বঙ্গবন্ধু হত্যা: ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার না হওয়ায় আক্ষেপে সিনহা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১৫ আগস্ট ২০১৭, ১৬:২৩ | প্রকাশিত : ১৫ আগস্ট ২০১৭, ১২:২০

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার বিচার হলেও এই ষড়যন্ত্রে জড়িতদের বিচার না হওয়ায় আক্ষেপ জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমরা সিনহা। তিনি বলেছেন, রাঘব বোয়ালেরা জড়িত থাকলেও তদন্তে দুর্বলতার কারণে তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করা যায়নি।

মঙ্গলবার ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে সুপ্রিম কোর্ট আয়োজিত স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি এ কথা বলেন। এসময় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিসহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রান্সফিউশন বিভাগ রক্তদান কর্মসূচিতে সহযোগিতা করছেন।

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। এ হত্যার সঙ্গে অনেক রাঘব-বোয়াল জড়িত ছিল। কিন্তু তদন্তে দুর্বলতার জন্য তাদেরকে বিচারে সোপর্দ করা যায়নি। এটি ছিল একটি ফৌজদারি ষড়যন্ত্র।’

‘এই মামলায় একটি গভীর ষড়যন্ত্র ছিল’ মন্তব্য করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমি আপিল বিভাগের যখন কনিষ্ঠ বিচারক, প্রকৃতপক্ষে আমি তখন অসুস্থ ছিলাম। সিঙ্গাপুরে তখন ক্যানসারের ট্রিটমেন্ট চলছিল। ট্রিটম্যান্টে থাকাকালে মামলাটির বিচারের জন্য বেঞ্চ গঠন করা নিয়ে প্রবলেম হয়েছিল তখনই আমাকে অনুরোধ করা হয় যে, তাড়াতাড়ি চলে আসেন। তখনও আমি জানি না, আমি বাঁচতে পারব কিনা। যাই হোক ট্রিটম্যান্ট বাদ দিয়ে আমি চলে আসলাম। শপথ নিয়ে তারপর সিঙ্গাপুরে গিয়ে ট্রিটম্যান্ট নিলাম। আমি নথি পর্যালোচনা করে দেখলাম এই ষড়যন্ত্রের মধ্যে আরো অনেক রাঘব বোয়াল অনেক …জড়িত ছিল। কিন্তু ইনভেস্টিগেশনের ত্রুটির জন্য আমরা তাদের আর বিচারে সোপর্দ করতে পারি নাই।’

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে আক্রমণ করে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে সেনাবাহিনীর একটি অংশ। এরপর ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত যারা ক্ষমতায় এসেছে, তারা কেউই খুনিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে নানাভাবে পুরষ্কৃত করেছে। এমনকি আইন করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ বন্ধ করা হয়।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ১২ নভেম্বর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথে বাধা দূর করে। মামলা করেন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী আ ফ ম মহিতুল ইসলাম। শুরু হয় তদন্ত। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকার তৎকালীন দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে উচ্চ আদালতে এই মামলার মীসাংসা হয়নি। আটকে থাকে আপিল বিভাগে শুনানি।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে পাঁচ বছর আপিল বিভাগে বিচারক নিয়োগ করা হয়নি। কেবল বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার আটকে রাখার জন্যই এমনটা করা হয় বলে অভিযোগ আছে। পরে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আপিল বিভাগে বিচারক নিয়োগের পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আপিল শুনানি শুরু হয়।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার এক বছরের মাথায় ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এই পাঁচ জন হলেন বজলুল হুদা, মুহিউদ্দিন, সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহারিয়ার রশিদ খান ও মহিউদ্দিন আহমেদ।

এই মামলায় আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ড পেয়েছিলেন ১২ জন। বাকি সাত জনের মধ্যে এক জন মারা গেছেন বিদেশে। বাকি ছয় খুনি খন্দকার আবদুর রশিদ, মোসলেমউদ্দিন, শরিফুল হক ডালিম, এ এম রাশেদ চৌধুরী, নূর চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ।

প্রধান বিচারপতি বলেন, আজকে আমাদের ইতিহাসের একটি মর্মান্তিক দিন। বাংলার মানুষ স্বাধীনতার স্থপতিকে শুধু হারায়নি, তার বিশ্বাস, তার ভবিষ্যত সবাইকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিল হত্যাকরীরা।

এই উপমহাদেশের দুইজন জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়েছে উল্লেখ করে সিনহা বলেন, ‘একজন হলেন মহাত্মা গান্ধি আরেকজন হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু এই দুই মহান নেতার মৃত্যুর কারণ কিন্তু দুটো। মহাত্মা গান্ধিকে হত্যা করা হয়েছিল, তিনি পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে যে রায়ট লেগেছিল এবং পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাবে রক্তের বন্যা বয়েছিল। কোনো মতেই উনি সরকারকে-নেহেরু প্রধানন্ত্রীকে বলেছিলেন রায়ট বন্ধ করতে। সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল ডেপুটি প্রাইমিনিস্টার এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। উনিও অনেক চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু ... করেন নাই। রায়টের সময় পশ্চিমবঙ্গে শুধু ১০ লক্ষ লোক মারা যায় এর মধ্যে দুই লাখের উপর মুসলমান মারা যায়। এরপর মহাত্মাগান্ধি আমরণ অনশনে বসলেন এবং বললেন এই রায়ট যদি বন্ধ না করা হয় আমি অনশন বন্ধ করব না।’

‘ভারত সরকার তখন সজাগ হলো, রায়টটা বন্ধ হয় গেল। হিন্দু উগ্রবাদি মথুরাম গোৎসে সহ্য করতে না পেরে হত্যা করল। এটা সম্পূর্ণভাবে সাম্প্রদায়িকতা, অন্ধ বিশ্বাস।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা হলো কাপুরুষোচিত। বঙ্গবন্ধু হয়তা কারো শত্রু বা কারো বিরাগভাজন হতে পারেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর চার বছরের ছেলে রাসেল, বঙ্গবন্ধুর দুই ছেলে সদ্য বিবাহিত –আজকে পত্রিকায় পড়লাম, তাদের গায়ে হলুদ এবং ... হয়েছিল।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এদের উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ পরিবারকে ধ্বংস করা। তার ছোট ভাই ছিল, শেখ রাসেল কিন্তু কোনো পলিটিক্সে ছিলেন না। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর সমস্ত পরিবারকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা। এটার সাথে পৃথিবীর কোনো হত্যার মিল পাওয়া যায় না। আমরা স্তম্ভিত হয়ে যই যেরকম তারা হত্যা করেছিল। আরো কষ্টদায়ক হলো, বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে হত্যাকারীদের রাষ্ট্রের আইন দ্বারা বিচারকদের পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।’

‘আমি এই বিচার বিভাগের একজন সদস্য হিসেবে অত্যন্ত গর্ববোধ করছি এই সুপ্রিম কোর্টই ইনডেমনিটি অডিন্যান্স বাতিল করে এই বিচারের রায় প্রশস্ত করেছিল।’

বঙ্গবন্ধু হত্যার রায় উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমাদের রায়ে আমরা পরিস্কারভাবে বলে দিয়েছি এটা একটা ক্রিমিনাল কনস্পিরেসি, পরিকল্পিতভাব হত্যা করা হয়েছিল এবং তাদেরকে বিচারের সোপর্দ করার জন্য।’

বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব মিঞা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু জাতির জনককে নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নাই। যখন ৭০ সালে নির্বাচন হয় তখন আমি বিএ ক্লাসের ছাত্র। তখন ইস্ট পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কোনো নেতা ছিল না এবং কল্পনাও করে নাই।’

ওয়াহাব মিয়া বলেন, ‘উনি ছিলেন বলেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। সেখানে আমি আজকে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি হতে পেরেছি। পাকিস্তান থাকলেও হাইকোর্টের হয়ত হওয়া যেত কিন্তু পাকিস্তান বিচারপতি হওয়া কল্পনার বাইরে ছিল।’

‘বঙ্গবন্ধুকে এই জন্যে স্মরণ করি যে, আমরা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক এবং সেইসঙ্গে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের জ্যেষ্ঠ বিচারপতির আসনে আসীন আছি।’

(ঢাকাটাইমস/১৫আগস্ট/এমএবি/ডব্লিউবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

আদালত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

আদালত এর সর্বশেষ

৩০ কোটি টাকা ঋণ খেলাপি: সাবেক প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রীর ৪ ছেলের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান পদে জিএম কাদেরের দায়িত্ব পালনে বাধা নেই: আপিল বিভাগ

নায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলা: আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ ৩ জনের যাবজ্জীবন

যুক্তরাজ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের সাম্রাজ্যের অনুসন্ধান চেয়ে হাইকোর্টে রিট 

চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার রায় আজ

আফতাবনগরে পশুর হাট বসানোয় হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা

তিন মাসের ব্যবধানে আরেক মামলায় খালাস পেলেন গোল্ডেন মনির

আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যামামলা: আপিল শুনানি দ্রুত করতে আসামির আবেদন

পরিবেশ রক্ষায় ঢাকাসহ সারাদেশে গাছ কাটা বন্ধে হাইকোর্টে রিট

এ জে মোহাম্মদ আলীর সম্মানে আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগে বিচারকাজ বন্ধ ঘোষণা

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :