বার্মিংহাম কমিউনিটি সংগঠনগুলোর ভেতরের খবর

সাহিদুর রহমান সুহেল, বার্মিংহাম থেকে
| আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০১৭, ২১:৩০ | প্রকাশিত : ৩০ আগস্ট ২০১৭, ২০:০১

একটি গান শুনতাম ছোট্ট বেলায় "ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইছে...", আজ জীবনের অনেক গণ্ডি এবং আশা-নিরাশা পেরিয়ে স্বপ্নের বিলেতের বার্মিংহাম শহরে আমার বসবাস ৷ এই বিলেতে কীভাবে, কবে কিংবা কোথায় প্রথমে আমাদের পূর্বপুরুষেরা বসতি স্থাপন করেছিলেন সে এক পুরো ইতিহাস ৷ তবে ভাবতেই ভালো লাগে এই বার্মিংহামে ১৯৭১ সালের ২৮শে মার্চ মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক স্মলহীথ পার্কে দশ হাজার মানুষের উপস্থিতে দেশের বাইরে বাংলাদেশের পতাকা প্রথম উত্তোলন করা হয় ও শপথ পাঠ করা হয় ৷

এমন একটি ঐতিহাসিক শহরে আশা আর স্বপ্নকে নিয়ে ২০০১ সাল থেকে সংগ্রাম করছি জীবনের সেরা সময়টুকুকে ভালো কাজের মধ্যে বন্দি করে রাখবো বলে৷ শুধু আমি কেন, প্রত্যেকটা মানুষ কখনো কখনো সময়কে ভীষণভাবে বন্দি করতে চায়৷ হয়তো জীবনের অসাধারণ মুহূর্ত যখন পুরো পৃথিবীকে থামিয়ে দিতে ইচ্ছে করে, এই চাওয়া হেঁয়ালি করে চাওয়া নয় বরং তীব্রভাবে মন থেকে চাওয়া যেন সব জেনেশুনেও প্রকৃতির বিরোধিতা করা এবং এই অসম্ভব ব্যাপারটাকে সম্ভব করতে কিছু মানুষ পারেও বটে।

আর তারা তাদের জীবনের সেরা সময়টুকু বিলিয়ে দিয়ে যায় রাজনীতি, সংস্কৃতি, সামাজিক সংগঠন, খেলাধুলা ও সাংবাদিকতা ইত্যাদিতে৷ কিন্তু আজ দীর্ঘদিনের অচেনা শহর বার্মিংহাম বড় চেনা হয়ে উঠেছে আমার কাছে৷ এখানে অনেক ক্ষেত্রে জীবনের অসাধারণ মুহূর্তে অন্যকে টপকিয়ে "টুল্লিতে বসা” যেন নিয়মিত প্রতিযোগিতার প্রতিনিয়ত আহ্বান৷

এখানে স্থানীয় রেস্টুরেন্টগুলোতে একেকজনের চায়ের কাপে প্রতিটা চুমুকের সাথে একেকটি সংগঠন জন্ম হচ্ছে৷ আবার চায়ের সাথে একেকটি বিস্কুট ধরে নিলাম সংগঠনের বাস্তব রূপ৷ এই বিস্কুট চায়ের কাপে যেটুকু সময় ধরে রাখলে বিলীন হয়ে যায়, সেটুকু সময়ের মধ্যে ওই সংগঠনগুলোও বিলীন হয়ে যাচ্ছে৷ এই চায়ের কাপে কত সংগঠনের জন্ম হচ্ছে আর কত সংগঠনের মৃত্যু হচ্ছে তা হিসাব কষতে গেলে কেবল কাগজ-কলমেরই অন্ত হবে, হিসাব আর মিলানো যাবে না৷ বর্তমানে সব মিলিয়ে বার্মিংহামে প্রায় দু'শর উপরে সংগঠন রয়েছে৷ এখানে প্রায় ৭৫ হাজার লোকের বসবাস৷ এই দুইশ সংগঠনের চালক-যাত্রী খুব বেশি হলে দু’শো জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ৷

এই দু'শ জনের মধ্যে একেকজন ন্যূনতম হলেও তিনটি সংগঠনের মহাজন৷ আবার একেকজন গর্ব করে টেবিলের উপর হাত চাপড়িয়ে নিজেকে যখন প্রকাশ করেন অথবা যখন চার পৃষ্টার ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে দেন কারো হাতে যে তিনি ১২/১৩ টি সংগঠনের মালিক তখন চায়ের কাপের ভিতর থেকে পাতাটাও যেন লাফ দিয়ে সাক্ষী দেয়৷ আমিও হার মেনে যাই কারণ জাতীয় দিবসে শহীদ মিনারে ছবিগুলিই তার প্রমাণ৷ একেকটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই কিন্তু কোনো না কোনো সংগঠনের সভাপতি কিংবা সেক্রেটারি৷ আর সাধার দর্শক যারা উপস্থিত হোন তারা আয়োজকের বন্ধু, আত্মীয় অথবা লিফলেটে অতিথির চেয়েও বড় অক্ষরে যখন লেখা থাকে, “লাঞ্চ উইলবি প্রবাইডেড” এর জন্য হয়তো ৷

উপস্থিত সবাই যখন সভাপতি/সম্পাদক তখন আয়োজককে “টুল্লিতে বসা” কিংবা বক্তব্য প্রদান নিয়ে প্রতিনিয়ত বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়৷ যেন দাওয়াত দিলেও সমস্যা আবার না দিলেও সমস্যা৷ তাছাড়া অতীতে হাইকমিশনের অনুষ্ঠানে দাওয়াত পাওয়া না পাওয়ার জন্য পত্রিকায় "ক্ষুদ্ধ হওয়ার সংস্কৃতি বা না পাওয়ার বেদনার বহিঃপ্রকাশ" সৃষ্টি হয়েছিল৷ এখানে প্রতিটি এলাকার কম করে হলেও একের অধিক সংগঠন রয়েছে৷ যাদের উদ্দেশ্য ও গন্তব্যহীন পথচলায় কিছু ভালো সংগঠনগুলোও জনগণের হৃদয় স্পর্শ করার পথ হারাচ্ছে৷ কমিউনিটি নেতা যারা দাবি করেন তাদের সেবার বদলে টুল্লিতে সর্বদা স্যুটের ভাজ নষ্ট না হতে দু'হাত ব্যস্ত৷ আবার এইসব নেতারা সিনেমার নায়িকা থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ, মৌলানা কিংবা বেলি ডানসারের সাথে ছবি তুলতে হুলস্থুল খেয়ে পরে যান৷ এদের যেমন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট যেমন নেই তেমনি সব ধরনের সংগঠনে লেবাস পরিবর্তন করে কুলা পাতিয়ে বসেন৷ এমনও দেখেছি সংস্কৃতি কর্মী কেরাত প্রতিযোগিতার বিচারক৷ একটি জরিপ চালানো যেতে পারে প্রত্যেকটি সংগঠনের সভাপতি/সম্পাদককে তাদের কার্যনির্বাহী কমিটির সহ-ধর্ম, প্রচার, দপ্তর সম্পাদকের নাম বলতে হবে - কয়জন পারেন সেটা দেখার বিষয়।

আবার অনেকে নিজেই জানেন না তিনি কোনো এক সংগঠনের একটি সম্পাদকীয় পদে অধিষ্ঠিত৷ তবে বলতে দ্বিধা নেই যারাই কমিউনিটিতে হাঁটতে চান তারা অবশ্যই ব্যবসায়ী এবং কোনো দোকানের মালিক হতে হবে৷ এখানে যোগ্যতা ধর্ষিত হয় আর অযোগ্যতা সম্মান পায়৷ কথাটা এমন ছিলো "লেখাপড়া করে যে গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, কজন শিক্ষকের গাড়ি আছে? অন্যদিকে রাজনীতিবিদরা দলের আনুগত্যের কাছে নিজ বিবেকের আনুগত্য বন্ধক রেখে চলেছেন৷ তারা যদু আর মধুর কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহণ করে বৈদ্যুতিক প্রচার বাক্সের সামনে তীর্থের কাকের মতো বসে থাকেন ভিডিও ফুটেজ দেখার জন্য৷ আর মিডিয়ার অনেকেই অর্থ আয়ের লক্ষে নতুন নতুন অনুষ্ঠানের মাত্রা যোগ করে চলেছেন৷

পত্রিকায় প্রকাশিত রাশির ফল এবং প্রতিটি সংগঠনের জন্মের লক্ষ্য ও উদ্দ্যেশ্য যদি বাস্তবায়িত হতো তাহলে এই বিলেতে বাঙালি প্রত্যেকটি মানুষের হৃদয়ে স্বর্গ হতো৷ তবে সংগঠকদের উন্নতি হচ্ছে; ক) আর্থিকভাবে (খ) নিজের পরিবার, পরিজন, সহযোগীদের সামাজিক-ধর্মীয় অনুষ্ঠান তাদের কাছে গৌণ হচ্ছে৷ ক্ষতি হচ্ছে শুধু ভালো সংগঠনগুলোর, তারা কোনো স্পন্সরের জন্য কিংবা চাঁদার জন্য গেলে সেই প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তি পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়৷ ব্যবসায়ীরা মনে করেন এই প্রবাসে দেশের মতো এ আরেক "ইয়াবার"নতুন যন্ত্রণা,মানে চাদা না দিলে ইয়াবা দিয়ে যন্ত্রণার এক মাকড়সার জাল বুনবে ব্যবসার মধ্যে !সমাজে নতুন এ দুর্গন্ধযুক্ত ব্যাধির জন্য ব্যবসায়ীরা নাক চেপে ধরেন !তারাও কী করবে৷ তারাও চাঁদার যন্ত্রনায় অতিষ্ট হয়ে পড়েছেন৷ এইসব কমিউনিটি নেতাদের কাছে আমার অনুরোধ সভাপতি/সম্পাদক হওয়ার আকাঙ্খা বাদ দাও৷ তুমি স্পষ্ট বুঝিয়ে দাও তোমাকে পাওয়া সহজ নয়, তুমি মোটেও সস্তা নও৷ জন্ম দিলেই যেমন বাপ হওয়া যায় না, তেমনি সংগঠন জন্ম দিলেই মালিক হওয়া যায় না৷ তার চেয়ে বরং একটু চেষ্টা করো আজকে বার্মিংহাম শহরে বাঙালি কমিউনিটির মাথার উপরে সূর্যের আলোয় একটু আতর মাখিয়ে দাও আর তাঁর সুবাস ছড়িয়ে পড়ুক সবার উপর৷ তা না হলে ৭৫ হাজারের মধ্যে ২০০ জনের সীমাবদ্ধতায় থাকতে হবে৷ বাকিদের খোরাক যোগাতে বার বার ব্যর্থ হবেন৷

কমিউনিটি সংগঠন সৃষ্টি যদি কারো নেশা হয় তবে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিটি লেখায় আমি মাতাল হবো৷ মাথা উঁচু করে লড়াই করার শক্তি এই বাধা থেকেই৷ ঠিক যতটুকু নিজের স্বার্থে রাজত্ব তোমাদের ঠিক ততটুকু ক্ষমতা আমরা ছিনিয়ে নিতে জানি৷ একটা কথা সবার হয়ত জানা, বাচ্চারা ২/৩ বছরের আগে ইচ্ছা করেই কথা বলেনা, কারণ তারা ভালোভাবেই জানে এর আগে কথা-বার্তা শুরু করলে বাবা-মা ধরে কিন্ডার গার্টেনে ভর্তি করিয়ে দিবে৷ আমি সেই সুদিনের অপেক্ষায় আছি, কয়দিন পর হয়তো খবর হবে বার্মিংহামের ব্যক্তি স্বার্থে প্রতিষ্ঠিত নাম ও লক্ষ্যহীন সংগঠন ও মালিকরা টিভি ও প্রিন্ট মিডিয়ার দ্বারা ইতিহাসের আস্তাকুড়ে চলে গিয়েছে৷ তাদের নাম ও ছবি ছাপা ও বৈদ্যুতিক বাক্সে আর দেখা যায় না৷

সাহিদুর রহমান সুহেল : সাংবাদিক, চীফ রিপোর্টার, বাংলা মেইল, বার্মিংহাম, ইংল্যান্ড।

সংবাদটি শেয়ার করুন

প্রবাসের খবর বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :