জাহাঙ্গীরনগর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঘটনা ঘটবে কেন?

আমি ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। শিক্ষকতা করি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফলে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো খবর স্থানিক এবং মানসিক-উভয় নৈকট্যের জন্যই আমার দৃষ্টি ও মনোযোগ কাড়ে। ফেসবুক আসার পর থেকে মাথার মধ্যে রাজ্যের তথ্য ও সংবাদ নিয়ে ঘোরাফেরা করতে হয়। প্রাতিষ্ঠানিক সংবাদের বাইরে ঢাবি ও জাবির ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী সংক্রান্ত নানা ‘খবর’ মনে ও মগজে প্রতিদিন প্রবেশ করে। কিছু ঘটনা মনে ও মগজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। কিছু ঘটনা আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদার বোধকে শক্তিশালী করে। কিছু দুর্ঘটনা নিজের কাছে নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। খালি মনে হয়, এমন ঘটনা কি ইচ্ছে করলে এড়ানো যেত না? হয়তো যেত, হয়তো না। কিন্তু নিজের কাছে, অন্যের কাছে নিজেকে ছোট মনে হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা থাকতে পারে এবং সেটা নিশ্চয় আছেও। শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে একাডেমিক প্রতিযোগিতা থাকতে পারে। সেটা কেউ মিন করে না করলেও থাকবে। যেমন শিক্ষক হিসেবে আমার ‘সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ’ আর ছাত্র হিসেবে আমার ‘গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ’। এই দুই বিভাগের মধ্যে সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত? অবশ্যই একাডেমিক নানা বিষয়ে আমাদের মধ্যে যোগাযোগ থাকবে। পাশাপাশি হৃদয়ের যোগাযোগও থাকতে হবে। সাংস্কৃতিক ও সামাজিক নানা কর্মকাণ্ড দিয়ে দুটো বিশ্ববিদ্যালয় সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণে দারুণ ভূমিকা রাখতে পারে। রাখছেও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা জাহাঙ্গীরনগরে ঘুরতে আসে। এমনকি শিক্ষকরা দল বেঁধে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে স্টাডি ট্যুর পর্যন্ত করতে আসে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।
জাহাঙ্গীরনগর থেকেও ছাত্র-ছাত্রীরা ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। অন্তত আমার বিভাগের ক্ষেত্রে এমন হয় মাঝে মাঝে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর তুলনায় বয়সে নবীন হলেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে আমি বলি বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। বাংলাদেশ থেকে মাত্র এক বছর এর বড় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশ আর জাহাঙ্গীরনগর আমার কাছে পিঠাপিঠি দুই সহোদর এর মত। নানা সংগ্রামে, সংকটে একসাথে হাতেহাত ধরে বড় হয়েছে এই দুইজন। আবার অন্যদিকে ইতিহাসের বিচারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অস্বীকার করা হবে নিজের সাথেই বেঈমানি করা। সেই ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ, ১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গ রদ, ১৯১৪ সালের নাথান কমিশন এর ইতিহাস পেরিয়ে ১৯২১ সালে এসে এপারের মানুষের সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক মুক্তির সূতিকাগার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তারপরের ইতিহাস সবাই জানে। ১৯৪৭, ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭০ এবং চূড়ান্তভাবে ১৯৭১ এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের বিপ্লবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতিকে পথ দেখিয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে একসাথেই স্বায়ত্তশাসিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দিয়েছিলেন। ১৯৭৫ এ জাতির জনককে হত্যা করার পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মিছিল করে হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেছে বলে সোনালি ইতিহাস লেখা আছে। ১৯৯০ এর এরশাদ বিরোধী গণঅভ্যুত্থান এর সময়েও ঢাকার পাশাপাশি জাহাঙ্গীরনগরের বিশাল অবদান আছে। তবে এ লেখার সুযোগে জাহাঙ্গীরনগরের একটা বিশেষ প্রশংসা করে নিই। একটা জায়গায় কিন্তু জাহাঙ্গীরনগর অনন্য। সেটা আমাকে বলতেই হবে। এখানে হিন্দু-মুসলমানের নামে হল ভাগ করে দেয়া হয়নাই।
সর্বশেষ শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ কিংবা আরও আগে ১/১১ এর গণতন্ত্রবিরোধী সরকার হটানোর আন্দোলনেও কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় একই সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আমি প্রতিদিনই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে সময় কাটানোর সুযোগ নিতে ভুল করিনা। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস, পরিক্ষা ও লেখালেখির কাজ করি। বাসে এসে বাসায় একটু বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যায় হোক, রাতে হোক আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাই।
কখনো একাডেমিক কাজ, কখনো এমনিতেই যাই। হাঁটি, হলের সামনে একটু দাঁড়াই। দুই বিশ্ববিদ্যালয়কেই আমি কম-বেশী ধারণ করার চেষ্টা করি। তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ই এখন আমার মূল প্রতিষ্ঠান। তাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী, কর্মকর্তা-কর্মচারী যখন কোথাও আক্রান্ত হয়, আমি উদ্বিগ্ন হই। খোঁজখবর রাখা আমার অভ্যস হয়ে গেছে। প্রক্টরিয়াল টিমে দুইবছর টানা কাজ করেছি। এই জাহাঙ্গীরনগরের প্রতি ইঞ্চি মাটির সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছে। টারজানের জঙ্গলে রাত ১২ টায় ঝুম বৃষ্টির মধ্যে ছিনতাইকারী ধরতে টর্চবিহীন অবস্থায় প্রবেশ করে এক মাথা থেকে আরেক মাথায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা অনেকে জাবিয়ানেরও নেই বলেই আমার ধারণা। শুধু চাকরির জন্য আমি জাহাঙ্গীরনগরে থাকিনা। ঢাকা থেকে গিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে আমি প্রতিদিনই মুগ্ধ হই। এত সবুজ, এত আরাম, এত প্রশান্তি আর কোথাও পাইনা।
যখন শুনলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে জাহাঙ্গীরনগরের বাসে একদল ঢাবি ছাত্র হামলা চালিয়েছে, তখন মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। রাতের বেলায় বাসে করে ছেলে-মেয়েগুলো খেয়ে না খেয়ে আসে। ক্যাম্পাসে পৌঁছাবে, বটতলায় কষ্ট করে খাবে। সেই ছেলে-মেয়েগুলোকে কেউ যদি ঢাকায় এভাবে হামলা করে তখন মন-মেজাজ দুইটাই বিগড়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আবার জাহাঙ্গীরনগর এর প্রক্টর মহোদয়ের কাছে মাফ চাইলেন। আমরা ভাবলাম, ছেলে-মেয়েরাও মাফ করে দিয়েছে। কিন্তু কী দেখলাম? সকাল বেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস ভাঙ্গা হল আরিচা মহাসড়কে, অর্থাৎ একদল ছাত্র রাতে ঘুমোতেই পারেনি! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের একটা দল আবার নতুন রেকর্ড করল। ক্যাম্পাস থেকে অনেক দূরে মানিক মিয়া এভিনিউতে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জাবির দুইটি ডাবল ডেকার বাসে সন্ধ্যায় হামলা করল ঢাবির ছাত্ররা! তাও নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে করে এসে!! এত ভয়াবহ বাড়াবাড়ি। সবগুলো হামলার ছবি দেখলাম। সবকয়টা বিআরটিসি থেকে ধার নেয়া বাস। অর্থাৎ সরাসরি এদেশের সাধারণ মানুষের টাকায় কেনা রাষ্ট্রের সম্পদ। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যদি এভাবে পাল্টাপাল্টি বাসে হামলা করতে থাকে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি বলে কিছু থাকে?
ছাত্রথাকাকালীন আমরা যে দু/একটা ঝামেলায় যুক্ত হইনি তা না। কিন্তু সেগুলো ছিল সুনির্দিষ্ট কারণ এবং যুক্তিসম্বলিত। আমি যদি শনিবার এর ঘটনায় টিএসসিতে ঢাবি ছাত্র হিসেবে উপস্থিত থাকতাম, অবশ্যই জাহাঙ্গীরনগরের বাসকে নিরাপদে চলে যেতে দিতাম। আমাদেরকে মানুষ হিসেবে বলিষ্ঠ হতে হবে, নিষ্ঠুর না, অভদ্র না। জাবি ছাত্ররা যেটা সকাল বেলা করল সেটাও খুব অন্যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার নামে একটি ফেসবুক পেজের আমি মেম্বার। সেখানে দেখেছি কীভাবে ছাত্র-ছাত্রীরা এসব হামলার নিন্দা করছে। আবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটা পেইজেই আমি আছি। সেখানেও দেখেছি কীভাবে জাহাঙ্গীরনগর এর ছাত্র-ছাত্রীরা এসব হামলার নিন্দা করছে। তবে এও দেখেছি, দুই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই কিছু ছাত্র এখনো খুব আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে উস্কানি দিচ্ছে, এরা সংখ্যায় কম। অযথা বাহাদুরি দেখাতে গিয়ে, নিজের এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম নষ্ট করার কোনো মানে হয়না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অনুরোধ করব, যেসব ছাত্র উস্কানি দিচ্ছে তাদেরকে চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনা হোক।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য করুন