৪৬ বছর পরে কেমন আছে বাংলাদেশ?

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৮:০৭

সাতচল্লিশতম বিজয় দিবস উদযাপন করল বাংলাদেশ। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরে এসে কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ? শোষণ ও বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বাঙালি জাতি কতটুকু সফল হতে পেরেছে? এমন জিজ্ঞাসা রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের। নাগরিকের এ প্রশ্ন যেমন নিজের কাছে, তেমনি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক ও নীতি-পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের কাছে। দেশের রাজনীতিবিদ, আমলা, বুদ্ধিজীবীদের এ প্রশ্নের যথাযথ উত্তর খুঁজে বের করে নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের সামনে তুলে ধরতে হবে। না হলে মানুষ দ্বিধান্বিত হবে। স্বাধীনতার গূঢ়ার্থ পরিষ্কার না হলে স্বপ্ন বাঁচবে না। স্বপ্ন না থাকলে ভবিষ্যৎ থাকে না।

১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২০ সালে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম হয় বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। ছোটবেলা থেকে মুসলমানদের দুর্দশা দেখতে দেখতে বড় হয়েছেন তিনি। অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থের পাতায় পাতায় সে সময়কার পরিস্থিতি বর্ণনা করেছেন তিনি। মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছিল কংগ্রেসের সাম্প্রদায়িক তৎপরতার পাল্টা জবাব দেয়ার জন্য। মুসলিম লীগে দুই গ্রুপ ছিল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের নেতৃত্বাধীন গ্রুপটি ছিল শান্তিপ্রিয়, মানবতাবাদী আর অসাম্প্রদায়িক। অন্যদিকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন গ্রুপটি ছিল ধূর্ত এবং বাঙালি-বিদ্বেষী। মুসলিম লীগের জিন্নাহ আর কংগ্রেসের জহরলাল নেহেরু, ব্রিটিশ প্রতিনিধি রেডক্লিফের যোগসাজশে নিজেদের সুবিধামত উপমহাদেশকে ভাগ করে ফেলে।

২৭ বছরের যুবক শেখ মুজিব কিংবা তাঁর সহকর্মীদের পক্ষে সে ষড়যন্ত্র রুখে দেয়া সম্ভব হয়নি। বাঙালীর আলাদা রাষ্ট্র কায়েমের জন্য সে সময়ই সমমনাদের নিয়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। কথা ছিল, বাঙালীর আলাদা রাষ্ট্র হবে এবং জনসাধারণ ভোটের মাধ্যমে নির্ধারণ করবে পাকিস্তান, না ভারতের সাথে যাবে। এমন মহান একটি প্রক্রিয়ার মৃত্যু ঘটে ভারত ও পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক শক্তির জন্য। চালাকি করে পূর্ববঙ্গকে পাকিস্তানের সাথে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

বাঙালীর পৃথক রাষ্ট্র কায়েমের প্রচেষ্টা একদিনের জন্যও ক্ষান্ত দেননি শেখ মুজিব। মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগ, অতঃপর আওয়ামী লীগ হয়ে উঠার পুরো প্রক্রিয়ায় শেখ মুজিবের সম্পৃক্ততা ছিল সময়োচিত এবং নেতৃস্থানীয়। পাকিস্তান আমলে ২৪ বছরের মধ্যে ১৪ বছর জেল খেটেছেন তিনি। ৭ মার্চ, ১৯৭১ তারিখেই অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ২৫ শে মার্চ তারিখে রাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাঙালি নিধনযজ্ঞ শুরু করে এবং ২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে।

তবে গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ২৭ শে মার্চ সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন মেজর জিয়াউর রহমান। এপ্রিলে মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। সাধারণ মানুষ, মুক্তিবাহিনী, সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী আর ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বাধীন দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে রাষ্ট্র ও জাতিগঠন প্রক্রিয়ার রোডম্যাপ ঘোষণা করেন। একটি দুর্নীতি ও বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র ও সমাজ নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র আর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে সমাজতন্ত্র কায়েম করতে চেয়েছিলেন তিনি। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করে দিয়েছিলেন তিনি। ১০০ বিঘার উপর কারও যদি জমি থাকে, তাহলে সে জমি কেড়ে নিয়ে গরীব কৃষক-শ্রমিকের মাঝে সমবায়ের ভিত্তিতে বিলিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন তিনি। গরীব-দুঃখী মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের জন্য সব পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন। কিন্তু পরিকল্পনা করে ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে প্রায় সপরিবারে হত্যা করা হয়। ৩রা নভেম্বর হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতা-সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, এএইচএম কামরুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে।

উল্টো দিকে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যারা আমাদের বিরুদ্ধে ছিলেন, তাদেরকে নতুন করে পুনর্বাসন করা হয়। জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের অন্যতম নির্দেশদাতা ছিলেন। জিয়াউর রহমানও স্বাভাবিকভাবে মরতে পারেন নি। আরেক সামরিক শাসক হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদও যুদ্ধাপরাধী, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুনর্বাসন অব্যাহত রাখেন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী এরশাদের পতন হলে নতুন করে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ। গেল ২৭ বছরে কোন সরকারের আমলে কতটুকু উন্নয়ন হয়েছে, তার তুলনামূলক চিত্র উপস্থাপন করলে ভালো হত। কিন্তু এ কাজটি করার কথা দেশের অর্থনীতিবিদদের। আমরা সাধারণ মানুষ চোখের সামনে যা দেখি তাই বলি।

মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৯৭৫ সালে ক্ষমতা হারিয়ে ২১ বছর পরে ফিরে আসে ১৯৯৬ সালে। শিক্ষা বিস্তার, বিদ্যুৎ উৎপাদন, স্বাস্থ্যখাতসহ নানা ক্ষেত্রে যুগান্তকারী সব পদক্ষেপ নিয়েছিল সে আওয়ামীলীগ সরকার। যেমন প্রতি ৬ হাজার মানুষের জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন শুরু করেছিল সে সময়কার আওয়ামীলীগ সরকার। পরে বিএনপি এসে সব প্রকল্প বন্ধ করে দেয়। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিএনপি-জামাত জোটের আমলে দেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে। রাজশাহীর ‘বাংলা ভাই’ নামের জঙ্গি নেতা কিংবা ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলা সে সময়কার দুঃস্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত চরম অরাজক পরিস্থিতি মোকাবেলায় দৃশ্যপটে হাজির হয় সেনাবাহিনী। প্রায় দুই বছর সামরিক মদদপুষ্ট তত্তাবধায়ক সরকার দেশ শাসন করে নির্বাচন দিয়ে বিদায় নেয়। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সে নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের শুরুতেই বিডিআর বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। সে ধাক্কা সামলে উঠে টানা ৯ বছর ধরে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের সাফল্য কতটুকু, ব্যর্থতা কতটুকু? বস্তুনিষ্ঠ একটা মূল্যায়ন কে করবে? ২০১৫ সালে ঢাকায় কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ মিলনায়তনে ‘ভারত: উন্নয়ন ও বঞ্চনা’ বইয়ের প্রকাশ উৎসবে নোবেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতসহ মানবিক ক্ষেত্রে উন্নতিতে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে।

খাদ্য উৎপাদন আর সরবরাহে গতি আসার পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। ভারত ও পাকিস্তানে যেখানে গড় আয়ু যথাক্রমে ৬৮ এবং ৬৬ বছর, সেখানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ বছর। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম প্রতিবছর ইনক্লোসিভ ইকোনমিক গ্রোথ ইনডেক্স নামে একটি রিপোর্ট প্রদান করে। ২০১৬ সালের প্রতিবেদন পেশ করা হয় চলতি বছর সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে। 'অন্তর্ভুক্তিকর' প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন সূচকে ভারত ও পাকিস্তান থেকে যথাক্রমে ২৪ ও ১৬ ধাপ এগিয়ে আছে বাংলাদেশ।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০১৭ সালের 'ইনক্লোসিভ গ্রোথ অ্যান্ড ডেভেলাপমেন্ট ইনডেক্স শীর্ষক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামগ্রিক উন্নয়নের মানদণ্ডে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৬তম। অন্যদিকে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রতগতির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেশ ভারতের অবস্থান ৬০ এবং পাকিস্তানের ৫২তম। 'আইডিআই'অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে হিমালয়ের দেশ নেপাল। প্রতিবেদন অনুযায়ী নেপালের অবস্থান ২৭তম।

বিশ্ব ক্ষুধা সূচকেও ভারত-পাকিস্তান থেকে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে দুই ধাপ উন্নতি হয়েছে বাংলাদেশের। ২০১৭ সালের প্রতিবেদনে ৮৮তম অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। এর আগে ২০১৬ সালে ওয়াশিংটনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের করা এই তালিকায় বাংলাদেশ ৯০তম স্থানে ছিল। দক্ষিণ এশিয়ায় ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশের পেছনে রয়েছে ভারত (১০০), পাকিস্তান (১০৬) ও আফগানিস্তান (১০৭)।

১২তম বারের মত বার্ষিক ক্ষুধা সূচক প্রকাশ করা ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট চারটি বিষয়ের ভিত্তিতে এই তালিকা প্রণয়ন করে। সেগুলো হচ্ছে অপুষ্টি, শিশু মৃত্যুহার, এবং তীব্র ও ধারাবাহিক শিশু অপুষ্টির হার। তালিকায় ১১৯টি দেশের অর্ধেকের বেশি আশঙ্কাজনক, বিপর্যয়জনক ও গুরুতর অবস্থায় রয়েছে। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় নেপাল (৭২), মিয়ানমার (৭৭) ও শ্রীলংকার (৮৪) নিচে রয়েছে বাংলাদেশ।

গড় আয়ুতে যেমন বাংলাদেশ এগিয়ে, তেমনি গড় আয়ের দিক থেকেও বাংলাদেশের মেয়েরা ভারত ও পাকিস্তানের মেয়েদের তুলনায় এগিয়ে আছে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশ এবং এ শিল্পে মূলত মেয়েদের কর্মসংস্থান এমন বাস্তবতা তৈরি করেছে। চাইল্ড হাংগার রেট এর হিসেবেও ভারত ও পাকিস্তান থেকে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে এমন পাঁচ বছর বয়সের নীচের শিশুর শতকরা হার বাংলাদেশে ৩৬.১ শতাংশ। ভারত ও পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্র থেকে এ হার বেশি। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুহারও ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশের বেশি। বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুহার ৩৭.৬/১০০০, যা পাকিস্তান থেকে ৫০ এবং ভারত থেকে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ কম।

বাংলাদেশের তরুণ সমাজের ভেতর চাকরির বাজার নিয়ে হতাশা কাজ করে বেশ। তারা হয়ত জানে না যে, স্থিতিশীল চাকরির সংখ্যার বিচারে ভারত ও পাকিস্তান থেকে বেশ এগিয়ে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের নাগরিকদের চাকরির ৮০ ভাগই ‘নাজুক’। অন্যদিকে বাংলাদেশে ৫৭.৮ শতাংশ চাকরি স্থিতিশীল।

সাম্প্রদায়িক সহিংসতার দিক থেকে ভারতের অবস্থান বিশ্বে এখন চতুর্থ। ভারতের উপরে আছে কেবল সিরিয়া, নাইজেরিয়া এবং ইরাক। যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক পিউ রিসার্চ সেন্টার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতিসংঘসহ ১৮টি প্রধান উৎস থেকে তথ্য-উপাত্ত নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করে আসছে ২০০৯ সাল থেকে। সর্বশেষ ২০১৫ সালের রিপোর্টে পিউ রিসার্চ সেন্টার ১৯৮টি দেশের উপর এ জরিপ পরিচালনা করে। সাম্প্রদায়িক নেতা নরেন্দ্র মোদীর দল বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো মুসলমান এবং নিম্নবর্ণের হিন্দুদের উপর অত্যাচার বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়ায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে ভারতে। এই তালিকায় বাংলাদেশের নামই নেই।

সবেচেয়ে বিপদজনক রাষ্ট্রের তালিকায়ও ভারতের অবস্থান উপরের দিকে। গ্লোবাল পিস ইনডেক্স’ ২০১৬ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী ভারতের অবস্থা বুরুন্ডি, সার্বিয়া কিংবা বুরকিনাফাসো এর মত রাষ্ট্র থেকেও খারাপ। শান্তিপূর্ণ দেশের তালিকায় ১৬৩টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ১৪১তম। ভারতের আভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার ফলে ২০১৫ সালে ক্ষতির পরিমাণ ৬৮০ বিলিয়ন ডলার বলে সে রিপোর্টে জানায় অস্ট্রেলিয়া-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্সটিটিউট ফর পিস অ্যান্ড ইকনমিকস। সবচেয়ে বিপদজনক রাষ্ট্রের তালিকায় প্রথম স্থানে আছে সিরিয়া। তারপরে আছে সাউথ সুদান, ইরাক, আফগানিস্তান এবং সোমালিয়া।

এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থা জানেন কত? ভারতের অবস্থান ১৪১তম, বাংলাদেশের ৮৩তম। বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ দেশের তালিকায় ভারত থেকে ৫৮ ধাপ এগিয়ে বাংলাদেশ। সাউথ এশিয়ায় বাংলাদেশের উপরে আছে কেবল ভুটান (১৩তম) এবং নেপাল (৭৮)। অন্যদিকে শ্রীলংকার অবস্থান ৯৭ এবং পাকিস্তানের ১৫৩তম। গ্লোবাল পিস ইনডেক্স রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রায় সম্পূর্ণভাবে দ্বন্দ্ব-সংঘাতমুক্ত দেশ আছে পৃথিবীতে এখন মাত্র ১০টি।

সম্প্রতি বাংলাদেশ মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে পাকিস্তান থেকে এগিয়ে গেছে। যদিও ভারত বাংলাদেশ থেকে এখানে এগিয়ে। বাজার বিনিময় হারের হিসেবে বাংলাদেশের বর্তমান মাথাপিছু আয় এক হাজার পাঁচশ আটত্রিশ মার্কিন ডলার, অন্যদিকে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ এক হাজার চারশ সত্তর ডলার। বিশ্বব্যাংকের এক রিপোর্ট অনুযায়ী ১২ শতাংশ দারিদ্র কমিয়ে আনতে পেরেছে আওয়ামী লীগ সরকার।

নিজের দেশকে আমরা না জেনেই ব্যর্থ মনে করি। আমাদের ইতিবাচক দিকগুলো আমরা মেহসুস করি না। আমাদেরকে জানতে দেয়া হয় না। যদি বলা হয়, ভারত এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকেও বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো, তাহলে আমাদের মনোজগতের উপনিবেশ কি তাতে সায় দেবে? দেবে না। অনেকে হেসেই উড়িয়ে দেবে। কিন্তু বাস্তবতা আসলেই ভিন্ন। হতে পারি আমরা আর্থিকভাবে দরিদ্র, এরপরেও আইন-শৃঙ্খলা, শান্তি-অশান্তির বিচারে অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ থেকে শহর হিসেবে ঢাকা কিংবা রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থা অনেক ভালো।

জাতিসংঘ কর্তৃক প্রকাশিত বিশ্ব ক্রাইম ট্রেন্ড রিপোর্টের ২০১৫ সালের ভার্সন থেকে জানা যায়, প্রতিবছর সবচেয়ে বেশী ধর্ষণের ঘটনা ঘটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ১০টি দেশের তালিকায় এক নম্বর পজিশনে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর নাম্বার টেন পজিশনে আছে ইথিওপিয়া। পাশের দেশ ভারত ধর্ষণকাণ্ডে চতুর্থ স্থান ‘অর্জন’ করে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে শিক্ষিত মানুষের দেশ শ্রীলঙ্কাও ধর্ষণ অপরাধে বিশ্বের অন্যতম বিপদজনক রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তালিকায় ৯ নম্বর স্থানটি শ্রীলংকা। অষ্টম স্থানে আছে আরেক উন্নত রাষ্ট্র কানাডা, সাত নম্বরের রাষ্ট্রটির নাম ইউরোপের ফ্রান্স, ছ’য়ে আছে জার্মানি, পাঁচে যুক্তরাজ্য, চারে ভারত, তিনে সুইডেন, দুই এ সাউথ আফ্রিকা এবং এক নম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

ধর্ষণ ছাড়া খুনের হিসেব করেও জাতিসংঘ নির্দিষ্ট সময় পরপর প্রতিবেদন দিয়ে থাকে। ২০১৩ সালের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১২ সালে সবচেয়ে বেশী মার্ডার হয়েছে ব্রাজিলে (৫০,১০৮টি)। খুনাখুনিতে ব্রাজিলের পরেই আছে ভারত (৪৩,৩৩৫টি)। নাইজেরিয়াতে সে বছর মার্ডারের সংখ্যা রেকর্ড করা হয় ৩৩, ৮১৭ টি, মেক্সিকোতে ২৬,০৩৭টি, কঙ্গোতে ১৮,৫৮৬টি, সাউথ আফ্রিকাতে ১৬,২৫৯টি, কলম্বিয়ায় ১৪,৬৭০টি এবং পাকিস্তানে ১৩,৮৪৬টি।

উপরের পরিসংখ্যান বলে, বাংলাদেশ কোন ব্যর্থ রাষ্ট্র নয়। বরং প্রশাসনিক দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে পারলে, বাংলাদেশ হবে বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ রাষ্ট্র। ৩০ লাখ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে স্বাধীনতার অর্জনের জন্য। দুই লাখ নারীকে সইতে হয়েছে পাশবিক নির্যাতন। এত দাম দিয়ে কেনা স্বাধীনতাকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দিতে পারি না আমরা।

লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :