ইমদাদুল হক মিলন একজনই

মাহবুব রেজা
| আপডেট : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১১:৩৩ | প্রকাশিত : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১১:২৫

[জনপ্রিয় লেখক ইমদাদুল হক মিলনের আজ জন্মদিন। ১৯৫৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর বিক্রমপুরের মেদিনীমণ্ডল গ্রামে নানার বাড়িতে তিনি জন্ম নেন। তার পৈত্রিক নিবাস মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং থানার পয়সা গ্রামে। বাবা গিয়াস উদ্দিন খান মা আনোয়ারা বেগম। এগার ভাই বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। নন্দিত কথাসাহিত্যিকের জন্মদিনে ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম পাঠকদের জন্য বিশেষ এ আয়োজন।]

আমি অনেককেই মিলন ভাইয়ের ব্যাপারে নাক সিঁটকাতে দেখেছি। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যারা মিলনের ব্যাপারে লোকদেখানো নাক সিঁটাকানোর ভণিতা করেন, তাদের মধ্যে ভ-ামিতে পূর্ণ একধরনের বৈপরীত্যও লক্ষ করেছি।

এ বৈপরীত্যটা কেমন? প্রায় ক্ষেত্রেই ইমদাদুল হক মিলনের লেখা নিয়ে তাদের মধ্যে একধরনের অজ্ঞতা রয়েছে। এরা মিলনের লেখা না পড়েই তার সম্পর্কে মন্তব্য করে বসেন।

গত ২৯-৩০ বছরে একটা জিনিস আমি লক্ষ করেছি, তাহলো ইমদাদুল হক মিলনের লেখা সম্পর্কে বিন্দুবিসর্গ না জেনেই ঢালাও মন্তব্য, কার্ভ ডায়ালগ দিতে দেখেছি তথাকথিত আঁতেলদের। নব্বই, মধ্য নব্বইয়ের দিকে অনেক লিখিয়েকে দেখেছি বইমেলায়, শাহবাগ, আজিজ মার্কেটের আড্ডায় ইমদাদুল হক মিলনকে কারণে-অকারণে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য জ্ঞান করে সাহিত্য থেকে খারিজ করে দিতে। এরা পাঁচ ওয়াক্ত অতিনিষ্ঠার সঙ্গে তাকে বাজেয়াপ্ত করত। মিলনের লেখা কালের বিচারে টিকবে কি টিকবে না, সাহিত্য বিচারে তার লেখা কোনো লেখাই নাÑ এ জাতীয় তুলনামূলক বিচারে প্রতিদিন তাকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টায় সুমো কুস্তিগীরদের মতো এরা মত্ত থাকত। এদের কেউ কেউ আবার তার লেখা পড়ে পাস মার্ক দেওয়ার দুঃসাহসও দেখাত! কেউ কেউ আবার পত্রপত্রিকায় মিলনের লেখার ভুলত্রুটি (!), সংগতি-অসংগতি (!!) তুলে ধরে লেখালেখি করে নিজেদের নাম চৌদ্দ-ষোলো পয়েন্ট বোল্ডে ছাপাত। আর কলার ঝাঁকিয়ে পরিচিতি মহলে সমালোচক তকমা জাহির করত। এরা মূলত ইমদাদুল হক মিলনের দু-চারটে বিচ্ছিন্ন গল্প-উপন্যাস পাঠ করে। মিলনবিরোধীদের খপ্পরে পড়ে তাকে এক হাত নেওয়ার ধান্ধায় ব্যস্ত থাকত। শুধু কি তাই? এদের এ ধরনের অন্তঃসারশূন্য লেখা ছাপা হলে এরা তা ফটোকপি করে নিজেদের মুখপরিচিতদের মধ্যে বিলিবণ্টন করত আর বলত, এই তোমরা আমার লেখাটা পড়ো কিন্তু। এদের ভাবটা অনেকটা যেন এ রকম, দয়া-দাক্ষিণ্য করে বাংলা সাহিত্যকে এরা কিছু দিচ্ছেন। শুধু তা-ই নয়, অনেক খেটেখুটে ইমদাদুল হক মিলনকে খারিজ করে দেওয়ার মতো একটা লেখা লিখেছি।

ইমদাদুল হক মিলনকে সাহিত্য থেকে খারিজ করে দেওয়ার মহান দায়িত্বপ্রাপ্ত সেসব স্বঘোষিত মিলনবিরোধী আঁতেলদের পরে বিনা বাক্য ব্যয়ে চোখের সামনে অবলীলায় খারিজ হয়ে যেতে দেখেছি। এদের মধ্যে কেউ কেউ যারা চিকন বুদ্ধির (পুরান ঢাকায় এই প্রজাতিদের বলা হয় গিরিঙ্গি, চালবাজ) তারা অনন্যোপায় হয়ে লাইন পরিবর্তন করে অর্থাৎ তওবা পড়ে মিলনীয় সাহিত্যে সমর্পণ করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার দুর্নিবার কসরত করে সাহিত্যিক হওয়ার খায়েসও পূরণ করেছে। অবশ্য এ-জাতীয় সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে দু-একটি চি‎িহ্নত গণমাধ্যম। আমি ছিয়াশি সাল থেকে চিকন বুদ্ধির এ প্রজাতিদের তুমুল উল্লম্ফন দেখেছি।

আমি নিজের চোখে এ রকম দু-চারজন গজায়মান লেখককে দেখেছি, যারা উঠতে-বসতে ইমদাদুল হক মিলন আর হুমায়ূন আহমেদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করতেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এরা সাংবাদিকতায় ঢুকে পত্রিকাকে ব্যবহার করে (পদলেহনের কথা না হয় বাদই দিলাম) হুমায়ূন-মিলনীয় স্টাইলকে অন্ধ অনুকরণ করে লেখালেখি ও সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ‘আলুটা-মুলাটা সাপ্লাই দিয়ে’ নামি-দামি পুরস্কার বাগিয়ে, বইমেলায় ভাড়া করা স্তাবক নিয়ে ঘোরাঘুরি করছেন। ভাবতে বিস্ময় জাগে, মিলন বিরোধিতায় বুঁদ হয়ে থাকা তাদের কেউ কেউ এখন ঘোষণা দিয়ে মিলনীয় অনুকরণে লিখে জনপ্রিয় লেখকও বটে!

একবার কথা প্রসঙ্গে মিলন ভাইয়ের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, অকারণে মিলনবিরোধিতাকারীদের ব্যাপারে আপনার প্রতিক্রিয়া কী? মিলন ভাই কথা বলেন নিজস্ব ঢঙে। সেই ঢঙের সঙ্গে একটা অলিখিত হাসিও থাকে। তার কথা বলার এ ভঙ্গিটা আমার ভালো লাগে। আমার কথা শুনে হাসলেন। বিক্রমপুরের ঘ্রাণ মাখানো কণ্ঠে মিলন ভাই যা বললেন তার মানে দাঁড়ায় এ রকম, সাহিত্যে বড় বড় কথা বলে, একে তাকে খুঁচিয়ে নিজের জায়গা করা যায় না। লেখালেখিতে টিকে থাকতে হলে লেখা দিয়েই টিকে থাকতে হয়।

ধর্মপ্রাণ মানুষ যেমন নিষ্ঠার সঙ্গে ইবাদত করেন, প্রার্থনা করেন- ইমদাদুল হক মিলনও তেমনি এক জীবনে লেখালেখির সেই কাজটাই করে গেছেন। লেখালেখির ব্যাপারে একাই লড়াই করেছেন। তা-ও কী খালি হাতে? এটা ভাবাই যায় না। বাংলাদেশে একমাত্র তিনিই প্রথম লেখক, যিনি নিজের সর্বস্ব দিয়ে লেখালেখিকে জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দুঃসাহসিক কাজটি করেছেনÑ এবং তার সম্পর্কে এ কথা বলা হয় তিনিই দেশের প্রথম জনপ্রিয় লেখক। অবশ্য আমাদের দেশে জনপ্রিয় লেখকদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, হালকা হিসেবে দেখার যে বিষয়, সেটাও তাকে হজম করতে হয়েছে। সাহিত্য বোদ্ধারা বলছেন, জনপ্রিয় লেখকদের সেরা লেখাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে একশ্রেণির মতলববাজরা এ ধরনের কর্মকা-ে যেতে থাকে যদিও আখেরে তা কোনো কাজে আসে না।

ইমদাদুল হক মিলনের দুঃখ-কষ্টে মোড়ানো শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য লেখালেখির পক্ষে ছিল না। নিরন্তর অভাব, সংগ্রাম, নিরবচ্ছিন্ন যাতনার মধ্যে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে- তার জীবন তার লেখার মধ্যে আমি সেসবের সন্ধান পেয়েছি।

ইমদাদুল হক মিলন কখনো রাখঢাক করে কথা বলেন না। নিজের সম্পর্কে অযথা ঢাকঢোলও পেটান না। যা সত্য তা-ই তিনি নির্বিঘেœ বলেন। সেলফ-এডিট কখনো তিনি করেন না। জীবনের নির্মম সত্য উন্মোচন করেন। ‘বাবার মৃত্যুর কারণ’ স্মৃতিচারণায় খুব খোলামেলাভাবে তিনি তার সেই জীবনের কথা লিখেছেন, ‘বহু ভাড়াটেঅলা একটি একতলা বাড়ি ছিল জিন্দাবাহার থার্ড লেনে। সেই বাড়ির একটি ঘরে ভাড়া থাকতাম আমরা। তখন আমার আট ভাই বোন, কখনো কখনো খালা এবং তার মেয়েও থাকে। কাজের আশায় এসে থাকে কোনও কোনও মামা, সৎ খালাতো ভাইয়েরা, বাবার দুজন সৎ ভাইয়ের কেউ না কেউ। এমনকি নানাবাড়ির দিককার লতায়-পাতায় সম্পর্কিত কোনও কোনও আত্মীয়ও বাবা খুব বড় চাকুরে ভেবে তার সাহায্যের আশায় আমাদের ওইটুকু একঘরের সংসারের এসে উঠত। অথচ বাবা মিউনিসিপ্যালিটির সামান্য কেরানী। তবু তাঁর কিছু পরিচয়, যোগাযোগ ছিল। আজিজ নামের একজনকে মিউনিসিপ্যালিটিতে ভুঁইমালির চাকরি দিয়েছিলেন বাবা। হামেদ মামাকে লিয়াকত অ্যাভিনিউর এক থান কাপড়ের দোকানে সেলসম্যানের কাজ দিয়েছিলেন। বাবার দুজন সৎভাইয়ের কেউ সদরঘাটের ফুটপাতে কাটা কাপড় বিক্রি করে, কেউ পাউরুটির দোকানদার।’

ভুঁইমালির কাজ?

সেলসম্যান?

ফুটপাতে কাটা কাপড় বিক্রি?

কিংবা পাউরুটির দোকানকদার?

আমি নিশ্চিত মিলন ভাইয়ের জায়গায় অন্য কোনো লেখক হলে এসব তথ্য কৌশল করে গোপন করে যেতেন। এখানেই মিলন ভাই স্বতন্ত্র। তিনি লিখছেন,

‘বাবা ছিলেন পরোপকারী, সৎ এবং নিরীহ ধরনের মানুষ। গ্রাম থেকে যেই আসত তাকে নিজের সংসারে রেখে সাহায্য-সহযোগিতার এক প্রবণতা তার ছিল। নিজে মেঝেতে শুয়ে আমার মায়ের চাচাতো ভাইদের চৌকি ছেড়ে দিতে বহুবার দেখেছি আমি। অন্যের উপকার করতে গিয়ে দু’দুবার মিউনিসিপ্যালিটি থেকে তাঁর চাকরি চলে যায়। একে সামান্য বেতনের কেরানীর চাকরি তার ওপর অত বড় সংসার তার ওপর চাকরি চলে যাওয়া, ইস কী যে দুঃখকষ্টের দিন সেসব! প্রতিদিন সকালে মাকে দেখতাম সংসারে আজ চুলো জ্বলবে কী জ্বলবে না, ওই নিয়ে উৎকণ্ঠিত। বাবাকে দেখতাম চারদিক থেকে মার খাওয়া বোবা জন্তুর মতো দিশেহারা।’

একই লেখায় তিনি অকপটে বলছেন, ‘জিন্দাবাহার এলাকায় তখনও ইলেকট্রিসিটি পৌঁছায়নি। সন্ধ্যাবেলা গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা লাইটপোস্টের মাথায় হারিকেনের মতো একখানা আলো জ্বালিয়ে যেত বাড়িঅলা। তার হাতে থাকত কেরোসিনের বালতি, কাঁধে মই। মই বেয়ে ওপরে উঠে আলো জ্বালাত সে। ওই সামান্য আলায়ও বেশ আলোকিত হতো গলিটি। কিন্তু আমাদের সেই জীবনে বিন্দুমাত্র আলো ছিল না, জীবন ছিল গভীর অন্ধকারে। বেশিরভাগ দিন সকালে নাশতা হতো না আমাদের। তিনবার বাজার সারার পরও পেটে গভীর খিদে নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতাম আমি।’

ইমদাদুল হক মিলন নিজের লেখালেখি নিয়েও যে খুব পাবলিসিটি করেন, তা বলা যাবে না। বিষয়টি নিয়ে অসহ্য রকম নির্বিকারই থাকেন তিনি। তার লেখালেখি নিয়ে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে জাহিরও করতে দেখিনি কখনো। গত দুই-আড়াই দশকে লেখালেখির ক্ষেত্রে কিছু গোষ্ঠীবদ্ধ লেখককে যে রকম নির্লজ্জভাবে ‘লাল্লু-পাল্লু’ নিয়ে মাতোয়ারা থাকতে দেখেছি, তাতে ধরেই নিয়েছি লেখকদের বুঝি পরিচিতি কিংবা পুরস্কার-টুরস্কার পেতে এসবের কসরতই করতে হয়। এরা সীমাহীন বেহায়ার মতো নিজেরাই নিজেদের রচনা যেসব রচনাকে ম্যাক্সিম গোর্কি-মার্কেজের চেয়েও উপাদেয় বলে জাহির করে বেড়াত। শুধু তা-ই নয়, এরা নিজেদের লেখা নিয়ে নামে-বেনামে [আবদুল আলিমের নামটি কাল্পনিক, কেউ ইচ্ছে এই নামের পরিবর্তনও করতে পারেন] গল্পে সমাজ বাস্তবতা কিংবা ‘সমকালীন বাংলা সাহিত্যে আবদুল আলিম অপ্রতিদ্বন্দ্বী’ কিংবা ‘এ বছর সাহিত্যে বাংলা একাডেমি পেতে যাচ্ছেন আবদুল আলিম’ জাতীয় লেখা লিখে নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার কসরত করে।

ইমদাদুল হক মিলনকে সব সময় দেখেছি একান্ত নিজের মতো থাকতে। নিজেকে খুব বড় লেখক ভাবেন এমন হামবড়া ভাবও কখনো তাকে তার শত্রুরাও করতে দেখেননি। তবে তিনি সবসময় ধোপ ধুরস্থ, ফ্যাশনেবল। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে স্মার্ট লেখক তিনি। এখন পর্যন্ত তা বহাল রেখেছেন। সাধারণ বাঙালির যা গড় উচ্চতা তিনিও তা-ই ধারণ করেন কিন্তু লেখালেখির বাইরেও চলনে-বলনে, পোশাক-পরিচ্ছদে তিনি তার উচ্চতা নিয়ে গেছেন অন্যদের চেয়ে অনেক ওপরে। তার এই অনন্য উচ্চতা তাকে এনে দিয়েছে এক ভিন্ন মাত্রা। যেখানে ইমদাদুল হক মিলনের প্রতিদ্বন্দ্বী তিনি নিজে।

দুই.

ছোটবেলায় লেখক সম্পর্কে আমার ধারণা খুব একটা ধারণা-টারনা ছিল না। বইতে কবি-লেখক সম্পর্কে যতটুকু পড়েছি কিংবা তাদের ছবি-টবি দেখেছি, তাতে করে আমার ধারণায় লেখক মানে ‘লুথা’ জাতীয় কিছু একটা হবে।

লুথা?

হ্যাঁ, লুথাই। লুথা মানে শ্লথ গতিসম্পন্ন। ভাঙাচোরা। কাঠ বডি। পানসে। আহারে-উহুরে স্বরে শব্দ করা মিনমিনে জাতীয় মানুষ। কলোনির মিশ্র সংস্কৃতিতে বড় হওয়ার দৌলতে নানা ভাষার মিশেলে কথা বলার চল ছিল। আজিমপুর কলোনিতে থাকাকালীন লুথার মতো আরও বিচিত্র সব শব্দ আমাদের ভা-ারে জমা ছিল।

নিতান্ত বালকবেলায় প্রথমে আমার মা মারা গেলেন। মা মারা যাওয়ার পঞ্চাশ দিনের মাথায় আমার দিব্যি সুস্থ-সবল পিতৃদেব মাকে অন্ধ ভিখিরির মতো অনুসরণ করলে আমরা ছয় ভাইবোন অকূলদরিয়ার মধ্যে নিপতিত হলাম। আমার বড় তিন ভাই, আমার ছোট দুই ভাই আর এক বোন। আমাদের সেই ঘোর বিপদের দিনে আমার বাবার দয়াদাক্ষিণ্যে বড় হওয়া চাচারা চরম উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছেন। এদিকে মাস গেলে বাড়ি ভাড়া জমে যাচ্ছে। সংসার খরচ। আমাদের এতগুলো ভাইবোনের থাকা-খাওয়া ও পড়াশোনার ব্যয়ভার মেটাতে নানি পেরেশান হয়ে যাচ্ছিলেন। কী করবেন হিসাব মেলাতে পারছিলেন না নানি। শেষে একদিন বসু বাজার লেনের ভাড়াবাড়ি থেকে এক বিকেলে ভাড়া করা ট্রাকে আমার নানি তার বড় মেয়ের সাজানো সংসার নিয়ে তুললেন নিজের বাড়িতে। আজিমপুর কলোনির দুই নম্বর বিল্ডিং। দুই ঘরের বাড়িতে নানা, চার খালা, চার মামা আর আমরা এতগুলো ভাইবোন মিলে গাদাগাদি করে থাকতাম। খাটের তলায় বিছানায় করেও রাত কাটাতে হতো আমাদের। কখনো কখনো কলোনির কেউ ঈদের ছুটিছাটায় দেশগ্রামে গেলে তাদের বাড়ি পাহারা দেওয়ার মহান দায়িত্ব যেচে নানি নিতেন। এখন বুঝি আমার নানি কেন সেই দায়িত্ব নিতেন। নানিবাড়িতে অনেক বইপত্র। ম্যাগাজিন। নানার ছিল ব্যাপক পড়ার অভ্যাস।

একবার। তখন আমি কলেজে পড়ি। ১৯৮৫ সাল। বিচিত্রার ঈদ সংখ্যায় একটা উপন্যাস পড়ে আমার মাথা আউলা হয়ে গেল। উপন্যাসের নাম ‘টোপ’? ইমদাদুল হক মিলন তার লেখক। লেখাটা পড়ে আমি এই লেখক সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠলাম। হন্যে হয়ে এ লেখকের বই খুঁজতে লাগলাম। আমাদের পাশের বিল্ডিংয়ে থাকে শাহ আলম ভাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। তিনি নিজেও ‘টুক-টাক’, লেখালেখি করেন। একটা লেখক-লেখক ভাব নিয়ে হেঁটে বেড়ান। তার সংগ্রহে নাকি অনেক বই! শাহ আলম ভাই মেয়েদের মতো হাঁটেন, বইয়ের ভাষায় কথা বলেন, আর সব সময় সেজেগুজে থাকেন। শাহ আলম ভাই মানেই সব সময় পাঞ্জাবি-পায়জামা, চটি স্যান্ডেল শীত-গ্রীষ্মের কোনো বালাই নেইÑ সব সিজনেই তার গলায় থাকে পাতলা শাল। ভাবটা এরকম, ওলো সই, তোরা আমাকে ধরিস নে গো ধরিস নে। সংগত কারণেই তাই কলোনির ছেলেমেয়েরা আড়ালে-অবডালে শাহ আলম ভাইকে হিজ মাস্টার্স ভয়েজ বলে ডাকে। প্রকাশ্যে হিজড়া বা ছাইয়া নামে তো আর কাউকে ডাকা যায় না।

একদিন শাহ আলম ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই আপনার কাছে কি ইমদাদুল হক মিলনের বই আছে? আমার কথা শুনে তিনি আমার দিকে এমন করে তাকালেন, যেন আমি অদ্ভুত কিছু একটা বলে ফেলেছি।

আমার কথায় শাহ আলম ভাই খ্যাক খ্যাক করে উঠলেন, তুমি আর লেখক খুঁজে পেলে না? শোনো, আমি আমার সেলফে হালকা জাতীয় বই-ফই রাখি না। শোনো, সময় করে এসো আমার আছে, বেশ ভারী ভারী বই আছেÑ পছন্দ করে নিয়ে পড়ো। এসব বই পড়লে তোমার ভেতর জীবনবোধ- বলে তিনি একটু পজ দিলেন, মানে তোমার মধ্যে বাস্তবতা তৈরি হবে। কথাগুলো বলার সময় তিনি বেশ কাঁধ ঝাঁকিয়েছিলেনÑ খেয়াল পড়ে।

হিজ মাস্টার্স বয়েজ-এর ‘বাণী চিরন্তনী’ টাইপের কথা আমার ভালো লাগেনি। নয় বছর বয়সে বাবা-মাকে হারানো, মানুষের বিচিত্র মুখ দেখতে দেখতে আমার ভেতরে এমনিতেই একধরনের উপচে পড়া জীবনবোধ তৈরি হয়ে গেছে। আর এ ভদ্রলোক বলে কিনা জীবনবোধ তৈরি হবে! মেজাজ খিচাং হয়ে গেল আমার।

আমি তার কথা থামিয়ে দিয়ে বললাম, ভাই আমার জীবনবোধ তৈরি করার দরকার নাই। আপনাকে কষ্ট করে লেকচার দিতে হবে না। এসব হিজ মাস্টার্স ভয়েজ মার্কা প্যানপ্যানানি আমার ভালো লাগে না।

আমার কথায় শাহ আলম ভাই বেশ ঘাবড়ে গেলেন। ভালো করে তাকালেন আমার দিকে। কলোনির ছেলেপেলেরা একটু বেয়াড়া ধরনের হয়Ñ সম্ভবত এ ব্যাপারটা তার জানা ছিল না। তাই আমার সঙ্গে তিনি আর কথা বাড়ালেন না।

আমি তাকে পশ্চাতে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিলাম। পরবর্তী সময়ে ভারী ভারী বই সংগ্রহে থাকা এই ভদ্রলোককে আজিজ মার্কেট, বইমেলা, কাঁটাবন, পাবলিক লাইব্রেরি, ছবির হাটসহ বিভিন্ন জায়গায় অযথা পা-িত্য ফলাতে দেখেছি; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করতে পারেননি। কলেজে পড়ার সময় শাহবাগে, শেখ সাহেব বাজার, এনায়েতগঞ্জ, নীলাম্বর সাহা রোড, হাজারীবাগ, জগন্নাথ সাহা রোড, বিষ্ণুচরণ স্ট্রিট এলাকায় প্রচুর আড্ডা মেরেছি। সাঈদ ভাই নামের এক রসিক বড় ভাই মাঝেমধ্যে যেচে পড়ে আমাদের আড্ডায় শামিল হতেন। বনেদি ঢাকাইয়া। সাঈদ ভাইয়ের কথা শুনলে মন ভরে যায়। গল্প-উপন্যাস পড়ার বাতিকও তার আছে অল্প বিস্তর। তিনি জানেন আমি লেখালেখি করি। একদিন সাঈদ ভাইকে হিজ মাস্টার্স ভয়েজের পুরো ঘটনাটি খুলে বললাম। শোনার পর সাঈদ ভাই পুরান ঢাকার ভাষায় বললেন, হুনো মিয়া তুমগো ঐ শাহ আলম মার্কা মানুষগো আমার পার্টস-এ পার্টস-এ চেনা আছে। এই হালারা পারে না ইয়া ছিড়তে, উইঠা থাকে বিয়ান রাইতে।

সাঈদ ভাইয়ের সেদিনের সেই কথাটা আমার বেশ মনে ধরেছে। শিল্প সাহিত্য নিয়ে ‘বিয়ান রাইতে উইঠা থাকে’ ধরনের উজবুক তখনও ছিল। এখনও আছে। সম্ভবত এরা কালে কালে থাকবে। এদের বিনাশ নেই।

তিন. ও জি চন্দন। মানে হলো ওবায়দুল গণি চন্দন। ও আমার খুব কাছের বন্ধু। সারাক্ষণ চারপাশ মাতিয়ে রাখার দুর্দান্ত ক্ষমতা রয়েছে ওর। আমরা বন্ধুরা চন্দনকে নিয়ে বলাবলি করি, চন্দন আমাদের মধ্যে থাকলে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। কথা বলার দায়িত্বটা সে স্বেচ্ছায় কাঁধে নিয়ে নেবে। আর ও এত মজার মজার কথা যে কোত্থেকে শিখল, আল্লাই জানে! ও যখন কথা বলতে থাকে তখন ওর মধ্যে অন্য একধরনের ব্যাপার-স্যাপার কাজ করে। কখনো আক্রমণাত্মক, কখনো রক্ষণাত্মক, কখনো বল্গাহীন আবেগে কথা বলত চন্দন। আর ওর বন্ধু ভাগ্যও বেশ। চন্দনকে প্রায়ই দেখতাম নতুন নতুন বন্ধ-বান্ধব নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ও। ওর এই ব্যাপারটা বেশি ঘটত বইমেলায়। ওর এ রকম ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ টাইপের বন্ধু দেখে মাঝেমধ্যে আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতাম আর ভাবতাম, যাক, কয়েক দিনের জন্য চন্দনের সীমাহীন বকবক থেকে তো অন্তত রেহাই পাওয়া গেল।

১৯৯৪ সালে চন্দনকে দেখলাম হ্যাংলা-পাতলা টাইপের এক বন্ধুকে নিয়ে বইমেলায় ঢুকছে। চন্দনের মুখোমুখি হতেই ও পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, বন্ধু, ওর নাম বাদল। চন্দন সব সময় ওর বন্ধুদের ‘বন্ধু’ বলে সম্বোধন করে। চন্দনের এই বন্ধু বলে ডাক দেওয়ার মধ্যে আলাদা একটা মায়া ছিল।

বাদল চন্দনের কথায় কাচুমাচু। বোঝাই যায় বেশ লাজুক। পরনে জিনসের প্যান্ট। টাইট করে বাঁধা। ফুলহাতা শার্ট ইন করে পরা। পায়ে মডেলের কেডস। আর বাদলের গোঁফটাও বেশ দেখার মতো। গোঁফের দুদিকে কোনো হেরফের নেই। বাদলের এই অসহ্য পরিমিত মাপের গোঁফ দেখে আমার মনে হয়েছিল, বাদল বুঝি গোঁফ সাইজ করার সময় গজ-ফিতা নিয়ে বসে। তা না হলে দুদিকে নির্ভুল সমান হয় কী করে! ক্লিন শেভড।

বইমেলায় কয়েক দিন আড্ডা দেওয়ার পর বাদলের সঙ্গে কেমন করে যেন আমারও বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল। বইমেলায় এলে আমরা আড্ডা দিতাম। চা খেতাম। তখনও জানি না বাদল ইমদাদুল হক মিলনের ছোট ভাই। প্রথম দিন ওর কথা আমার কানে বাজল। আমি বাদলকে বললাম, আপনার বাড়ি বুঝি বিক্রমপুর!

আমার কথায় বাদল বেশ খুশি, ক্যান বিক্রমপুরের ভাষা কী বোঝন যায়?

না বুঝলে কইলাম ক্যামনে? আমার নানিগো বাড়ি বিক্রমপুরÑ এই ভাষা চিনন যায়।

এরপর বাদলের সঙ্গে আমার দূরত্ব কমে যায়। আপনি থেকে তুমি।

যেদিন চন্দনের কাছে জানলাম বাদল মিলন ভাইয়ের ছোট ভাই, সেদিন আমি বাদলকে মুখ ফসকে বলে ফেললাম, এর লাইগ্যাই তো কই তোমার চেহারার মইধ্যে হেই ধরনের একখান ছাপ পাওন যায়Ñ

কোন ধরনের ছাপ? বাদল বেশ অবাক।

মিলন ভাই-মিলন ভাই ধরনের একটা ছাপÑ

আমি হের ভাই লাগি না? ছাপ তো পড়বোই।

গর্বে বাদলের চোখ-মুখ ঝিকিয়ে উঠল।

চন্দন এবার বাদলের দিকে তাকিয়ে আমাকে বলল, হুনো বন্ধু, আজিরা কথা কয়া লাভ নাই। বাদল হইলো বিক্রমপুরের অরিজিনাল পোলা আর তুমি হইলা ফলস।

বাদল এবার চন্দনের কথায় বলে উঠল, চন্দন, তুমি কি জানো, আমগো অঞ্চলে একটা কথা আছেÑ ‘বিক্রমপুরের পোলা, আশি টাকা তোলা।’ বাদলের মুখে তখন শিশুর মতো সরলতা।

শিশুর মতো সরলতায় মোড়ানো বাদলের মুখ এখনও আমার মনে পড়ে। বাদলকে দেখে বোঝা যেত না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে বাদল অনেক অসুখ বাঁধিয়ে ফেলেছিল। ডায়াবেটিসের তীব্র ধকল বাদল সহ্য করতে পারেনি। ’৯৮ সালে আমার বন্ধু বাদল হাসপাতালে মারা গেছে। বাদল বয়সে অনেক বড় কিন্তু তারপরও কীভাবে যেন আমাদের বন্ধু হয়ে গেল, সেটা সত্যিই বিস্ময়কর। বাদল মারা যাওয়ার পর চন্দনকে দেখলে বাদলের কথা মনে পড়ত আমার। দেখতে দেখতে অনেক বছর পেরিয়ে গেল। চন্দনের কোনো পরিবর্তন নেই। ও আগের মতো হাতের সামনে যাকে পায় তাকেই ‘সাইজ’ করে। অনর্গল কথা বলে। নন স্টপ। চন্দন যে কতবার আমাকে ‘সাইজ’ করেছে, তার সাক্ষী অনেকেই। চন্দন যখন আমাকে ইচ্ছেমতো সাইজ করত তখন আমি ইচ্ছে করেই ‘রা-শব্দ’ করতাম না। আমি জানতাম আমার এই বন্ধু ভেতরে ভেতরে আসলে খুবই একা। গত বছরের আগস্ট মাসে চন্দনও একা একা বাদলের পথে হাঁটা ধরল।

এখনও বইমেলায় ঢুকলে আমার বাদলের কথা খুব করে মনে হয়। মনে হয় ভিড় ঠেলে কোত্থেকে বুঝি বাদল এসে দাঁড়াবে আমার সামনে। ছোটখাটো গড়নের, পরিপাটি বেশভূষায় বাদল হেসে দিয়ে বলবে, বন্ধু কহন আইলা মেলায়? আমি আইছি হেই কুন সময়? একদিন বাদলের কথা মিলন ভাইকে বলতেই দেখি মুহূর্তে মিলন ভাইয়ের চেহারা কেমন যেন হয়ে গেল। মিলন ভাই আমার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। আমি কথা ঘুরিয়ে অন্যদিকে নিয়ে গেলাম। মিলন ভাই সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন ব্যাপারটা। পরে বাদলকে নিয়ে ‘বাদলের মুখ’ শিরোনামে মিলন ভাই একটি অসাধারণ লেখা লিখেছিলেন। সেই লেখাটা পড়লে বুকটা আপনা-আপনি হিম হয়ে যায়।

চার. ইমদাদুল হক মিলন তার যাপিত জীবনে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই না গেছেন, সেটা তার স্মৃতিচারণামূলক লেখাগুলোতে পাওয়া যায়। শুধু কি স্মৃতিচারণামূলক লেখায়? না, তার অসংখ্য লেখায় এসব প্রসঙ্গ উঠে এসেছে, যেগুলো পাঠ করে কখনো কখনো চোখের পানি আটকে রাখাও কষ্টকর হয়ে পড়ে। ১৯৭৯ সালের অক্টোবর ভাগ্যের অšে¦ষণে জার্মানিতে গিয়েছিলেন। ‘কোথায় ছিল পরাধীনতা’য় ইমদাদুল হক মিলন তার প্রবাস দিনের দুঃখমাখা কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছেন, ‘একদিন বিকেলে কাজ শেষ করে বাসস্ট্যান্ডে বসে আছি। সিনডেলফিনগেন থেকে স্টুটগার্টে ফিরব। আমার পাশে বসে আছেন একজন জার্মান বৃদ্ধা। তত দিনে টুকটাক জার্মান বলতে শিখেছি। বৃদ্ধা আমাকে টুকটাক কথা জিজ্ঞেস করছেন, আমি জবাব দিচ্ছি। তিনি যাবেন এক জায়গায়, আমি অন্যত্র। দুজনের দুই বাস। বৃদ্ধার বাস আগে চলে এলো। বাসে ওঠার আগে তিনি আমার হাতে একটা পাঁচ মার্কের কয়েন গুঁজে দিলেন। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি বাস চলে গেছে। কয়েক হাতে নিয়ে হতভম্ভ হয়ে বসে থাকি। বৃদ্ধা আমাকে এতই দরিদ্র ভেবেছেন যে পাঁচটি মার্ক ভিক্ষে দিয়ে গেলেন। কয়েনটা রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে হু হু করে কেঁদেছিলাম আমি।’

ইমদাদুল হক মিলনকে আমি নানা কারণে শ্রদ্ধা করি। পছন্দও করি। অসম্ভব স্মার্ট, ব্যক্তিত্ববান আর স্ট্রেইট কাট কথা বলেন। কখনো কখনো তাকে দেখে আমার ভ্রম হয়, এই মানুষটি যদি ইউরোপে জন্মাতেন! দীর্ঘদিন মিলন ভাইকে জানি, চিনিÑ তাতে করে বলতে পারি, তিনি যার সঙ্গে কথা বলবেন তার মধ্যে একধরনের ভাবান্তর হতে বাধ্য। মিলন ভাইয়ের মধ্যে একটা অদ্ভুত জাদু আছে। এই জাদুর ছোঁয়ায় তিনি সবাইকে মুগ্ধ করতে পারেন। মানুষকে মুগ্ধ করতে পারা একধরনের সুন্নত। এটা মিলন ভাই পারেন। সবাই পারে না।

মিলন ভাইয়ের সাহিত্য নিয়ে মূল্যায়ন করা কঠিন। কঠিন এ কাজ করার মহান (!) দায়িত্ব সমালোচকদের। তাদের মাথায় অনেক বুদ্ধি-বিচার। একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে আমি মিলন ভাইয়ের সব লেখায় মুগ্ধ। ‘ও রাধা ও কৃষ্ণ’, ‘ভালবাসার সুখ-দুঃখ’ ‘ভালবাসার গল্প’, ‘হে প্রেম’, ‘যত দূরে যাই’, ‘দিনগুলি’, ‘অভিমান পর্ব’, ‘এত যে তোমায় ভালবেসেছি’ থেকে শুরু করে ‘যাবজ্জীবন’, ‘কালাকাল’, ‘পরাধীনতা’, ‘পরবাস’, ‘অধিবাস’, ‘নিরন্নের কাল’, ‘কালোঘোড়া’, ‘নদী উপাখ্যান’, ‘ভূমিকা’, ‘ভূমিপত্র’, ‘বাঁকা জল’, ‘নূরজাহান’, ‘দেশভাগের পর’Ñ তার সব লেখায়ই আমি বুঁদ হয়ে থাকি।

লেখক যখন একজন ভালো মানুষ হয়ে যায়, তখন সেই লেখকের কোনো লেখাই আর খারাপ লাগে না। কারণ সেই লেখকের লেখায় আমি আমার প্রয়োজনীয় সব পাই। সব। সব। সব। আমি অনেক স্বঘোষিত মিলন-বিরোধিতাকারীদের মেনি বেড়ালের মতো তার সামনে মিউ মিউ করতে দেখেছি কারণ-অকারণে।

পাঁচ. জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে কিংবা ব্যর্থতার গ্লানি মুছতে জীবনের না মেলানো হিসাব মেলানোতে দশ বছর মিলানোতে ‘কামলা’ দিতে হয়েছে আমাকেও। তখন দেখেছি প্রবাসজীবনের বিচিত্র চালচিত্র, করুণ উপাখ্যান। প্রবাসজীবনের কষ্টকর প্রতিটি মুহূর্তে আমাকে সাহস জুগিয়েছেন ইমদাদুল হক মিলন। প্রেরণাও জুগিয়েছেন।

জাতি হিসেবে ইতালিয়ানরা খুবই সহমর্মী। সমব্যথী তো বটেই। তাদের চলন-বলন, আচার-ব্যবহার আড্ডাবাজ বাঙালিদের মতোই। ইতালিয়ান বুড়োবুড়িরা সারাদিন বার-ক্যাফেতে বসে আড্ডা মারে। তাস খেলে। বিড়ি-সিগারেট খায়। আর কথায় কথায় গালাগাল করে। আরও একটা ব্যাপার, এরা অনর্গল হাত-পা, শরীর নাচিয়ে নাচিয়ে কথা বলে। কেউ যদি ইতালিয়ানদের হাত-পা বেঁধে রাখে তাহলে এরা কথা বলতে পারবে না। শুধু মুখ দিয়ে নয়, এরা হাত-পা দিয়েও কথা বলে। আমাদের পুরান ঢাকার মানুষরা যেমন আন্তরিক, রসিক এরাও তেমনি। ইতালিয়ান ভাষা অনেকটা মিউজিকের মতো। এদের কথা শুনলে গান শোনার কাজ হয়ে যায়। ওরা কথায় কথায় প্রেগো, গ্রাৎসে বলে। বলে বেনভেনুতো। প্রেগো মানে স্বাগতম। গ্রাৎসে মানে ধন্যবাদ। বেনভেনুতো মানে অভিনন্দন। বাঙালিরা ইতালিতে গেলে চলতে-ফিরতে পারার জন্য যতটা ভাষার প্রয়োজন, ততটুকুই শেখে। কেউ কেউ এর ব্যতিক্রম। আমিও টুক-টুাক ইতালিয়ান শিখেছিলাম।

একদিন বিক্রমপুরের এক ছেলে মিলানোর বাংলা পাড়া কাইয়াৎসোতে আমাকে একা পেয়ে বলল, ভাই কি ইমদাদুল হক মিলনরে চিনেন?

আমি তো অবাক! এই মিলানোতেও মিলন ভাইয়ের ভক্ত!

পেরকে নো? (কেন নয়?) লুই কনোশে মে (উনি আমাকে চেনেন)।

আমার কথা শুনে কম বয়সী ছেলেটি আমাকে পারে তো জড়িয়ে ধরে, ভাই আপনারে আমি এক কাপ কফি খাওয়াইতে চাই?

কেন আপনি আমাকে কফি খাওয়াবেন?

আপনে মিলন ভাইরে চিনেন হের লাইগা। ছেলেটির চোখে মুখে সারল্য।

ছেলেটা আমাকে প্রায় জোর করেই একটা চায়না বারে নিয়ে গেল।

জিজ্ঞেস করলাম, কী করো?

ছেলেটি বলল, ফুল বিক্রি করি।

ইতালিতে ফুল বিক্রি করে আয়-উপার্জন করা খুবই কষ্টের কাজ। সারা রাত হেঁটে হেঁটে বার-রেস্টুরেন্ট-ডিসকোটেকাতে ফুল বিক্রি করা খুব পরিশ্রমের কাজ। ভাগ্য ভালো হলে এক রাতে একশ-দেড়শ ইউরো আর কপাল খারাপ হলে সেনসা। সেনসা মানে খালি হাতে ঘরে ফেরা। ইতালিতে বলাই হয়, ফুল বিক্রির টাকা আর রক্ত বেচা টাকা একই কথা। অবশ্য প্রবাসে সব কাজের ক্ষেত্রেই এ কথা খাটে।

খাওয়া শেষ। আমি পয়সা দিতে চাইলাম। ছেলেটি কিছুতেই মানল না। বার থেকে বেরিয়ে এলাম। সন্ধ্যা নামছে। ছেলেটা বিদায় নিয়ে চলে গেল। আমি ছেলেটার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ছেলেটা হেঁটে হেঁটে চলে যেতে থাকল। দেশ থেকে সুদূর ইতালিতে আমি একজনের ফুল বিক্রির টাকা দিয়ে এক কাপ কফি খেলাম। তা-ও ইমদাদুল হক মিলনের কল্যাণে। দেশ থেকে এত দূরেও ইমদাদুল হক মিলন তার লেখা দিয়ে, তার গুণ দিয়ে আরেকজনকে মুগ্ধ করেছে। এখানেই লেখকের সাফল্য। এখানেই ইমদাদুল হক মিলন অনন্য।

লেখক: মাহবুব রেজা, সাংবাদিক ও কথা সাহিত্যিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :