তাবলিগের সেই চার দিনের মতো শান্তি কখনো পাইনি

অধ্যাপক আসিফ নজরুল
  প্রকাশিত : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ২১:০৭| আপডেট : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০, ২১:২০
অ- অ+

আমি প্রথম তাবলিগে যাই ১৯৯৮ সালে। তখন লন্ডনে ছিলাম। পিএইচডির দুশ্চিন্তায় মাথা খারাপ অবস্থা আমার। পিএইচডি না হলে দেশে ফিরবো না কখনো - এটা ভেবে কান্না আসতো। আত্মহত্যা করবো কি না এমনকি এই চিন্তাও আসতো মাথায়।

এমন ছিন্নভিন্ন মানসিক অবস্থায় আমার প্রতিবেশী হয়ে আসেন আমার একজন কলিগ। তিনি আইন বিভাগে আমার সিনিয়র শিক্ষক লিয়াকত আলী সিদ্দিকী। ছাত্রজীবনে একসময় বিতার্কিত হিসেবে নাম করেছিলেন। প্রথমদিকে পড়তেন জিনস, টি-শার্ট আর কেডস। অল্পদিন পর থেকে পুরো ইসলামি পোশাক।

তিনি আমার মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরেছিলেন। প্রায় প্রতিদিন ডেকে খাওয়াতে নিয়ে যেতেন, পড়াশোনা নিয়ে বেশি চিন্তা করতে মানা করতেন। তিনি নিজে লন্ডনে মাস্টার্স শেষ করার একমাস আগে দীর্ঘদিনের জন্য তাবলিগে চলে গিয়েছিলেন, ডিগ্রিটা শেষ করেছিলেন ছয় বছর পর। এ দুনিয়ার সাফল্য, খ্যাতি, অর্জন সত্যি তুচ্ছ তার কাছে। কাজেই তিনি এসব বললে মন দিয়ে শুনতাম।

কিছুদিন পর জানা গেল তিনি আবার তাবলিগে যাচ্ছেন লিডস্-এ। আমিও যেতে রাজি হলাম। চার দিনের পড়া শিকেয় তুলে রাখার এই সাহস কীভাবে পেলাম জানি না। ফোনে স্বজনদের জানিয়ে দিলাম কোনো যোগাযোগও করতে পারবো না কয়েকদিন।

মক্কার হজযাত্রীদের মতো পবিত্র মনে রওয়ানা দিলাম লিডসের পথে। বাসে সবাই দোয়া দরুদ পড়ছে, আমিও যোগ দিলাম। সেখানে গিয়ে দেখি বিভিন্ন দেশের ছাত্রদের মেলা। কাউকে চিনি না, কিন্তু কয়েক মুহূর্তে এমন আপন হয়ে গেল সবাই। চোখাচোখি হলে হাসে, সালাম দেয়, খাবার নিতে গেলে এ ওকে ঠেলে দেয় আগে, কোনো একটা সাহায্য করার জন্য মুখিয়ে থাকে সবাই।

দিনরাত গোল হয়ে বসি। একজনের পর একজন সুরা পড়ি। কেউ কেউ ধর্মের বয়ান দেন। দোজখ-বেহেশতের বিবরণ না, সেখানে শুধু ভালো, নিঃস্বার্থ আর সৎ হওয়ার শান্ত আহ্বান আর সৃষ্টি রহস্যের আকুল অনুসন্ধান।

তাড়া নেই, অপেক্ষা নেই, চিন্তা নেই- আশ্চর্য এক প্রশান্তিময় সময়। ঘুমাতে গেলে ঘুম আসে, গভীর ঘুম অনায়াসে ভাঙে আজানের শব্দে। যেটা খাই অমৃতের মতো লাগে, যতটুকু খাই মন ভরে থাকে। বুকের ভেতর আচড় নেই, নেই দাহ, হাহাকার! কিসের পিএইচডি, কিসের ঘর-সংসার। মনে হলো যাব না এ জায়গা ছেড়ে কোনোদিন আর।

আমার জীবনে তীব্রতম, অবিশ্বাস্য, দুঃসাহসী আর অপার আনন্দের বহু স্মৃতি আছে। কিন্তু সবচেয়ে প্রশান্তিময় দিন কেটেছে লিডস্-এর মসজিদে। যে সৃষ্টিকর্তাকে আমি ছোটবেলা থেকে খুঁজি গাছের নবীন পাতা, আকাশের অবিরাম বদলে যাওয়া, দূর নক্ষত্রের নিশ্চল আলোয় আর মাঝরাতে অবিশ্রান্ত বৃষ্টির ঘোর লাগানো বর্ষণে, লিডস্-এ আমি তাকে অতি সামান্য হলেও অনুভব করতে পেরেছিলাম। যে শান্তি আমি পেয়েছি সেই চারদিন তা আর পাইনি আগে পরে কখনো।

জীবনের সব দায় শোধ হলে আমি একদিন আবার চলে যাবো তার খোঁজে। অনন্তকালের জন্য। জানি না তিনি আমাকে সে সুযোগ দেবেন কি না!

লেখক: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
প্রথম প্রেমের স্পর্শ: পর্ব ১০- একটি অসমাপ্ত কবিতার ঘরে ফেরা
মাস্কের নতুন দল গঠনকে ‘উদ্ভট’ বললেন ট্রাম্প, সমালোচনা করলেন নিজেরই নাসা প্রধানের
ভোররাতে হাতিরঝিলের অ্যাম্ফিথিয়েটারে ফুটবল বাঘিনীদের বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা
গাজায় ইসরাইলি হামলায় প্রাণ গেল আরও ৮২ ফিলিস্তিনির
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা