কারো ইশারায় খেলবেন না, প্রশাসনকে শামীম ওসমান

মাজহারুল ইসলাম রোকন, নারায়ণগঞ্জ
| আপডেট : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ২২:০০ | প্রকাশিত : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ২১:২৯

নারায়ণগঞ্জের প্রশাসনকে হুঁশিয়ারি করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আলোচিত সাংসদ এ কে এম শামীম ওসমান বলেছেন, ‘কারো ইশারায় খেইলেন না। আমরা কিন্তু খেলতে জানি। এই নারায়ণগঞ্জে জিয়াউর রহমান পারেনি, এরশাদ পারেনি, খালেদা জিয়াও পারেনি| আর এখন তো শেখ হাসিনার বাংলাদেশ, তাই কেউ খেলতে গেলে আমাদের সঙ্গে পারবেন না।’

আজ শনিবার বিকালে নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়ায় এক সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি। ‘রুখে দাঁড়াও স্বাধীনতাবিরোধী সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে’ স্লোগান নিয়ে সমাবেশটি ডাকেন শামীম ওসমান নিজেই।

প্রায় সোয়া ঘণ্টার বক্তব্যে শামীম ওসমান স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন এবং তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়র সেলিনা হায়াত আইভীকে ইঙ্গিত করে বিভিন্ন হুমকি দেন। ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগও তোলেন তিনি।

প্রশাসনকে ইঙ্গিত করে শামীম ওসমান বলেন, ‘আমরা সেই ছোটবেলা থেকেই পুলিশের লগে খেলি। এই আগডুম-বাগডুম পুলিশ-পুলিশ খেলা আমরা ছোটবেলা থেকেই খেলি। বাপ-দাদার আমল থেকেই পুলিশ-পুলিশ খেলা খেলি।’এ সময় সামনে উপস্থিত পুলিশকে উদ্দেশ করে শামীম ওসমান বলেন, ‘পুলিশ ভাইয়েরা আপনারা কিছু মনে কইরেন না।’

শামীম ওসমান বলেন, ‘কিছুদিন পর হয়তো দাদা হয়ে যাব। বয়স হয়ে গেছে। সে জন্য অনেকের অনেক কিছু সহ্য করি, তা নয় কিন্তু।’

পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে শামীম ওসমান বলেন, ‘গুজবে ছেলে ধরা সন্দেহে সিদ্ধিরগঞ্জে একজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হলো। কিন্তু আসামি করা হলো ১ নং থেকে ১০ নং ওয়ার্ড পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের আওয়ামী লীগের ৭৪ জন নেতাকর্মীকে।’

‘এসপির সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি দায়িত্বশীল ব্যক্তি। তিনি বলছেন নিরপরাধ কাউকে হয়রানি করা হবে না, মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হবে। আর যে পুলিশ কর্মকর্তা এটা করেছেন তার বিরুদ্ধে এসপি সাহেব ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। আমি এসপি সাহেবের কথায় বিশ্বাস রাখতে চাই।’

এক-এগারোর সময় তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করা হয়েছিল দাবি করে শামীম বলেন, ‘ওই সময় একজন এএসপি ও সদর থানার ওসি আমাকে ফোন করে জানিয়েছিলেন আমাকে গ্রেপ্তার করা হবে, আমাকে মেরে ফেলা হবে। তাদের মতো পুলিশ কর্মকর্তা এখন দেখি না। এখন তো সবাই আওয়ামী লীগ।’

এ সময় শামীম ওসমান নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা যদি চাই নারায়ণগঞ্জের সব রাস্তাঘাট অচল করে দেব, তাহলে কি আমরা সেটা পারব?’ নেতাকর্মীরা স্লোগান দিয়ে বলেন ‘হ্যাঁ’। শামীম ওসমান আবার বলেন, ‘যদি চাই ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়ক বন্ধ করে দেব, যদি বলি ঢাকা-সিলেট সড়ক বন্ধ করে দেব, আমরা কি এসব করতে পারব?’ তখন নেতাকর্মী হ্যাঁসূচক স্লোগান দেন।

পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে শামীম ওসমান বলেন, ‘একজন মধ্যম সারির পুলিশ কর্মকর্তা নারায়ণগঞ্জের সাংবাদিকদের মোবাইলে ম্যাসেজ পাঠিয়ে বলেন আমার লোকজনদের বিরুদ্ধে নিউজ করতে। এর বিরুদ্ধে করেন, ওর বিরুদ্ধে নিউজ করেন। আরে পুলিশ ভাই নারায়ণগঞ্জের সাংবাদিকেরা নারায়ণগঞ্জের সন্তান। আপনি তাদের ম্যাসেজ পাঠান আর সেই ম্যাসেজ তারা আমাকে দেখায়, এই যে দেখেন আপনার নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নিউজ করতে বলছে। এ বিষয়ে আমি এসপিকে বলেছি- এসপি বলেছেন ব্যবস্থা নেবেন।’

‘আর কাঁদলেও নৌকা পাবেন না’

সমাবেশে শামীম ওসমান তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভীকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘আমার মতোই একজন জনপ্রতিনিধি তিনি। গাড়ি থেকে নেমে ফুটপাত থেকে হকারদের লাথি মেরে নামিয়ে দিচ্ছেন। লাথি দেয়ার আগে একবারও চিন্তা করছেন না হকারদের পেটে লাথি মারছেন। তারা কীভাবে সংসার চালাবে? তারা কি ইয়াবা বিক্রি করে সংসার চালাবে? আমার নেত্রী আপনাকে নৌকা প্রতীক এ কারণে দেননি আপনি হকারদের আয়ের ব্যবস্থা না করেই তাদের পেটে লাথি মারবেন। গরিব-দুঃখী মানুষের পেটে লাথি মারতে আমার নেত্রী আপনাকে নৌকা প্রতীক দেননি।’

ব্যঙ্গ করে শামীম ওসমান বলেন, ‘আপনি নৌকা নিয়ে নির্বাচিত হয়ে এখন বলছেন আপনি কোনো দল করেন না। দল বোঝেন না। আবার নির্বাচন এলে নৌকার জন্য ভে ভে করে কাঁদবেন। সামনে আর তা হবে না। নৌকার জন্য কাঁদলেও আর পাবেন না।’

নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি চন্দন শীলের সভাপতিত্বে সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহীদ বাদল, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা, যুগ্ম সম্পাদক শাহ নিজাম, সাংগঠনিক সম্পাদক জাকিরুল আলম হেলাল, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আবু জাফর চৌধুরী বিরু, সাংগঠনিক সম্পাদক মীর সোহেল আলী, নারায়ণগঞ্জ জেলা আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এসএম ওয়াজেদ আলী খোকন, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি হাসান ফেরদৌস জুয়েল, সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ মোহসীন মিয়া, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুজিবুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক ইয়াসিন মিয়া, ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি এম সাইফুল্লাহ বাদল, সাধারণ সম্পাদক শওকত আলী, সোনারগাঁও আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক সামসুল ইসলাম ভূঁইয়া, যুগ্ম আহ্বায়ক ইঞ্জিনিয়ার মাসুদুর রহমান মাসুমসহ বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতারা।

এর আগে জেলার বিভিন্ন থানা এলাকা থেকে আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা পৃথক পৃথকভাবে মিছিল নিয়ে সমাবেশে যোগ দেন।

তবে সকাল থেকেই চাষাঢ়া ও এর আশপাশের এলাকায় বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করতে দেখা যায়। এমনকি শামীম ওসমানের মঞ্চের সামনে ও পেছনেও পুলিশ অবস্থান নেয়। সেই সঙ্গে পুলিশের জলকামান, সাঁজোয়া গাড়ি, এপিসি মোতায়েন করতেও দেখা যায়। সচরাচর এমন কঠোর ব্যবস্থা পুলিশ বিএনপি-জামায়াতের কর্মসূচিতে নিয়ে থাকে। সমাবেশে শামীম ওসমান এক ঘণ্টা ১৭ মিনিট বক্তব্য দেন।

নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের সঙ্গে শামীম ওসমানের সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে অনেক দিন ধরে। ইতিমধ্যে শামীম ওসমানের শতাধিক নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তার শ্যালক তানভীর আহমেদ টিটুর বিরুদ্ধেও একটি মামলায় তাকে মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের বেশ কজন কাউন্সিলরকেও মাদক ও ডাকাতি মামলায় গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। শামীম ওসমান তাদের ছাড়াতে এসপি অফিসে গেলেও পুলিশ তার নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করে আদালতে পাঠায়। এমন পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের পরিবারকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে ফতুল্লার বাংলা ভবনে প্রতিবাদ সভা করেন শামীম ওসমান। সেখানে এসপি হারুনের বিরুদ্ধে নেতাকর্মীরা স্লোগান দিয়েছিলেন। এর তিন দিন পর এসপি অফিসে যান শামীম ওসমানের আরেক ভাই জাতীয় পার্টির সাংসদ এ কে এম সেলিম ওসমান। ওই দিন এক মতবিনিময় সভায় এসপি হারুন সাংসদ সেলিম ওসমানকে সাফ জানিয়ে দেন, কোনো মাদক ব্যবসায়ী, জুয়াড়ি, সন্ত্রাসী, ভূমিদস্যুকে গ্রেপ্তারের পর যদি দেখা যায় লোকটি আপনাদের তাহলে কোনো সমস্যা নেই। আপনারা আদালত থেকে জামিন করিয়ে নেবেন কেউ জানবে না। আমরা গ্রেপ্তার করব, আপনারা জামিন করিয়ে নেবেন।’

গত ৩১ আগস্ট নারায়ণগঞ্জে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সমাবেশে শামীম ওসমান বলেছিলেন, এখন ডাক্তার-পুলিশ সবাই আওয়ামী লীগার। সবাই এখন আওয়ামী লীগ হয়ে গেছেন। তাদের ধাক্কায় আসল আওয়ামী লীগার পিছিয়ে।

ওই দিন রাতেই শামীম ওসমানের একমাত্র ছেলে অয়ন ওসমানের স্ত্রীর আপন বড় ভাই ভিকিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। একজন সিএনজি চালককে মারধর ও সিএনজি ভাঙচুরের ঘটনায় তাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠায় পুলিশ।

এর পরদিন নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাবে ই-ট্রাফিকিং সেবা উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে এসপি হারুন অর রশীদ বলেন, ‘আমরা রাজনীতি করতে নারায়ণগঞ্জে আসিনি। আমরা যাদের গ্রেপ্তার করছি তাদের অনেকেই হয়তো কারো আত্মীয়স্বজন কিংবা নেতাকর্মী। যে কারণে কেউ কেউ আমাদের প্রতি রাগ হতে পারেন। আমরা এখানে রাজনীতি করতে আসিনি। মানুষের সেবার মানসিকতা নিয়েই কাজ করছি।’

৫ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে শামীম ওসমানের ভাতিজা আজমেরী ওসমানের বাসায় সদর থানা পুলিশ, ফতুল্লা থানা পুলিশ ও জেলা ডিবি পুলিশ ব্লক রেইড দেয়। ওই সময় আজমেরী ওসমান পালিয়ে যান। আজমেরী ওসমানের বাসা থেকে জেলা ছাত্র সমাজের সভাপতি শাহাদাত হোসেন রুপু ও মোখলেছুর রহমান নামে দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই দিন রাতেই বাচ্চু নামের একজন ঠিকাদারের কাছে ৬৫ হাজার টাকা চাঁদা দাবি ও তাকে মারধরের ঘটনায় মামলা করা হয়। ওই মামলায় আজমেরী ওসমানকে প্রধান আসামি করা হয়। আজমেরী ওসমান হলেন জাতীয় পার্টির প্রয়াত প্রেসিডিয়াম সদস্য নাসিম ওসমানের ছেলে।

(ঢাকাটাইমস/০৭সেপ্টেম্বর/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :