মেঘের রাজ্য চেরাপুঞ্জি যেভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠল

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ০১ এপ্রিল ২০২০, ২০:২৭
অ- অ+

চেরাপুঞ্জিকে বলা হয় মেঘের রাজ্য। এখানে রয়েছে উঁচু পাহাড়, ঝরনা আর সবুজ প্রকৃতি। এটি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের একটি রাজ্য। সেখানে রোদ, বৃষ্টি ও মেঘের সঙ্গে মিশে যেতে পারেন অনায়াসে। আকাশের ঘন নীলের ফাঁকে উড়ে বেড়ায় সাদা মেঘের ভেলা। সিলেটের তামাবিল বর্ডার পেরোলেই মেঘালয় রাজ্য। একসময় প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড বলা হতো চেরাপুঞ্জিকে। এই পর্যটন স্থানটির রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস।

তৎকাল বিট্রিশশাসিত ভারতে পাহাড়ি এলাকায় নগর নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিল ব্রিটিশ কর্মকর্তারা। ১৮২৪ সালে প্রথম বার্মা যুদ্ধের পর ব্রিটিশ চেয়েছিল উত্তর-পূর্ব ভারতে নিজেদের পছন্দের একটা জায়গা বেছে নিতে। ব্রিটিশ কর্মকর্তা ডেভিড স্কট সরেজমিনে পরিভ্রমণের সময় চেরাপুঞ্জিতে হাজির হন।

চার দিকে সবুজে মোড়া পাহাড়, ঠান্ডা আবহাওয়া দেখে তার পছন্দ হয়ে গেল চেরাপুঞ্জিকে। প্রায় সারা দিনই মেঘে ঢাকা এই অঞ্চলটা অনেকটা লন্ডনের আবহাওয়া মনে করিয়ে দেয় তাঁদের। ইউরোপীয় অফিসারদের উপযুক্ত পরিবেশে থাকা ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের পরিচর্যার জন্য একটা স্যানেটোরিয়াম বানানোর প্রস্তাব হল। তৈরি হল নতুন পাহাড়ি জায়গা। সোহরা নামে পরিচিত সেই অঞ্চল তত দিনে মুখে মুখে ‘চেরা’তে পরিণত হয়েছে, আজ যা চেরাপুঞ্জি নামে বিখ্যাত।

এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত করতে গিয়ে তারা দেখলেন যে শুধু মেঘ নয়, সারা দিন ধরেই সেখানে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। কখনও কখনও টানা দশ-বারো দিন এক নাগাড়ে বৃষ্টি হওয়া এই জায়গাটার একটা বৈশিষ্ট্যও বটে।

যে জায়গাটি এত ভাল লেগেছিল ব্রিটিশদের, এই অধিক বৃষ্টির কারণে সেখানে স্থায়ী ভাবে থাকার অনুপযোগী মনে হল এক সময়। সৈন্যদের গোলা-বারুদ বেশি আর্দ্রতায় অল্প সময়েই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে, বইপত্র স্যাঁতসেতে হয়ে যায়, সারা দিন বৃষ্টিতে ইচ্ছেমতো বাইরে বেরনো যায় না, প্রাকৃতিক কারণে সেখানে চাষবাসও সম্ভব নয়। যারা এই মেঘলা পাহাড়ি অঞ্চলে ভাল লাগা নিয়ে থাকতে চেয়েছিল নতুন জনপদ তৈরি করে, তাদের ভিতর প্রবল অবসাদ দেখা গেল। অত্যধিক বৃষ্টির জন্য ঘরে বসে থাকার ফলে অ্যালকোহল সঙ্গী হয়ে উঠল অলস সময় কাটানোর। প্রায় সব সময়ই একটা আলগা মনখারাপ লেগেই থাকে। এমনকি আত্মহত্যার হারও বেড়ে গেল এই একটানা মেঘ-বৃষ্টির কারণে। সৈনিকদের ভগ্নস্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য তৈরি হওয়া চেরাপুঞ্জি কাজে এল না। ফলে ১৮৬৪ সালে চেরাপুঞ্জি ফেলে রেখে শিলং-এ সরে গেল ব্রিটিশদের উত্তর-পূর্ব ভারতের হেডকোয়ার্টার্স।

এমন পরিস্থিতিতে তাদের মনে হল, বৃষ্টির পরিমাপ করা আবশ্যক। শুরুতেই ডেভিড স্কট বৃষ্টিপাত মাপার একটা পরিকল্পনা করেছিলেন। ১৮৫০ সালে বটানিস্ট জোসেফ ডালটন চেরাপুঞ্জি এসে বৃষ্টি মাপার আয়োজন করলেন। একই সঙ্গে পৃথিবীর আর কোথায় এমন পরিমাণ বৃষ্টি হয়, তার অনুসন্ধান শুরু হল। পৃথিবীর অধিক বৃষ্টিপ্রবণ জায়গাগুলো থেকে সংগ্রহ করা হল তথ্য। উঠে এল ব্রাজিলের একটি জায়গা, যেখানে প্রায়ই বৃষ্টি হয়ে থাকে। বিভিন্ন সময়ে চেরাপুঞ্জির বৃষ্টিপাতের পরিমাণ মাপা হওয়ার পর, ১৯০৮ সালে ইম্পিরিয়াল গেজেটিয়ার ঘোষণা করল যে চেরাপুঞ্জি এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের অঞ্চল।

সেই চেরাপুঞ্জি থেকে এক সময় বৃষ্টি সরে গেল কিছুটা দূরে মৌসিনরামে। এখনও চেরাপুঞ্জি বা মৌসিনরাম সেই তকমা ধরে রাখলেও বৃষ্টিপাতের সময় ও চরিত্র বদলেছে। এত বৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও চেরাপুঞ্জিতে পানীয় জলের সঙ্কট তীব্র। ভূগর্ভস্থ পানির যথেষ্ট সঞ্চয় নেই, অথচ বৃষ্টি হয়েই চলেছে। এত পানি, অথচ সবই পানের অযোগ্য।

এই কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে এক সময় অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন যে অধিক পরিমাণে গাছ কেটে নেওয়ার ফলেই এই ঘটনা ঘটেছে। ব্রিটিশদের হাতে চেরাপুঞ্জি নির্মাণ এবং পরবর্তী কালে নগরায়নের ফলেই মাটির নিচে জল হারিয়েছে চেরাপুঞ্জি। অরণ্য ধ্বংসই এর কারণ?

প্রচলিত এই ধারণার বিপরীতে ভারতের ইতিহাসবিদ সজল নাগ গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে প্রকৃ্তি নিজেই চরিত্র পাল্টেছে, মানুষ বা নগরায়ন ঠিক ততখানি দায়ী নয়। অরণ্য সাফ করে নগর তৈরির যে বিষয়টি ভাবা হয়েছিল—অরণ্য ধ্বংস করায় ভূগর্ভে জলের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে বলে যে ধারণা গড়ে উঠেছিল—তা ততখানি গ্রাহ্য নয়। কারণ, কোনও দিনই চেরাপুঞ্জিতে সে ভাবে গভীর অরণ্যের অবস্থান ছিল না। ফলে অরণ্য ধ্বংসের প্রশ্ন ওঠে না। অন্যান্য তথ্যের সঙ্গে ১৮৩৭ সালে উইলিয়াম গ্রিফিথের এক রিপোর্ট উল্লেখ করে অধ্যাপক নাগ দেখিয়েছেন যে বড় বড় গাছ জন্মানোর জন্য চেরাপুঞ্জির মাটি তেমন ভাবে প্রস্তুত ছিল না।

গ্রিফিথের রিপোর্টে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে, সেই সময়ে বৃহৎ কাষ্ঠল গাছ চেরাপুঞ্জিতে তেমন পরিমাণে ছিল না, যা সমষ্টিগত ভাবে অরণ্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। চেরাপুঞ্জির এই অধিক বৃষ্টির মূল কারণ মৌসুমি বায়ুর সেইখানে গিয়ে আটকে যাওয়া, সহজে বেরোতে না পারা। অথচ এই প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে এটাই হয়ে উঠতে পারত পৃথিবীর অনন্য রেইন-ফরেস্ট বা বর্ষা অরণ্য।

চেরাপুঞ্জির সম্পদ চুনাপাথর আর লোহা। প্রাকৃকি ভাবেই পার্বত্য অঞ্চলের পৃষ্ঠদেশ ঢালু। তাই সেখানকার মাটিতে পানি দাঁড়াতে পারে না স্বাভাবিক ভাবেই। মাটিতেও কাঁকর ও পাথরের পরিমাণ বেশি। মাটি কম ছিদ্রযুক্ত, ফলে পানি ধরে রেখে ভূগর্ভে পৌঁছে দিতে পারে না। অধিক বৃষ্টি মাটির ক্ষয়ের অন্যতম কারণও বটে। বৃষ্টির পানি ধরে রাখার বন্দোবস্ত ছিল না তখন। বর্তমান সময়ে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার কিছু প্রয়াস যদিও বাস্তবায়িত হয়েছে। ফলে শীত কালে পানীয় জলের জন্য বহু দূর চলে যেতে হয় মানুষকে। ঝরনার পানি আশ্রয় করে বেঁচে থাকে কেউ কেউ। অন্যান্য অনেক পাহাড়ি অঞ্চলের মতো চেরাপুঞ্জিও পানীয় জলের সঙ্কটে ভুগছে প্রবল ভাবে। এত বৃষ্টি নিয়েও।

সম্প্রতি দেশটির বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত সাত দিনব্যাপী গবেষণা-সপ্তাহের একটি পর্বে উঠে এল এমনই সব সঙ্কটের প্রসঙ্গ। ইতিহাসের আলোয় ফিরে দেখা গেল সময়ের নিরিখে চেরাপুঞ্জির বৃষ্টির রূপরেখা।

এত বৃষ্টি নিয়েও বড় বড় গাছ ধরে রাখার উপযুক্ত মাটি ও পরিবেশ তৈরি না হওয়া, কিংবা ভূগর্ভে যথেষ্ট পরিমাণে পানি সঞ্চিত না থাকা কি প্রকৃতির আত্মঘাতী নিদর্শন নয়?

(ঢাকাটাইমস/১এপ্রিল/এজেড)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
হাতিরপুলে গণসংহতি আন্দোলনের কার্যালয়ের সামনে দুই ককটেল বিস্ফোরণ
৪৪তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ, উত্তীর্ণ ১৬৯০ জন
এনসিপির ‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি শুরু
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদ ও যোদ্ধাদের স্মরণে ‘বিআরপি’র মশাল মিছিল
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা