বাবা আমার রিয়েল হিরো

কী বিশেষণে বিশেষায়িত করব বাবা শব্দটিকে আমি বুঝিনা। লিখতে গিয়ে কোনো ভাষাই খুঁজে পাইনা।তবুও এই শিহরিত শব্দটিকে এই একটি মাত্র মাধ্যমে প্রকাশ করা যায় তা হলো নিজ লেখনি। নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে সন্তানের উন্নত একটা জীবন দান করেন সৃষ্টিকর্তার পর তিনি হলেন বাবা। বাবা একটি শব্দ। এর সাথে জড়িয়ে থাকে হাজারো স্মৃতি। এই সুন্দর পৃথিবীতে মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো মা-বাবা। বাবা তিনি সাধারণ কেউ নন। সুপারম্যান কিংবা ব্যাটম্যানের চেয়েও অসাধারণ কেউ। রোদ, বৃষ্টি থেকে বাঁচাতে মাথার ওপর যে কেউই ছাতা হতে পারে, কিন্তু বট বৃক্ষের মতো শীতল ছায়া যে কেউ দিতে পারে না। বটবৃক্ষ হয়ে মাথার উপর থাকেন ‘বাবা’।বৃক্ষ যেমন ছায়া দেয় ফল দেয় কাঠ দেয়, দেয় বাঁচার জন্য অক্সিজেন। তেমনি বাবাও দেন ছায়া, অক্সিজেন। দেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার একটি আত্মপরিচয়।
মাথার ওপর থেকে ছায়া সরে গেলেই টের পাওয়া যায়, কঠিন এই জীবনটা কেউ একজন অনেক সহজ করে দিয়েছিলেন।আমাদের জীবন অতো সহজ নয়, যতটা আমরা মনে করি।
আমি এমন একটি পরিবারে জন্মেছি যেখানে শুধু আভিজাত্যের ছোঁয়া পেয়েছি। পেয়েছি হাত বাড়ালেই সব। কিন্তু হাত বাড়ালেই যাদুর মতো যিনি হাতে এনে দিয়েছেন তাঁর শুরুটা আমার মতো ছিলনা। ছিল অনেক সংগ্রামের। বলছি সেই একজন বাবার গল্প। মানুষ ক্ষুদ্র জীবনে কত কিছুই না করেন। পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছেন যারা জাহির না করে নিরবে নিভৃতে সমাজসেবা পরিবার তথা দুর্বল মানুষের পাশে ছায়া হয়ে থাকেন তেমনি একজন সাদা মনের মানুষ আলহাজ আবু মোহাম্মদ খালেদ।
যিনি শিক্ষাবিদ, মুক্তিযোদ্ধা,সমাজসেবক একজন ব্যবসায়ী। চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামে মরহুম আব্দুল কুদ্দুস মাস্টার ও রাবেয়া খাতুনের ঘর আলোকিত করে ১৯৫২ সালে জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণের ফলে এই দম্পতি মহাখুশী। আদরের সন্তানের নাম রাখলেন খালেদ। মা-বাবা ভাই-বোন নিয়ে তাদের পরিবার চলছিল ভালোই। তাঁর বাবা কুদ্দুস মাস্টার ছিলেন শিক্ষক।হঠাৎ তিনি অবসর নেন। এসএসসি পাশ করার পর পরেই সেই চাকরিতে জয়েন করেন খালেদ। সংসারের হাল ধরেন মাত্র ১৬ বছর বয়সে। অঢেল জমির মালিক হলেও কিন্তু সেই জমি থেকে তো আর পয়সা বেরুবে না। তাঁর বাবা যখন জমি বিক্রি করতে চাইতেন ছেলে বাঁধ সাধতেন। বলতেন বিক্রি করলেই তো সবশেষ। আমি নিজেই কিছু করব। কুদ্দুস মাস্টারের সর্বোচ্চ চেষ্টা ছিল আগে পারিবারিক সু –শিক্ষা, ধর্মীয়,সামাজিক মূল্যবোধ আর নীতি- নৈতিকতার শিক্ষায় মানুষ করতে সন্তানদের। সেভাবে তৈরি করেছিলেন প্রথম সন্তানকে। বাবাকে কথা দিয়েছেন নিজেই হাল ধরবেন কিন্তু কীভাবে? এই সংসার যে বিশাল বড়। এতোটুকু একটা কিশোর কেমন করে কীভাবে এতো বিশাল পরিবারে নির্ভরতার জায়গা হবেন তা ভেবেই চিন্তিত। এদিকে আবার বাবার আদেশ পড়াশোনা কামাই করা যাবে না। পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে হবে।
স্কুলের চাকরিতে আর কত টাকা মাইনে? ঘরে আছে নিজে সহ সাত ভাই, সাত বোনের বিশাল একটি পরিবার। সদস্য সংখ্যা ১৪ জন। শেষমেষ নিজ সিদ্ধান্ত মতো জীবিকার টানে চলে আসেন শিক্ষতা ছেড়ে চট্টগ্রাম শহরে। অনেক ঘোরাঘোরি শেষে চাকরি নেন একটি ফ্যান কোম্পানিতে। পাশাপাশি সরকারি সিটি কলেজে ভর্তি হন নাইট শিফটে। রাতে ক্লাস, সকালে চাকরি এইভাবেই শুরু হয় জীবনের নতুন ধাপ। ভাই- বোন সবার পড়ার খরচ সংসারের খরচ একাই বহন করতে শুরু করলেন। ভাই-বোনদের মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। পাশাপাশি লোন করে সাতটি বোনের একের পর এক বিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব চলছিল। অবাকের ব্যাপার প্রতিটি ভাই- বোনকে সু শিক্ষায় গড়ে তুলেছিলেন। খুব কঠিন একটা ব্যাপার এতোজনকে মানুষের মতো মানুষ করা।
এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেলো যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ । দেশে শুরু হয়ে গেছে পাকিস্তানী তাণ্ডব। ঘরে বসে থাকা দায়। দেশপ্রেম তো আর মন থেকে যায়না। যে ছেলে মাটিতে গড়াগড়ি করে বড় হয়েছে সেই মাটি শত্রুর দখল করবে এটা আর কেউ মানলেও খালেদ মেনে নিতে পারেনি। তাছাড়া তাঁর বাবা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা ছিলেন দেশের জন্য জেল খেটেছেন। এমন বাবার সন্তান দেশ বাঁচানোতে পিছ পা হবেন ভাবতেই পারেন না। ঝাঁপিয়ে পরলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। একটি মিশনে আর্মিদের ছোঁড়া গুলিতে প্রায় প্রাণ যায় যায় কিন্তু ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি। অবশেষে, দেশ স্বাধীন করে ক্যাম্প থেকে ফিরে এলেন নিজ বাড়ি। বসেন বিয়ের পিড়িতে। বিয়ের পর প্রথম সন্তান মারা যান এর পর হয় আমার বড় বোন তারপর আরও একটি বোন মারা যান। তারপরে জন্ম হয় আমার। বাবার বড় আদরের সন্তান ছিলাম আমি। একের পর এক সন্তান হারাতে আমার বাবা খুব ভয় পেতে লাগলেন । আমার মা খুব কড়া ছিলেন । ছেলেমেয়েদের কড়া শাসনে রাখতেন। ছোট বেলায় খুব দূরন্ত আর ডানপিঠে ছিলাম আমি। ছিলাম পড়ালেখায় মস্ত বড় ফাঁকিবাজ। তাই এই দুষ্ট মেয়েটিকে বেশি দেখভাল করতে হয়েছে বাবাকেই। সকাল বেলা ঘুম থেকে ডেকে স্কুলের ড্রেস পরিয়ে নাস্তা করিয়ে স্কুলের টিফিনটাও রেডি করে দিতেন আমার বাবা। আমাকে স্কুলে দিয়ে তারপর তিনি অফিসে যেতেন । একটা মজার ব্যাপার হলো একদিন এক ছেলে আমাকে স্কুলে ডিস্টার্ব করতো সেই কথা মা জানতে পেরে চিন্তায় অস্থির হয়ে পরেন। আমার পড়ালেখা প্রায় বন্ধ হওয়ার অবস্থা। কিন্তু নাহ আমার বাবার সাপোর্টেই সেদিন এই যাত্রায় বেচে গিয়েছিলাম। আমার মায়ের ভাষ্য ছিল আমি যেমন বিয়ের পরে পড়েছি তুমিও পড়বা । সেদিন যদি বাবা পাশে না থাকতো আজ আমি দেশ সেরা কলেজের একজন ছাত্রী হতে পারতাম না।
একদিন পুকুরে পরে গিয়েছিলাম সেই থেকে আমার বাবা আমাকে চোখের আড়াল হতে দিতেন না। টাইফয়েডে জ্বরে মৃত প্রায়। বাবা রাত দিন পাশে বসে মাথায় পানি ঢেলে, ওষুধ খাওয়ানো থেকে শুরু রাত- দিন নামাজ পরে দোয়া-দুরুদ পড়তেন। আমি আড়চোখে তাঁর লুকানো ছলছল করা চোখের পানি দেখতাম। ওষুধে ভালো হতে দেরি হলে হুজুর এনে ঝাড় ফুক করাতেন যদি কোন খারাপ বাতাস সন্তানকে ভর করে। মা সব সময় বলতেন মেয়েদের শরীর খারাপ হলে ছাঁদে উঠতে নেই। কিন্তু কে শোনে এসব। ছাঁদে উঠে ঠিকই টৈ টৈ করতাম। সেই কথা আমার বাবাকে খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিল।বাবা-মায়ের সেবায় সে যাত্রায় তিনমাস পর সুস্থ হয়ে উঠলাম।
একদিন হারিয়ে গিয়েছিলাম একটা বিয়ে বাড়িতে গাড়িতে সবাই আছে। কিন্তু আমি নেই। বাবার দু, চোখে অস্থিরতা হন্য হয়ে মেয়েকে এদিক খোঁজে ওদিক খোঁজে । কিন্তু সেকি , মেয়েকে পাওয়া গেলো বিয়ের বাড়ির টিভির সামনে । যেখানে সব শিশুরা মিলে টিভি দেখছিল।আমি ভেবেছিলাম সেরেছে এক বাক্স বকুনি খাবো ।
কিন্তু এসব কিছুই হলোনা। সেদিন বাবার চেহেরা দেখার মতো বুকে জড়িয়ে কান্না জুড়ে দিল।
এরপর বেড়াতে গেলে বাবার হাতের আঙ্গুল ছাড়তে বারণ। বাবার স্বপ্ন ছিল প্রতিটি ছেলে মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার। তিনি সৎ এবং নিতিবান মানুষ ছিলেন প্রতিটি ছেলে মেয়ের কোথাও ভর্তির পিছনে কখনো সুপারিশ করেননি বলতেন যে হবে সে সৎভাবেই মানুষ হবে নতুবা নয়। আমার দ্বারা দুর্নীতি সম্ভব না। তার কোন দুর্নীতির রেকর্ড নেই । অনেক বড় বড় কারখানার মালিক বর্তমানে আমার বাবার হাত ধরে এগিয়ে গেছেন এবং অনেকের কাছে লাখ লাখ টাকাও পান। তারা সবাই আমার বাবার সরলতাকে পুঁজি করে ঠকিয়েছেন। আমার বাবা মুখের কথা খুব বিশ্বাস করতেন। তাই ঠকাটা স্বাভাবিক। শুধু মুখের কথার ওপর বিশ্বাস করে কেউ টাকা পয়সা লেনদেন করেন এমন মানুষ পৃথিবীতে আছে কিনা আমার জানা নেই।
বাবা সবসময় একটি কথা বলেন আমাদের দেখ বাবা আমি তোমাদের জন্য একটি সম্পদ দিয়ে যাচ্ছি তা হলো লেখাপড়া আমি থাকতে তোমরা লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হও, এটাই আমার চাওয়া। আমার শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত দিয়ে আমি তোমাদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করার চেষ্টা করব। আমি আমার রক্ত বেচা পয়সা দিয়েই তোমাদের মানুষ করার চেষ্টা করছি। তোমরা আমায় নিরাশ করোনা।
যখন টাকার প্রয়োজন হত, বাবা নিজে থেকেই টাকা দিয়ে বলতো আরও লাগলে বলো। নিজে শত কষ্টের মধ্যে থেকে বুঝতে দিতেন না। বাবার কাছে যখন যা চেয়েছি, পেয়েছি। সংসারের সকল দায়িত্ব পালন করার পর বাবার আরেকটি অভ্যাস সমাজসেবা। আমার বাবা একটি মসজিদের আর কলেজের উদ্যোক্তা। কিন্তু পৃথিবীতে যে ভালো মানুষের কদর নাই তাই প্রমাণ পেলাম বাবাকে দিয়ে। বাবাকে ওই মসজিদের সভাপতি করার কথা ছিল কিন্তু যাদের তিনি ডেকে এনে গদিতে বসালেন তারাই বাবাকে পদ থেকে সরিয়ে নিজে বসে যান। আমরা যখন রাগ করে বলি কি লাভ হলো আপনার এতো কষ্ট করে? উত্তরে তিনি বলেন, আমার গড়া এই মসজিদে হাজার হাজার মানুষ নামাজ পড়বে ওই মরণের পর সন্মান পাবো। তিন হাত মাটির নিচেই সবাইকে যেতে হবে। তাই মন খারাপের কিছুই নেই। এমন কথা বললে বাবাকে আর কোন সন্তানের সাহস হতোনা প্রশ্ন করার। এখনো আড়ালে নীরবে গরীব দুঃখীদের সেবা করে যাচ্ছেন তিনি।
একবার ব্যাংক থেকে টাকা ধার করেছিলেন । চিন্তিত অনেক। রমজানের ঈদের সময় বাবা সবার জন্য ঈদের পোশাক নিয়েছেন, কিন্তু নিজের জন্য কিছুই নেননি।বাবাকে বলেছিলাম বাবা আপনি একটা কিছু নেন। তখন তিনি বলেন, তোমাদের হলেই আমি খুশি।
আমরা ছয় ভাই বোন সবাই যার যার জায়গায় ভাল অবস্থানে লেখাপড়া করে যাচ্ছে। এখন আমার মা নেই মার গেছেন আজ দু,বছর বাবা -মা দুজনের ভালোবাসা দিয়েই তিনি আমাদের ঘিরে রেখেছেন। বাবা আমাদের মাঝে মা কে দেখতে পান। তিনি রোজ কাঁদেন মায়ের জন্য। এমন দৃশ্য দেখে আমার বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যায়। স্ত্রীর জন্য হু হু করে কাঁদতে দেখা এমন মানুষ আমি কম দেখেছি।
বাবার সব চেয়ে ছোট ছেলে আবীর সে পড়ে ক্লাস টেনে মা মারা যাওয়ার পর বাবা শুধু তাকে বুকে জড়িয়ে রাখেন যেন মায়ের অভাব সে বুঝতে না পারে। মা যেভাবে মশারী টাঙ্গিয়ে মশারীর ওপর কাপড় লাগিয়ে দিতেন ঠিক সেভাবে বাবাও করেন সন্তানের জন্য। মা যেভাবে প্রতি রাত তার সব সন্তানকে নামাজ পড়ে ফু দিতেন তেমনি তিনিও করেন।তার খুব বাজে অভ্যাস যেটা তিনি কখনো কাউকে নিজের অসুখের কথা বললেন না। শরীর খারাপ লাগলেও কাউকে কিছু বলতে চান না।একদিন বাবা স্ট্রোক করেন। তিনি হাসাতালে নিজে ভর্তি হয়ে ফোন করে বলেন, কিছু না সামান্য বুকে ব্যথা। আহারে বাবা সে ব্যথা বাবাকে নিয়ে যায় এইচ ডি ওতে । দুই দিন বাবা অজ্ঞান। কি কান্না আমাদের আল্লাহর কাছে প্রার্থনায় মগ্ন । আমার বাবাকে সুস্থ করে দাও। আমাদের ছায়া কেঁড়ে নিওনা। মাকে কেঁড়ে নিয়েছ কষ্টে বুকে পাথর চাঁপা দিয়েছি।কিন্তু বাবা...। হাসপাতালে পায়চারী নির্ঘুম চোখ বিশেষ করে আমার।
দুইদিন পর আমার প্রিয় বাবা চোখ মেলে। শুকরিয়া আদায় করলাম খোঁদার দরবারে। সারা জীবন নিজের ভাই- বোন, স্ত্রী -সন্তানদের জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন তিনি হলেন বাবা। বলা হয়না কখনো বাবাকে ভালোবাসি। কিন্তু এই লেখনি দিয়েই বলছি বাবা আপনাকে অনেক অনেক অনেক ভালোবাসি । যার শেষ নেই। পরিমাপ নেই।এই লিখা আপনাকে ভালোবাসি বলার সামান্য প্রমাণ , একটি দলিল।
লেখক: শিশুসাহিত্যিক।

মন্তব্য করুন