মানুষের প্রাণ এত সস্তা হয়ে গেল এদেশে!
অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের দেশের চট্টগ্রাম ও তৎসংলগ্ন তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটি। অনেক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের আধার এইসব পাহাড়ি এলাকা। বিশ্বের সব দেশেই পাহাড়কে সুরক্ষিত করে রাখা হয় জীববৈচিত্র্য ঠিক রাখার জন্য। পাহাড়ী জনগোষ্ঠী যাতে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে বাঁচতে পারে সেজন্য সবাই সচেতন।
বাংলাদেশের অধিকাংশ লোক অবশ্য সমতলে বাস করে। অসমতল পাহাড়কে আমরা কেটে সমতল করে রাখতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। প্রকৃতিকে নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করার কারণে আজ পাহাড় ধস এক মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। এর পিছনে সবাই কমবেশি দায়ী।
নির্বিচারে পাহাড় কেটেছে সবাই। বাঙালি, পাহাড়ি, প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এমনকি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বিরুদ্ধেই পাহাড় কাটার অভিযোগ রয়েছে।
পাহাড় কাটার শুরুর কথা:-পাহাড়ি অঞ্চলে অতিবৃষ্টির প্রকোপ সমতল অপেক্ষা বেশি। পাহাড় ধস সবসময়ই ছিল। কিন্তু আগে এত প্রাণঘাতি হতো না। কারণ, পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষ শত শত বছর ধরেই পাহাড়ের সাথে মিতালি পেতে বসবাস করতে জানত। কিন্তু পাহাড়ি অঞ্চলে বহিরাগত বাঙালিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার পর পাহাড় কেটে বসবাস বৃদ্ধি পায়।
বৃটিশ আমলেও পাহাড়িদের স্বাধীন জীবনযাপনের প্রতি কেউ হস্তক্ষেপ করেনি। দেশ স্বাধীন হওয়ার চাকমা নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে পাহাড়িরা প্রথম বাঙালি শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। পাহাড়িরা স্বায়ত্তশাসন দাবি করলে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘যা, তোরা বাঙালি হইয়া যা’। এই কথায় ক্ষুব্ধ হয়ে পাহাড়িরা অস্ত্র তুলে নেয়।
জিয়াউর রহমানের শাসনামলে পাহাড়ের জনবৈচিত্র্য বিনষ্ট হয়। জিয়াউর রহমান চিন্তা করেছিলেন- পাহাড়ে যদি দলে দলে বহিরাগত বাঙালিদের বসতি স্থাপনের সুযোগ দেয়া হয়, তাহলে অচিরেই পাহাড়ে পাহাড়িরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে। হলোও তাই। আজ বান্দরবান জেলার সাতটি উপজেলায় প্রায় ৩০ হাজার পরিবার, রাঙ্গামাটি জেলার ১০টি উপজেলার প্রায় ৮০ হাজার পরিবার এবং খাগড়াছড়ি জেলার নয়টি উপজেলায় প্রায় ৬০ হাজার পরিবারের বসতি রয়েছে উঁচু-নিচু পাহাড় ও পাহাড় ঘেঁেষ কিংবা পাহাড়ের পাদদেশেই।
তারা প্রায় সবাই বহিরাগত বাঙালি। সৈনিক হিসেবে জিয়াউর রহমান খুব সুচতুর ফন্দি এঁটেছিলেন। সেটা কাজেও এসেছে, কিন্তু নষ্ট হয়েছে পাহাড়ের বসবাসের পরিবেশ।
পাহাড় ধসের কারণ প্রধানত দুইটি। ভূতাত্ত্বিক ও মানবসৃষ্ট। ভূতাত্ত্বিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে পাহাড়ের গঠন, বালুর বিন্যাস ও পাহাড়ের ঢালুতা। আর মানবসৃষ্ট কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে-পাহাড় কাটা ও বন উজাড়।
দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশের পাহাড়গুলো বালুময়। মাঝে মাঝে এগুলোর মধ্যে পাথরের মিশ্রণ রয়েছে। পাহাড় কাটা হলে পাহাড়ের বালু ও পাথরের বন্ধনটা নষ্ট হয়ে যায়। পাহাড়ে ফাটল দেখা দেয়। এতে ধসে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। অধিক বৃষ্টিপাতে পাহাড়ের ফাটল দিয়ে ভিতরে পানি প্রবেশ করে। এতে পাহাড় ভারী হয়ে পড়ে।
পাহাড়ে দুর্যোগ মোকাবেলা করার জন্য তিনটি প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহন করাই সর্বোত্তম। ব্যবস্থাগুলো হলো-পাহাড়ে পর্যাপ্ত গাছ লাগানো, সুষ্ঠু পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা তৈরি করা এবং পাহাড় থেকে বসতি উচ্ছেদ করা।
গরিব মানুষের অসহায়ত্ব নিয়ে বাণিজ্য করে স্বার্থান্বেষী মহল। ৫০০/১০০০ টাকার বিনিময়ে থাকতে দেয় তারা মানুষকে। তাই পাহাড় ধস হলে গরিব মানুষেরাই এর শিকার হয়। গত ১৫ বছরে পাহাড় ধসে মারা গেছে অন্তত ৩০০ জন। ২০০৭ সালের ১১ জুন কেবল চট্টগ্রামেই পাহাড় ধসে মারা গিয়েছিলো অন্তত ১২৭ জন। ওই ঘটনার পরে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি পাহাড় ধসের ২৮টি কারণ চিহ্নিত করে ৩৬ দফা সুপারিশ প্রণয়ণ করে। কিন্তু হায়! আজ পর্যন্ত কমিটির কোনো সুপারিশই বাস্তবায়িত হয়নি। মানুষের প্রাণ এত সস্তা হয়ে গেল এদেশে।
এবারের পাহাড়ধস আরও মারাত্মক। ঝরে পড়েছে অজস্র প্রাণ। শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অকুতোভয় বীরসেনানীদের। যারা নিজের প্রাণের বিনিময়ে উদ্ধার তৎপরতায় অংশ নিয়েছে। এবারের দুর্ঘটনা থেকে যদি যথাযথ শিক্ষা নিয়ে সবাই পাহাড় রক্ষায় সচেতন হয়, তাহলে ভবিষ্যতে এসব দুর্ঘটনা এড়ানো যাবে।লেখক: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক
মন্তব্য করুন