তোমাদের জন্য আগামী

দিলরুবা শরমিন
  প্রকাশিত : ১৩ জানুয়ারি ২০১৭, ১৯:৩২
অ- অ+
লেখক-দিলরুবা শরমিন

প্রতিটি ভোর আমার কাছে নতুন জীবন। প্রতিটি রাত আমার কাছে সুন্দর আগামী আসার পূর্বপ্রস্তুতি! তাই আমার জীবনে কোনোদিনই নুতন বছর এলো না। যেমন ক্যালেন্ডারের শেষ তারিখটিকে বছর শেষ ভাবিনি কোনোদিন। দিন শেষ হবে– আগামী আসবে এই তো জীবন চক্র। আজ যেমন আছি আমরা কাল আরও ভালো থাকবো। এই শুভেচ্ছায় যারা বিশ্বাসী তারা আমার সঙ্গে নিশ্চয়ই ভিন্নমত হবেন না।

আমাদের সময় তাহলে কেমন ছিল? আমরা কি ভালো ছিলাম না? ছিলাম সে এক অন্য ভুবন। আমাদের শিশুকালে আমরা তেঁতুলের পাতায় লবন মেখে চোখ বন্ধ করে মুখে পুরে দিয়ে যে রসাস্বাদন করতাম বা আমড়ার আঁটি চিবিয়ে যে স্বাদ নিতাম তা কি হারিয়ে গেছে? যায়নি। কেবল এই রসাস্বাদনের রুপ বা চেহারা ভিন্ন হয়েছে। যে সময় চলে গেছে সেটা নিয়ে আমার দুঃখবোধ–আফসোস নাই। বরং এখন ঝলমলে আলোর বিপনী বিতান- মৃদু আলোর ‘ক্যান্ডেল লাইট ডিনার’ আমার কাছে খারাপ লাগে না। বড়ই উপভোগ্য। নাগরিক এই ক্লান্তিতে আমরা তো বেশ ভালোই আছি।

বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি একঝাঁক মেয়ে পায়রার মত ডানা মেলে মোটরবাইক চালিয়ে যাচ্ছে। একঝাঁক যায় সাইকেল চালিয়েও। বাচ্চা ছেলে মেয়েগুলোর প্রজাপতির মত রঙিন পোশাক মুগ্ধ হয়ে দেখি। তাদের কলকল– ছলছল কথা– দুরন্ত আচরণ আমাকে আকৃষ্ট করে। এমনই তো হবে তারুণ্যের প্রতীক!

এখন রাজধানী জুড়ে সারা বছর নানা উৎসব– পারবন– মেলা লেগেই থাকে। যা ঘুরে ঘুরে দেখে বেড়ালেও সময় কাটে এক অদ্ভূত আনন্দে। বিলাসী বাঙালি–রসনায় তৃপ্ত বাঙালি যে কত রকমের আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠতে পারে সে আমি আর কোথাও দেখিনি। সব কিছুতেই আনন্দ পায় আজকের বাচ্চারা।

পোশাক বিলাসী তরুণসমাজ–ভোজন রসিক বাঙালি নিজেকে সাজাতেও জানে ঠিক বাংলার অপরূপ রূপের মত। নানা কারণে আমার বাংলাদেশ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। তাই চোখ মেলে বা বন্ধ করে বলে দিতে পারি কোন ঋতুতে বাংলার কোন প্রান্তের প্রকৃতির রঙ কেমন। প্রকৃতির এক নিখুত ছাপ পড়ে সেই এলাকার মানুষের স্বভাবে–আচরণে। কথায়–সংস্কৃতিতে।

ছেলে বেলায় ঢাকায় আসতাম আনুষ্ঠানিকভাবে। তখন ঢাকা ছিল এক অপরূপ নগরী! ভাই–বোন–আত্মীয় স্বজন ধানমন্ডি থাকায় সেখানেই থাকতে হতো। শুনশান নিরবতায় ভরা ধানমন্ডিতে সন্ধ্যার পর আপার বাসার সামনের লনেও যাওয়ার উপায় ছিল না। ছেলেধরা নাকি ওৎ পেতে আছে! ধানমন্ডি থেকে হাটখোলা আর কত দূর। সেখানে প্রিয় খালা মামারা ছিলেন। সেও যেতে হতো অনেক নিরাপত্তার সঙ্গে। তবে পাবলিক লাইব্রেরিতে বই পড়তে যাওয়া বা বেইলি রোডে মঞ্চ নাটক দেখতে যাওয়া এ ছিল এক রুটিন ওয়ার্ক। আজ? আজকের ছেলে মেয়েরা কি ছেলেধরায় ভয় পায়? না এমনি এমনিই হারিয়ে যায়?

কি পোশাকে যাচ্ছি সেই হিসাব কি কোনোদিন কষেছি? সময় কোথা সময় নষ্ট করার? খালাতো–মামাতো ভাইবোন এক জায়গায় হওয়ার বিশাল আনন্দে মাতোয়ারা আমাদের কি সুযোগ ছিল এটা জানার ‘ চুলের আবার ফ্যাশন’ করতে হয়? গাছ পাগল আমরা ভাই বোনেরা যখন বলধা গার্ডেনে যাওয়ার অনুমতি পেতাম (সঙ্গে অবশ্যই বাসার উপযুক্ত মুরুব্বিও থাকতেন) তখন কি আর টাচপ্যাড ফোন ছিল যে সেই মাতোয়ারা মুহূর্ত ধারন করে রাখি? আজ জীবন কতই না সহজ। স্পর্শে মুহূর্তেই ছবি! কিন্তু সেই রঙ কি আছে?

অথবা যখন ঐতিহাসিক জায়গা দেখতে যেতাম তখন? নিজেকে কি কখনো লালবাগ কেল্লার মালিক মনে করিনি? মা একটা নিষ্ঠুর(?) নারী ছিলেন। সব আনন্দই তাকে জানাতে হবে লিখিত ভাবে– কি দেখলাম–কেমন লাগলো বিস্তারিত। নইলে সব বেড়ানো বাতিল। তখন কি জানতাম এই ষড়যন্ত্রী(?) নারী আমাকে দিয়ে আসলে কি করিয়ে নিচ্ছে? আর যার জন্যেই আমি লিখতে পারছি! মা বড্ড মনে পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালেই আমি হয়ে উঠি তুমি।

তখন এত রাস্তা-ঘাট বা বিপনী বিতান–হরেক রকম পসরা–সাজগোজের জায়গা এই সব কিছুই ছিল না। ছিল কি? মনে নাই। গুলশানে এক বোনের বাসায় এসে আফসোস হয়েছিল, আহারে আমার বোনটার এই দশা একটা একতলা বাড়িতে থাকে? তুলনা করতাম হাটখোলা–কাপ্তান বাজার বা সিদ্দেশ্বরীতে থাকা আত্মীয়রা কত্ত বড় বাড়িতে থাকে সেটা। তখন কি আর জানতাম ঘরের মধ্যে ঘর?

কিশোরী মন না জানি কত কিছুই হঠাৎ আবিষ্কার করে ফেলে। ফোটোগ্রাফির প্রতি আমার এক দুর্নিবার আকর্ষণ থেকেই দলবেধে গেলাম পাবলিক লাইব্রেরিতে ‘ইন্দিরা গান্ধীর স্থির চিত্রের’ প্রদর্শনী হচ্ছে। সাল ১৯৮৫। আমার ভাইয়ের বন্ধু শাহজাহান ভাই তিনিই নিয়ে গেলেন। আমরা দলবেধে ভাই-বোন, ভাগ্নে-ভাগ্নি মহানন্দে গেলাম। কি চমৎকার সব ছবি! মুগ্ধ হয়ে আলোছায়ার খেলা দেখছিলাম। সাদা-কালোর অপরূপ রূপ অবলোকন করছিলাম। আলোকচিত্র শিল্পীর গুণগান গাইছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে একদল তরুণ হাতে লাঠি সোটা নিয়ে তেড়ে এলো আর নিমেষেই ভাঙচুর করে পণ্ড করে দিল সেই অসামান্য অনুষ্ঠান। আজো জানি না তারা কারা? কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় বিহ্বল আমি ও আমরা দলছুট হয়ে গেলাম। পাবলিক লাইব্রেরির এক কোণে ভয়ে লুকিয়ে থাকা আমাকে এক লাঠিওয়ালা যে কি না একটু আগেই এই ধংসযজ্ঞে উন্মত্ত ছিল সেই খুঁজে দিলো শাহজাহান ভাইকে। বিমূঢ় আমি আর কোনো কথাই বলতে পারলাম না। তীব্র যন্ত্রণা মনে নিয়ে ফিরে এলাম। যে কোনো সৌন্দর্য ধংসের পেছনেই আমার চিরকাল অনীহা। কিন্তু সেই দুরন্ত নিষ্ঠুর ছেলেটির মানবিক গুণটি কি আমি ভুলতে পেরেছি আজো?

এখন চারিদিকে তাকালে এক অপরিসীম সৌন্দর্য অবলোকন করি। সব মানুষ কি সুন্দর করে সাজে! কত বড় বড় সব ভবন। সুপার শপ। কি নাই এই মহানগরীতে। কাজে–অকাজে রাস্তায় সময় কাটে বেশি। একজন ভিক্ষুক দেখি না যার পরনে পোশাক নাই। মেরি স্টোপস এর সঙ্গে ‘প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকার’ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ঢাকার মাজার ছিল আমার কাজ করার জায়গা। সেই সুবাদে এই সব মাজারের কত ইতিবৃত্তই না জানলাম! জানার বা শেখার কি শেষ আছে? মাজার ব্যবসার মত বড় ব্যবসা আর আছে কি?

শৈশব–কৈশর-তারুণ্য পার করে কর্ম জীবনে এসে জড়িয়ে পড়েছিলাম নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার নিশ্চিত করার কাজে। এরপর একে একে এইচআইভি পজিটিভ হোল্ডারদের সঙ্গে, সেভ আওয়ার সিস্টার সেভ আওয়ার ডটার বা সে নো ভায়োলেন্স এগেইনস্ট ওমেন এর সঙ্গে, নারীর রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক অধিকার গুলো নিশ্চিত করার কাজে, ইসলাম ধর্মে যে শান্তির কথা বলা হয়েছে সেই কাজে আরও যে কত কাজে। কত কাজ যে করেছি আর কি যে করিনি তার হিসাব মেলাতে মন মোর নহে রাজি! কিন্তু প্রতিনিয়তই ভাবছি কত্ত কাজ না করেই চলে যাচ্ছি! কিন্তু আমি জানি তোমরা করবে।

কিন্তু আসলে আমি যাচ্ছি না। রেখে যাচ্ছি অসমাপ্ত কাজ তোমাদের জন্যে। তোমরা আমাদের আগামী। আমাদের স্বপ্ন আরও রঙিন হবে তোমাদের ডানায় ভর দিয়ে। তোমরা দেখাবে আমাদের, মানুষে মানুষে কোনো প্রভেদ নাই। আছে মানুষের রুচিতে। যা সে সহজেই বদলে ফেলতে পারে। জানাবে মানুষের মঙ্গলেই কাজ করা। টিকে থাকার জন্য নয় সসম্মানে বেঁচে থাকার জন্যেই আমরা শ্রেষ্ঠ জাতি। মানুষের ধর্ম হলো মানবতা। মানবতা–বিবেক বর্জিত যে ধর্ম তা কেবল আবরণ মাত্র। তোমরাই জানাবে আমাদের ধংসই শেষ কথা নয় সৃষ্টিই শুরু যা অবিরত চলতেই থাকে।

জীবনে অনেক ভালো মানুষ, বড় মানুষের সঙ্গে কাজ করছি। কার নাম বলবো কারটা বাদ দেবো? বরং তাদের নাম উচ্চারণের চেয়ে তাদেরকে অন্তর থেকে সম্মান জানানোই অনেক বড়। তোমরা অবিরত খুঁজে নেবে ভালো মানুষ। তাদের কাছ থেকে শিখবে। জানবে। বুঝবে। কেবল দেশ গড়া–জাতি গড়া–মানুষ গড়ার বিষয়। রাস্তাঘাট–ব্রিজ-কালভার্ট–রেললাইন– বাস-ট্রাক–প্লেন–বিল্ডিং অনেকেই গড়তে পারে। মানুষ গড়া সহজ কাজ নয় । তাই শুভক্ষণে এই শুভ কামনা– তোমরা মানুষ গড়বে। মানুষ– যা আজ মনে হচ্ছে বোঝা তা যেন আগামীতে হয় সম্পদ! এই সম্পদই যেন হয় আগামীর শক্তি। কল্যাণ হোক মানুষের। জয় হোক মানবতার।

শুভ হোক আগামী। সব তোমাদের জন্য।

লেখক: আইনজীবী ও মানিবাধিকার কর্মী

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
আগামী সপ্তাহে বৈঠকে বসবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান: ডোনাল্ড ট্রাম্প
গাজায় দখলদার ইসরায়েলি হামলায় নিহত আরও ৭৯ ফিলিস্তিনি
না.গঞ্জের চার ছাত্রীকে ঢাকায় আটকে রেখে ধর্ষণ, শিক্ষক আটক
ইরান সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করেছে: ডোনাল্ড ট্রাম্প
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা