মুশফিক বীরত্বে বিশ্ব কাঁপানো জয়

ক্রীড়া প্রতিবেদক, কলম্বো, শ্রীলঙ্কা থেকে
| আপডেট : ১১ মার্চ ২০১৮, ১০:১০ | প্রকাশিত : ১১ মার্চ ২০১৮, ০০:০৬

প্রেমদাসার ৩০ হাজার শ্রীলঙ্কান বিস্ময়ে হতবাক, যেন স্তব্ধ হয়ে গেল পুরো গ্যালারি। কিছু আগেই যারা উল্লাসে ফেটে পড়েছিলেন, সেই তাদের চোখেই জল। এটা কী করে সম্ভব? দেশের মাটিতে ২১৪ রান করেও হলো না! বাংলাদেশ যে পারে তারা বুঝে নিলেন আরো একবার। বুঝে গেল বিশ্বও। দুই ওপেনার তামিম ও লিটনের পর মুশফিকের মনে রাখার মতো বীরত্বে (৩৫ বলে ৭২ নট আউট) শ্রীলঙ্কাকে ৫ উইকেটে হারিয়ে দেশের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জয়টি তুলে নিল বাংলাদেশ।

এর আগে ২০০৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১৬৪ রান তাড়া করে জিতেছিল বাংলাদেশ। এতদিন এটাই ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয় (রান তাড়া করার ক্ষেত্রে)।

সর্বোচ্চ স্কোরের নতুন রেকর্ডও হয়েছে এদিন। কিছুদিন আগে এই শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেই ঢাকাতে ৫ উইকেটে ১৯৩ রান করেছিল বাংলাদেশ। টি-টোয়েন্টিতে এটাই ছিল এতদিন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় স্কোর। প্রেমাদাসাতে ২১৫ করে নতুন রেকর্ড গড়েলো বাংলাদেশ।

প্রথমে ব্যাট করে শ্রীলঙ্কা করেছিল ২১৪ রান। জবাবে অনেক নাটকীয়তার পর ২ বল বাকি থাকতে (৫ উইকেট হাতে রেখে) জয় তুলে নেয় বাংলাদেশ।

তামিমের সঙ্গে সাধারণত ওপেন করেন সৌম্য সরকার। কিন্তু সৌম্য ভালো ফর্মে নেই। গত ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ৩৪ রানের লড়াকু ইনিংস খেলেছেন লিটন দাস। তাই আত্মবিশ্বাসে সৌম্যের চেয়ে ভালো জায়গায় ছিলেন লিটন। বাংলাদেশের সামনে ২১৫ রানের বিরাট টার্গেট। টানা হারে এমনিতে পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। হয় মার নয় মর-এই অবস্থা বাংলাদেশের সামনে।

সৌম্যের জায়গায় এদিন লিটনকে ওপেন করতে পাঠানো হয় ৬ ওভারের পাওয়ারপ্লের সুযোগ নেওয়ার জন্য। আর সেই কাজটা প্রত্যাশার চেয়েও ভালো করলেন লিটন। ৫.৫ ওভারে ৭৪ রান তুলে ফেলেন লিটন ও তামিম মিলে। লিটন আর কিছুক্ষণ উইকেটে থাকলেই হয়ে যেত কাজ। কিন্তু দারুণ এক বলে এলবিডব্লিউ হয়ে ফিরতে হয় তাকে। তবে ওপেন করতে নেমে কাজের কাজটি করে দিয়ে যান লিটন। ব্যাট চালান ঠিক ক্রিস গেইলের মতো।

মাত্র ১৯ বলের এক ছোট ইনিংস খেলেছেন এদিন। ১৯ বলে ৪৩ রানের ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস এসেছে লিটনের ব্যাট থেকে। যার মধ্যে চারটি ছক্কা ও ২টি চার। এতটাই নান্দনিকভাবে বল ওভার বাউন্ডারিতে পাঠিয়েছেন, মনে হয়েছে ছক্কা হাঁকানো দুনিয়ার সবচেয়ে সহজ কাজ তার কাছে।

তামিম খেলছিলেন তামিমের মতো। মানে রাজার মতো। কিন্তু থিসারা পেরেরার যে বলে তিনি কট অ্যান্ড বোল্ড হয়েছেন তাতে করার কিছুই ছিল না। করেছেন ২৯ বলে ৪৭ রান, চার ৬টি, ছক্কা ১টি।

ব্যাটিংয়ে ভালো শুরু করে দেন তামিম ইকবাল

গত ম্যাচে ৬ ওভারের পাওয়ারপ্লেতে এসেছিল মাত্র ৪৪ রান। আর লিটন- তামিম মিলে তুলেন ৭৪ রান। তামিম ফিরে যাবার পর সৌম্য সরকারের সঙ্গে জুটি বাঁধেন অভিজ্ঞ মুশফিকের রহিম। প্রাণপণ চেষ্টা ছিল এ জুটির মধ্যেও। তরতর করে রান করে যাচ্ছিলেন তারা। কিন্তু নুয়ান প্রদীপের একটি বল ঠিকমত খেলতে না পেরে ২২ বলে ২৪ রান করে বিদায় নেন সৌম্য।

এদিকে ৯.২ ওভারে ১০০ ও ১৩.৩ ওভারে ১৫০ রান তুলে ফেলে বাংলাদেশ। সৌম্য বিদায় নিলেও মুশফিক খেলছিলেন মুশফিকের মতো। সাবলীল শটে সহজ রান। ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ উইকেটে এসে একটু সময় নিলেন। হাত খুলে ব্যাট চালাতে শুরু করলেন আস্তে আস্তে।

১৭ ওভার শেষে বাংলাদেশের রান ৩ উইকেটে ১৭৭। এদিকে মাত্র ২৪ বলে হাফসেঞ্চুরি পুরণ করে ফেলেন মুশফিক। সঠিক পথেই এগাচ্ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু ১১ বলে ২০ রান করার পর ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে আউট হয়ে যান রিয়াদ। আউট না হয়ে এ বলে ছ্ক্কা হলেই কাজের কাজ হয়ে যেত।

শেষ দুই ওভারে দরকার ১৯ রান। চরম নাটকীয়তা। টান টান উত্তেজনা। প্রথম বলে এলো মাত্র ১ রান। দ্বিতীয় বলে এক রান নিতে গিয়ে রান আউট সাব্বির। ২ বলে ০ করেন তিনি। ব্যস, চাপে পড়ে যায় দল। তবে ওভারের পঞ্চম বলে ছক্কা হাঁকিয়ে আবার আশা বাঁচিয়ে রাখেন মুশফিক।

শেষ ওভারে দরকার ৯ রান। চূড়ান্ত নাটক। উইকেটে মুশফিক ও মিরাজ। বোলিংয়ে থিসারা পেরেরা। প্রথম বল থেকে ২ রান নেন মুশফিক। পরের বলে বসে পড়ে চার। পরের বলে আবার ২। প্রথম তিন বলে ৮ রান। স্কোর লেভেল। হাতে আরও তিন বল। চতুর্থ বলে এক রান দিয়ে বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জয়টি তুলে নেন মুশফিক। ৩৫ বলে ৭২ রানের ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস খেলে অপরাজিত থাকেন মুশফিক।

এরআগে প্রথমে ব্যাট করতে নেশে ৬ উইকেটে ২১৫ রানের বিরাট স্কোর দাঁড় করে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশের বিপক্ষে শ্রীলঙ্কার এটি সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড।

বাংলাদেশি বোলারদের উপর ভয়ানকভাবে চড়াও হন শ্রীলঙ্কার দুই ওপেনার কুশল মেন্ডিস ও গুনাথিলকা। মাঠের চারদিকে চার ছ্ক্কা হাঁকিয়ে মাত্র ৩.৫ ওভারেই ৫০ রান তুলে নেন এ জুটি। দলের রান যখন ৫৫ তখন স্লোয়ার কাটারে গুনাথিলাকাকে ২৬ রানে বোল্ড করেন মোস্তাফিজুর রহমান।

কিন্তু এরপরেও রানের গতি কমানো যায়নি। বিপজ্জনক কুশল মেন্ডিসের সঙ্গে যোগ দেন আরেক কুশল, কুশল মেন্ডিস। দুই কুশল মিলে তাণ্ডব চালাতে থাকেন বাংলাদেশি বোলারদের উপর। তবে নেতৃত্বে ছিলেন অধিনায়ক কুশল মেন্ডিস।

ভারতের বিপক্ষে ৮ বলে ১ রান করেছিলেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। এক পর্যায়ে সেই ৮ বলেই ২২ রানে ব্যাট করছিলেন শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক কুশল মেন্ডিস। এই ২২ রানে যদি থামতেন তবে অনেকটাই বেঁচে যেতে বাংলাদেশ। কিন্তু থামলেন না। মাত্র ১০ ওভারে ৯৮ রান তুলে ফেলে শ্রীলঙ্কা। অনিয়মিত বোলার মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ যখন কুশলকে ফেরালেন তখন কাজের কাজটি করা হয়ে গেছে। ৩০ বলে করে ফেলেছেন ৫৭ রান। এই ওভারেই শানাকাকে শূন্য রানে বিদায় করেন রিয়াদ। এরপর ২ রানে তাসকিনের বলে সাব্বিরের চমৎকার ক্যাচে পরিণিত হন দিনেশ চান্দিমাল। তাতেও রান রেট কমে যায়নি।

কারণ কুশল পেরেরাকে ফেরানো যাচ্ছিলো না কিছুতেই। মাত্র ৩৪ বলে তুলে নেন হাফ সেঞ্চুরি। আউট হন শেষ ওভারের দ্বিতীয় বলে। তার আগে করে যান ৪৮ বলে ৭৪ রান। অন্যদিকে ৩০ বলে ৫৭ করেন কুশল মেন্ডিস। শেষ দিকে টাইফুন ইনিংস খেললেন উপুল থারাঙ্গা। ১৫ বলে ৩২ রান করে থাকেন অপরাজিত।

বাংলাদেশি বোলাররা হাত খুলে রান দিলেন এদিন। ওভার প্রতি সবচেয়ে বেশি রান দিয়েছেন তাসকিন আহমেদ। ৩ ওভারে ৪০ রান দেন তিনি। খুব একটা কম যাননি মোস্তাফিজও। ৪ ওভারে রান ৪৮ দেন কাটার বয়। ৪ ওভারে ৪৫ রান দেন রুবেল।

সংক্ষিপ্ত স্কোর

ফল: পাঁচ উইকেটে জয়ী বাংলাদেশ।

শ্রীলঙ্কা ইনিংস: ২১৪/৬ (২০ ওভার)

(দানুশকা গুনাথিলাকা ২৬, কুসল মেন্ডিস ৫৭, কুসল পেরেরা ৭৪, দাসুন শানাকা ০, দিনেশ চান্দিমাল ২, উপুল থারাঙ্গা ৩২*, থিসারা পেরেরা ০, জীভন মেন্ডিস ৬*; তাসকিন আহমেদ ১/৪০, মোস্তাফিজুর রহমান ৩/৪৮, রুবেল হোসেন ০/৪৫, মেহেদী হাসান মিরাজ ০/৩১, নাজমুল ইসলাম অপু ০/২০, সৌম্য সরকার ০/১১, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ২/১৫)।

বাংলাদেশ ইনিংস: ২১৫/৫ (১৯.৪ ওভার)

(তামিম ইকবাল ৪৭, লিটন দাস ৪৩, সৌম্য সরকার ২৪, মুশফিকুর রহিম ৭২*, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ২০, সাব্বির রহমান ০, মেহেদী হাসান মিরাজ ০*; দুশমান্থ চামিরা ১/৪৪, আকিলা ধনঞ্জয়া ০/৩৬, নুয়ান প্রদীপ ২/৩৭, দানুশকা গুনাথিলাকা ০/২২, থিসারা পেরেরা ১/৩৬, জীভন মেন্ডিস ০/২৫, দাসুন শানাকা ০/১২)।

প্লেয়ার অব দ্য ম্যাচ: মুশফিকুর রহিম (বাংলাদেশ)।

(ঢাকাটাইমস/১০ মার্চ/ডিএইচ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

খেলাধুলা বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :