বঙ্গবন্ধুর তিন পয়সার পোস্টকার্ড, দুর্নীতিবিরোধী হুঁশিয়ারি এবং...

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ২৪ জানুয়ারি ২০১৯, ১২:১৫

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আজকে করাপশনের কথা বলতে হয়। এ বাংলার মাটি থেকে করাপশন উৎখাত করতে হবে। করাপশন আমার বাংলার কৃষকরা করে না। করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ। যারা আজকে ওদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া করেছি। আজ যেখানে যাবেন, করাপশন দেখবেন আমাদের রাস্তা খুঁড়তে যান করাপশন। খাদ্য কিনতে যানÑ করাপশন। জিনিস কিনতে যান করাপশন। বিদেশ গেলে টাকার ওপর করাপশন। তারা কারা? আমরা যে ৫ শতাংশ শিক্ষিত সমাজ, আমরা হলাম দুনিয়ার সবচেয়ে করাপ্ট পিপল, আর আমরাই করি বক্তৃতা। আমরা লিখি খবরের কাগজে, আমরাই বড়াই করি।’*

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু সোচ্চার ছিলেন আমৃত্যু। দেশ থেকে দুর্নীতি উৎখাত করতে তিনি ছিলেন দৃঢ়চেতা। বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে সরব ছিলেন সব সময়। সরকারি কর্তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠিন উচ্চারণের পুরোনো অডিও ও ভিডিও রেকর্ডে এখনো বাজে।

১৯৭৫ থেকে ২০১৯ সাল। মাঝে কেটে গেছে ৪৪ বছর। কিন্তু দুর্নীতি আজও বহাল তবিয়তেই আছে। কখনো বেড়েছে, কখনো কমেছে। তফাত এটুকুই।

৪৪ বছর পর এসে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি চাকুরেদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ার করলেন। স্পষ্ট বললেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার সরকারের অবস্থান ‘জিরো টলারেন্স’। বিন্দুমাত্র ছাড় নেই।

নতুন সরকার গঠনের পর গত ১৭ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে অফিস করেছেন তিনি। ওই দিন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময়ে শেখ হাসিনা বলেন, দুর্নীতির প্রমাণ পেলেই তিনি ব্যবস্থা নেবেন। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন গড়তে চান তিনি।

এর আগেও বিভিন্ন সময় প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিজের দৃঢ়তা ব্যক্ত করেছেন। তবে সরকারি চাকুরেদের এভাবে হুঁশিয়ার করার নজির নিকট অতীতে নেই।

আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদে সরকারি চাকুরেদের বেতন-ভাতা দ্বিগুণ বেড়েছে। শতকরায় এই হার ১২৩ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। এটি নজিরবিহীন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অতীতে কখনো এতটা আর্থিক সুযোগ-সুবিধা পাননি। পৃথিবীর কোনো দেশে এ ধরনের উদাহরণ নেই বলেও মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই।

বেতন-ভাতা দ্বিগুণ করার পরও কি সরকারি খাতে দুর্নীতি কমেছে? কমেনি। অনেক রসিক বলেন, বেতনের সঙ্গে উৎকোচের পরিমাণও বেড়েছে আনুপাতিক হারে।

এখনো যারা দুর্নীতির বলয় থেকে বের হতে পারেননি, তাদের সমস্যা আসলে আর কোথাও নয়, মানসিকতায়। প্রধানমন্ত্রী ঠিকই তা বুঝতে পেরেছেন। একটা সময় হয়তো বেতনগুণে সরকারি কর্তাদের চলার উপায় ছিল না। এখন তো সেই অবস্থা নেই। তাহলে পুরোনো অভ্যাস ছাড়তে তাদের কষ্ট হবে কেন?

প্রধানমন্ত্রী এই যৌক্তিক বিষয়টিকে সামনে এনেছেন। বলেছেন, ‘আমরা বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা এত বেশি বাড়িয়েছি, সে ক্ষেত্রে আমি তো মনে করি, আমাদের এ দুর্নীতির কোনো প্রয়োজনই নেই। যা প্রয়োজন তার সব তো আমরা মেটাচ্ছি; তাহলে দুর্নীতি কেন হবে? কাজেই এখানে মানুষের মন-মানসিকতাটাকে পরিবর্তন করতে হবে।’

প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর এই হুঁশিয়ারি খুব প্রয়োজন ছিল। টানা তৃতীয়বার ক্ষমতার আসায় আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা বেড়েছে। সরকারের দায়বদ্ধতাও বেড়েছে। সুশাসনের যে প্রতিশ্রুতি শেখ হাসিনা নির্বাচনের আগের দিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়ন তিনি করবেনই। কারণ তিনি কথা দিয়ে কথা রাখেন, এটি এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠিত। কথা দিয়েছিলেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবেন, করেছেন। বলেছিলেন দক্ষিণের মানুষকে যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখিয়েছিলেন, সেই পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান। কত ঝড়-ঝঞ্ঝাটই না পেরোতে হয়েছে এ জন্য। তবু দমে যাননি বঙ্গবন্ধুর রক্ত।

বিদেশিরা মুখ ফিরিয়ে নিলেও তিনি জনগণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি। নিজেদের টাকায় পদ্মায় সেতু হচ্ছে। এটি সরকারপ্রধানের জন্য কঠিন পরীক্ষা ছিল। শেখ হাসিনা দৃঢ়চেতা মনোভাব দিয়ে এই কঠিন পরীক্ষা উতরে গেছেন। মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সরকারের যে অভিযান চলছে, দুর্নীতির বিরুদ্ধেও এমন অভিযান থাকবে, এমন ইঙ্গিত প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন। বলেছেন, ‘একেবারে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট একটি নির্দেশনা যেতে হবে- কেউ দুর্নীতি করলে সঙ্গে সঙ্গে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।’

সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসনের বিকল্প নেই। যাদের দিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে, তারাই যদি দুর্নীতিতে জড়িয়ে থাকেন, তবে কী করে হবে? যে সরষে ভূত তাড়াতে, তাতেই যদি ভূতের বাস হয়, তবে কি আর কাজ হবে?

সরকারি ও বেসরকারি দুই খাতেই দুর্নীতির নজির রয়েছে। তবে সরকারি খাত যতটা আলোচনায় আসে বেসরকারি খাত ততটাই থাকে আড়ালে। এর পেছনেও কারণ আছে। বেসরকারি খাতের দুর্নীতিতে সাধারণ জনগণ যতটা না ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সরকারি খাতে হয় তার কয়েকগুণ বেশি।

সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সরকারি কর্মচারীদের জনগণের সাথে মিশে যেতে হবে। তারা জনগণের খাদেম, সেবক, ভাই। তারা জনগণের বাপ, জনগণের ছেলে, জনগণের সন্তান। তাদের এই মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে।

এটাই শেষ নয়, অপর এক বক্তব্যে তিনি আরও বলেছিলেন, সমস্ত সরকারি কর্মচারীকেই আমি অনুরোধ করি, যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে তাদের সেবা করুন।

প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা জনগণের সেবক। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সমূহের ২১ অনুচ্ছেদে নাগরিক ও সরকারী কর্মচারীদের কর্তব্যে বলা হয়েছে: (১) সংবিধান ও আইন মান্য করা, সুশৃঙ্খলা রক্ষা করা, নাগরিক দায়িত্ব পালন করা, জাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। (২) সকল সময়ে জনগণের সেবা করার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।

তাহলে জনগণকে সেবা দেওয়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব। আর নাগরিকদের উচিত আইন মেনে চলা। তাই জনগণকে সেবা দিয়ে বেতন-ভাতার বাইরে অতিরিক্ত আর্থিক বা অন্য কোনো সুবিধা নেওয়া সংবিধান অমান্যের শামিল। আবার নাগরিক যদি সেবা নিতে গিয়ে কোনো ধরনের আইন অমান্য করেন, শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেনÑতাহলে তিনিও এ ক্ষেত্রে অপরাধী।

একতরফা সরকারি কর্মকর্তা বা কর্মচারীদেরও দোষারোপ করার সুযোগ নেই। কারণ নাগরিকরা বিভিন্ন সময় নিয়ম ভেঙে সুবিধা পেতে চান। নিয়মে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অবৈধ পথ বেছে নেন। তখন উৎকোচ বিনিময় হয় উভয়ের সম্মতিতে। অনেক ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনের বাইরে ক্ষমতার অপব্যবহারেও বাধ্য করা হয় নিয়ম ভাঙতে। অনেক সময় সরকারি কর্তারাও নিরুপায় হয়ে পড়েন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে অভিযানে এ বিষয়গুলোও যেন বাদ না পড়ে, খেয়াল রাখতে হবে।

সুশাসন বা সুপ্রশাসনের জন্য একা সরকারি চাকুরেদের দায়িত্বশীল বা সতর্ক হলে হবে না, নাগরিকদেরও দায়িত্ব ও কর্তব্য আছে। তাদেরও এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক হতে হবে। নিয়মের বাইরে গিয়ে ‘নিজের সুবিধা’ নেওয়ার চিন্তাভাবনা মাথা ঝেড়ে ফেলতে হবে। উৎকোচ নেওয়ার পাশাপাশি উৎকোচ দেওয়ার মানসিকতাও ছাড়তে হবে।

টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভা থেকে চমক শুরু হয়েছে। এই চমক ধরে রাখতে হলে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, তা বাস্তবায়ন করতে হলে নজরদারি ও জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে। মাঠপর্যায় পর্যন্ত এই হুঁশিয়ার বাণী পৌঁছে দিতে হবে। তা না হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার যে অঙ্গীকার শেখ হাসিনা করেছেন, তা বাস্তবায়ন অসম্ভব হবে।

লেখা শুরু করেছিলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তব্য দিয়ে। শেষও করছি তাঁকে দিয়ে। বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন, তা নয়; শুরু থেকেই তাঁর উচ্চারণ ছিল ন্যায়ের পক্ষে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে।

ঘটনাটি ১৯৫৬ সালের ১৬ সেপ্টেম্বরের। ওই দিন পিরোজপুর শহরের গোপালকৃষ্ণ টাউন ক্লাব মাঠে পিরোজপুর মহকুমা আওয়ামী লীগ এক জনসভার আয়োজন করেছিল। তৎকালীন যুক্তফ্রন্ট সরকারের শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ এইড দপ্তরের মন্ত্রী তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন জনগণকে বলেছিলেন, দুর্নীতিবাজদের নাম তিন পয়সা মূল্যের পোস্টকার্ডে লিখে তাঁর কাছে পাঠাতে।

ছয় দশক পর এসে বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বান কি আবারও প্রাসঙ্গিক হতে পারে না? তিন পয়সার পোস্টকার্ড না থাকলেও বিকল্প অনেক পথ তো খোলা আছে। .............................................................

* বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান; জীবন ও রাজনীতি দ্বিতীয় খ-, বাংলা একাডেমি, পৃষ্ঠা-৮৯০

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :