তি। ইয়াজউদ্দিন সরকারকে হটিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতায় বসানো হয় বিশ্বব্যাংকের একসময়কার কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দিন আহমেদকে। ইতিহাসে এই সরকার সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলে লিপিবদ্ধ থাকবে। সেনাবাহিনী তখন ক্ষমতায় না থেকেও ছিল।
তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ এর তৎপরতা আমাদেরকে একজন সেনাশাসকের কথাই মনে করিয়ে দিত বারবার। রাজনৈতিক দলসমূহের উপর বীতশ্রদ্ধ সাধারণ মানুষ প্রথম দিকে এই সামরিক বাহিনীর মদদপুষ্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ওয়েলকাম জানালেও পরে বুঝতে পারে, অগণতান্ত্রিক সরকার দিয়ে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। পরের ইতিহাস সকলের জানা। প্রায় ১.২১ কোটি ভুয়া ভোটার বাদ দিয়ে যে ছবিসহ ভোটার তালিকা হয়, তার ভিত্তিতে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে ক্ষমতায় আসে।
শুরুতেই ২০০৯ সালের ২৫ এবং ২৬ ফেব্রুয়ারির বিডিআর ট্র্যাজেডি। সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগকে শুরুতেই ব্যাকফুটে ঠেলে দেওয়ার জন্য যে বিডিয়ার বিদ্রোহ ঘটানো হয়েছিল সেটি এখন বলাই বাহুল্য। ভয়াবহ সে সংকট কাটিয়ে উঠে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে অগ্রযাত্রার সূচনা হয়েছিল সেটি এখনো অব্যাহত আছে। দুর্নীতি, অব্যস্থাপনা আছে সর্বত্র, সত্যি। কিন্তু ইতিবাচক পরিবর্তনগুলোও জনমানুষের দৃষ্টির বাইরে নয় নিশ্চয়। আমরা সাধারণ মানুষ কোনদিন ভেবেছি, এদেশে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম, আলী আহসান মোজাহিদ কিংবা দেলোয়ার হোসেন সাইদির বিচার হবে? আমরা তো দেখেছি এরা এদেশের মন্ত্রী। দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সারাদেশ। এরা নিজেরা সদম্ভে বলেছে, এদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি হবে আমরা ভেবেছি কখনো? কিন্তু খুনিদের বিচার হয়েছে এদেশে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে বাংলাদেশ আমাদের জীবদ্দশায় ১০,০০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যাবে, এমনটা আমরা কয়জন ভেবেছি। মঙ্গার দেশ বাংলাদেশ একদিন খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে বিদেশে খাদ্য রপ্তানি করবে সেটা এখন স্বপ্ন নয় সত্যি। এদেশে কোন একদিন আসবে যখন বড় বড় রাজনৈতিক দল হরতাল ডাকবে, কিন্তু হরতাল হবেনা, কে কখন ভেবেছে। এদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টানা কয়েকবছর সাতের মত। পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটির মানদণ্ডে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩২তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০১৬ সালের ইনক্লোসিভ ইকনোমিক গ্রোথ ইনডেক্স রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশ ভারত থেকে ২৪ ধাপ এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। ফোরামের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, সামগ্রিক উন্নয়নের মানদণ্ডে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৬তম। অন্যদিকে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রতগতির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেশ ভারতের অবস্থান ৬০ এবং পাকিস্তানের ৫২তম।
শিক্ষাব্যবস্থার অরাজক পরিস্থিতি বাদ দিলে , বাংলাদেশ বলা যায় প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নতি লাভ করছে। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। অতি দারিদ্রের হার ১২ শতাংশ কমাতে পেরেছে বর্তমান সরকার। সাম্প্রদায়িক শক্তি দমনে বর্তমান সরকার থেকে আর কোন সরকার বেশী সক্রিয় ছিল, বলতে পারবেন? এমতাবস্থায় বিএনপি-জামাত জোট আবার ক্ষমতায় আসলে দেশের পরিস্থিতি কী হতে পারে বলে আপনাদের অনুমান? জামাত কি দেশের মুক্তচিন্তার, প্রগতিশীল, ধর্মপরায়ণ কোনো মানুষকে ছেড়ে কথা বলবে? এখনি তো আমরা দেখি, সমাজের ভালো মানুষগুলো একে একে জঙ্গিদের হামলায় প্রাণ হারাচ্ছে। জামাত ক্ষমতায় আসলে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে ভাবলে কি আতঙ্কিত না হয়ে উপায় আছে? দেশের যারা অতিপ্রগতিশীল সেজে বাগাড়ম্বর করেন, তারা কি সামাল দিতে পারবেন যুদ্ধাপরাধী জামাতের আগ্রাসন? জামাতের দোসর বিএনপিও কি এর উত্তর দিতে পারবে। যখন একে একে মুক্তিযোদ্ধাদের, মুক্তবুদ্ধির মানুষদের হত্যা করা হবে তখন বিএনপি কী বলবে? তখন এই অতিপ্রগতিশীলদের বাগাড়ম্বরও কোথায় যাবে? তাই ভাবুন, আওয়ামী লীগ ছাড়া কি আদৌ কোনো বিকল্প আছে?
লেখকঃ সাংবাদিক, শিক্ষক
মন্তব্য করুন