ক্রিকেট নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ বিদ্বেষ কেন?
প্রয়াত আইসিসি সভাপতি ভারতীয় নাগরিক জগমোহন ডালমিয়ার অসামান্য অবদান আছে বাংলাদেশের ক্রিকেট উন্নয়নে। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বাংলাদেশ বিশ্বকাপে প্রথম যায় ১৯৯৯ সালে। সে বিশ্বকাপেই পাকিস্তানকে হারিয়ে দেয় বাংলাদেশ। ডালমিয়া যখন সভাপতি, তখন ২০০০ সালে বহুজনের বিরোধিতাকে অগ্রাহ্য করে তিনি বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তিতে চিরস্মরণীয় ভূমিকা রাখেন। তখনকার বিসিবি সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী পর্যন্ত অকপটে বলেছেন- ‘শুধুমাত্র মাঠের খেলায় নয়, কূটনৈতিক তৎপরতা ও ডালমিয়ার একান্ত চেষ্টাতেই বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছে’। আর বাংলাদেশ তার প্রথম টেস্ট খেলেছে সৌরভ গাঙ্গুলীর ভারতের বিরুদ্ধেই ঢাকার মাটিতে।
এই বছরের সংক্ষিপ্ত সফর ছাড়া ভারতে বাংলাদেশ দলকে নিমন্ত্রণ পর্যন্ত জানায়নি- দ্বিপাক্ষিক সফর লাভজনক হবে না বলে। সে যাই হোক- ভারত বাংলাদেশকে কোনো পাত্তাই দিত না দল হিসেবে। বড় ভাই হিসেবে পিঠ ছাপড়ে দিত। আর আজকের দিনে বাংলাদেশ- ভারত ম্যাচ মানেই বদলা, বারূদ এসব শব্দের ঝংকার।
২০০৭ সাল। ১৬ টি দল বিশ্বকাপ খেলছে, চারটি গ্রুপে ভাগ হয়ে। একটি গ্রুপে ছিল- বাংলাদেশ, ভারত, বারমুডা ও শ্রীলংকা। নিয়ম ছিলো প্রতি গ্রুপ থেকে দুইটি দল সুপার এইটে যাবে। তার মানে- ভারত আর শ্রীলংকা সুপার এইটে যাবে এটা পুরোপুরি নিশ্চিত। কিন্তু মানুষ (পড়ুন ভারতীয়রা) ভাবে এক, হয় আরেক। পুঁচকে বাংলাদেশ ভারতকে পরাজিত করে বিশ্বকাপ থেকেই বের করে দেয়।
কাশ্মির থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত পুরো ভারতে হায় হায় রব উঠে। স্যাটেলাইট চ্যানেলে ভারতীয় দলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে শত শত কোটি টাকার বিজ্ঞাপন দেয় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো। কোম্পানিগুলোর ব্রান্ড অ্যাম্বাসেডর হন- আমির খান, অক্ষয় কুমার, অমিতাভ বচ্চনের মতো মেগাস্টারেরা। কি হাস্যকর! ভারত বাংলাদেশের কাছে হেরে দেশের পথ ধরেছে, ওদিকে সব টিভি চ্যানেলে ক্রিকেট টিমের জন্য শুভেচ্ছা বিজ্ঞাপন হচ্ছে।
সারা দুনিয়ার হাসির পাত্র হয়ে দুই দিনের মধ্যে সমস্ত বিজ্ঞাপন প্রত্যাহার করা হয়। শত শত কোটি টাকা গচ্চা যায় টিভি ও বিজ্ঞাপনদাতা উভয়েরই।
হরভজন সিং বলেছেন, ‘এরকম কষ্টের দিন তার জীবনে আর আসেনি। ক্রিকেটাররা কেউ কারো দিকে লজ্জায় থাকাতে পারছে না। কী দুঃসহ যন্ত্রণা’।
অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড় বিমানবন্দরে নেমে তার স্ত্রীকে খুঁজতে লাগলেন। স্ত্রী দ্রাবিড়ের সাথে কথাই বলেনি। পরে রাহুল বলেছেন –‘আমি ওর গোমড়া মুখ দেখে ভয় পেয়ে ভাবলাম, ওকি তালাকনামা নিয়ে এসেছে?’
কোচ গ্রেগ চ্যাপেলের স্বপ্নের চাকরিটা আর থাকেনি।
রাহুল দ্রাবিড়ের অধিনায়কত্ব কেড়ে নেয়া হয়।
সব পত্রিকায় কার্টুন বের হয়- ক্রিকেটারদের কাউকে তারা বানায় সবজি বিক্রেতা, হকার, দর্জি ইত্যাদি ।
ধোনির বাড়ি পাহারায় নামানো হয় আধাসামরিক বাহিনীকে।
দ্রাবিড়ের বাড়িতে ঢিল পড়ে।
শেবাগ পালিয়ে পালিয়ে থেকেছেন, মানুষের সামনে যাতে না পড়তে হয়।
ক্রিকেট দেবতা টেন্ডুলকারের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে পারতেন না টিটকারির ভয়ে। টেন্ডুলকার হয়ে উঠলেন ‘Endulkar’
টেন্ডুলকার তার আত্মজীবনীতে জানাচ্ছেন, ‘১৮ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে থাকার পর পত্রিকায় ‘Endulkar’ লেখা দেখে দুঃখে ফেটে পড়লাম আমি। কিন্তু কিছুই করার ছিল না।’
ভারতজুড়ে কৌতুক চালু হলো- এই হারের জন্য আসলে দায়ী ইন্দিরা গান্ধী, তিনি কেনো মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশকে স্বাধীন হতে সহায়তা করেছেন?
২০০৭ বিশ্বকাপ বদলে দেয় ভারতের ক্রিকেটকে, বদলে দেয় বিশ্বকাপের ফরম্যাটকে। চার দলের এক গ্রুপ প্রথা বাতিল হয়।
এবার বলুন- কতটুকু দুঃখ ভারত পেয়েছে বাংলাদেশের কাছে?
কীভাবে এই ব্যাথা ভুলবে তারা? তাইতো, ভারত- বাংলাদেশ ম্যাচ হলেই ভারতীয় মিডিয়া ও জনগণ বাংলাদেশ বিদ্বেষে মাতিয়ে রাখতে চায়।
তাই তো, বাংলাদেশের লোকজনও পাল্টা জবাব দেয়। সামাজিক মাধ্যমে বিষোদগার চালায় দুই পক্ষই।
লেখক: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
মন্তব্য করুন