আর্টিজানের সেই বাড়িটি এখন...

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ১৩ জুন ২০১৭, ১১:৫২| আপডেট : ১৩ জুন ২০১৭, ১২:০৩
অ- অ+

কাঠ বাদাম গাছটা আকাশ ছুঁতে চাইছে। তার ডালে মুখোমুখি বসে আছে দুটো হলদে পাখি। সবুজ পাতার আড়াল থেকে মাঝেমধ্যে ডেকে উঠছে। বোধ হয় কথা বলছে ওরা। এই পাখিগুলো সচরাচর চোখে পড়ে না। গুলশান দুই নম্বর সেক্টরের ৭৯ নম্বর পথের শেষ দিকের বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী হোসাইন বললেন, ‘হলদে পাখি প্রায়ই দল বেঁধে আসে। বাদাম খায়।’

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের দেয়া পাঁচ নম্বর হোল্ডিংয়ের বাড়ির দুটো ভাগ। একপাশে লেক ভিউ ক্লিনিক। অন্যপাশে আবাসিক। মিস সামিরা আহমেদ স্বামী-সন্তান নিয়ে থাকেন। সামিরা বোন সারা আহমেদও এই সম্পত্তির মালিক। তবে সারা এখানে থাকেন না।

সামিরা আহমেদ এই বাড়িতে উঠেছেন বেশিদিন হয়নি। সবমিলে মাস ছয় হবে হয়তো। বাড়িটির বাইরে থেকে ভেতরে খুব একটা দেখা যায় না। সদর দরজা ছাড়া পুরোটাই উঁচু করে ওশান ব্লু করোগেটেড সিট দিয়ে সীমানা দেয়া। গ্রামে বলে ঢেউটিন। মেটালিক নকশার সদর দরজাটার ভেতর থেকে প্লেন সিট দিয়ে আটকে দেয়া। রঙ লাগেনি তাতে। বোঝাই যাচ্ছে, বাইরে থেকে যেন ভেতরের কিছু দেখা না যায় সেই ব্যবস্থা করা হয়েছে। অথচ ঘাড় উঁচিয়ে তাকালে এখনও ভেতরের নানন্দিক স্থাপত্য চোখে পড়ে। দোতলা ছিমছাম বাড়িটির সামনে খোলা জায়গা। সবুজ ঘাসের চত্বর। তার বুকে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি তিনটি গাছ। নিচের টুকু দেখলে মনে হবে তাল গাছ। আর উপরে অবিকল কলা গাছের মুণ্ডু। হোসাইন নিজেও গাছটার নাম জানে না। বলল, ‘একবার শুনেছিলাম। ভুলে গেছি। বিদেশি গাছ। নাম মনে থাকে না।’

হোসাইন মিয়ার মনে আছে এই বাড়িতেই ছিল অভিজাত বেকারি ও রেস্তোরাঁ হলি আর্টিজান। যেখানে গত বছরের ১ জুলাই ঘটেছিল নারকীয় তা-ব। ওই রাতে জঙ্গি হামলায় ১৭ জন বিদেশিসহ মোট ২২ জন মারা গিয়েছিলেন। দুজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন তাদের মধ্যে। পরদিন অর্থাৎ ২ জুলাই সকালে সেনা কমান্ডোদের উদ্ধার অভিযানে পাঁচ জঙ্গি ও রেস্তোরাঁর একজন পাচক নিহত হন। পরে হাসপাতালে রেস্তোরাঁর আরেক কর্মী শাওনের মৃত্যু হয়। হোসাইন তখন এখানে ছিল না। টেলিভিশনের সামনে বসে ওইরাতে সব দেখেছে। তার ঠিক মনে আছে, তখনও রমজান মাস চলছিল।

‘আমরা তো দেখে অবাক! ঢাকায় কি যুদ্ধ লাগলো নাকি? এইভাবে মানুষ মানুষকে মারে! ফেসবুকে গলাকাটা লাশের ছবি দেখছি। আমগো গ্রামের এক চাচা ছবি দেইখা তো জ্ঞান হারাইছে।’ হোসাইনের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে। রবিবার সকালে তার সঙ্গে দেখা। কথা হয় তখনই।

পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার নুরুজ্জামানও লেক ভিউ ক্লিনিক আর সাবেক হলি আর্টিজানের বাড়িটির নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন। তিনি জানালেন, এখনও উৎসুক মানুষ বাড়িটি দেখতে আসে। এখানকার কী অবস্থা জানতে চায়। মানুষের আনাগোনা বিরক্ত হয়েই উঁচু করে ঢেউটিনের সীমানা প্রাচীর দেয়া হয়েছে। বাড়ির পুবে গুলশান সরবর। ওই দিকটাও ঢেকে দেয়া হয়েছে।

নুরুজ্জামান বলেন, ‘বাড়ির মালিক নিজেই এখানে থাকে। কারো কাছে ভাড়া দেয় নাই। হলি আর্টিজান বেকারি তো গুলশান এভিনিউতে শাখা খুলছে।’ এ বছরের শুরুতে গুলশান এভিনিউয়ের র‌্যাংগস আর্কেডের দ্বিতীয় তলায় ছোটো পরিসরে বেকারিটি চালু হয়েছে। আগে দু হাজার বর্গফুটের জায়গায় বসে পারতেন ৫০ জন অতিথি। ৫০০ বর্গফুটের বেকারিটিতে একসঙ্গে বসতে পারেন ২০ জন অতিথি।

৭৯ নম্বর সড়কে ঢুকতেই কনকর্ড ফ্লোরা। নিরাপত্তাকর্মী শফিকুল ইসলাম একই বাড়িতে কাটিয়ে দিয়েছেন ১০ থেকে ১২ বছর। রবিবার হলি আর্টিজানের সেই বাড়িটি ঘুরে ফিরে আসার সময় তার সঙ্গে কথা হয়। ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজান হামলার সময় তিনি বাড়ির গেটে ডিউটিতে ছিলেন। হঠাৎ করে গোলাগোলির শব্দ শুনে গেট বন্ধ করে ভেতরে এসে বসেছিলেন। তিনি বলেন, ‘ওই রাতে মনে হয়েছিল যুদ্ধের মধ্যে আছি। ভয়ে গেট থেকে বের হইনি। একটু পর পর গেট খুলে উঁকিঝুঁকি মেরে আবার আটকে দিয়েছি। দেখলাম, একদল পুলিশ আস্তে আস্তে দৌড়ে হোটেলের দিকে যাচ্ছে। হঠাৎ একটা বোমা মারলো ভেতর থেকে। পুলিশ সব দৌড়াদৌড়ি করে বের হয়ে এলো।’

শফিকের মতো ওই এলাকার বাসিন্দারা এখনও সেই রাতের কথা ভুলতে পারেননি। এখনও থমথমে গুলশানের কূটনৈতিক পাড়ার সেই ৭৯ নম্বর সড়ক। এখন এই সড়কের কথা শুনলে মৃদু হলেও আঁতকে উঠেন। ফিরতে হবে। রিকশায় চড়ে বসলাম সড়কের মুখ থেকে। প্যাডেলে পা চাপিয়ে রিকশাচালক ওয়াহাব বললেন, ‘ভাই কি আর্টিজান হোটেলে গেছিলেন?’

আমি বললাম, ‘এখানে তো আর হোটেল নেই।’

‘হোটেল উইঠা গেছে?’

‘হ্যাঁ’

‘ওইদিন আমি গাড়ি চালায়ে বাসায় ফিরতেছিলাম। দেখি খালি পুলিশ আর পুলিশ। ভয়ে আরেক গলিতে ঢুইকা বইসাছিলাম। রোজার দিন আছিল। পরে অনেক রাতে বাসায় গেছি।’

রিকশা গুলশান দুই নম্বর চত্বরের কাছাকাছি এসে থেমেছে। ভাড়া মিটিয়ে বিদায় নেয়ার সময় ওয়াহাব বললেন, ‘ওইরাতে যারা হামলা করছিল তারা নাকি ভালো ভালো ঘরের পোলাপান। তারা কেন এমন সন্ত্রাস হইলো? তাগোর তো কিছুর অভাব ছিল না!’

আমি বললাম, ‘অভাব ছিল ওয়াহাব ভাই। আমরা জানতাম না।’

‘কীসের অভাব ছিল ভাই?’

‘মনুষ্যত্বের।’

‘এইটা আবার কী?’

আমার বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল-

‘এই যে আপনার ভেজা চোখ। যে চোখে তাকালে পৃথিবীটা মায়াময় মনে হয়।’

কিন্তু আমি কিছু না বলেই ফুটপাত ধরে হাঁটতে থাকলাম বাসস্টপের দিকে।

(ঢাকাটাইমস/১৪জুন/এইচএফ)

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
বাংলাদেশ পেশাদার সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি শাকিল ও সম্পাদক রোমান 
সাংবাদিক লাঞ্ছিত করায় সিদ্ধিরগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সম্পাদক বহিষ্কার
গেইলকে ছাড়িয়ে বাবর আজমের বিশ্ব রেকর্ড
নোয়াখালীর হাতিয়ায় আগুনে পুড়লো ৭ দোকান
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা