সামাজিকীকরণ থেকে পিছিয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা

তানিয়া আক্তার, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১০:৩৪

করোনাভাইরাসের প্রভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ দীর্ঘদিন। টিভি ও অনলাইনে চলছে পাঠদান। এভাবে পাঠদান অব্যাহত রাখার চেষ্টা করা হলেও শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শ্রেণিভিত্তিক পঠন-পাঠন না থাকায় শিক্ষার্থীর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে ব্যাপক ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের শুধু অনলাইনে পাঠে মানসিক বিকাশে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) শিক্ষক উম্মে মুস্তারী তিথি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘শিক্ষানীতিতে শিক্ষার্থীর সৃজনশীল, মানসিক, শারীরিক ও নান্দনিক এরকম বেশ কয়েকটি পয়েন্ট বলা আছে যা শিক্ষার মাধ্যমেই এই বিকাশগুলো করতে হবে। আর শিক্ষাক্রম এমনভাবে ডিজাইন করা থাকে যেখানে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানমূলক, অনুভূতিমূলক, মনোপেশিজ এই বিকাশগুলো সম্ভব হয়।’

উম্মে মুস্তারী তিথি বলেন, ‘ফলে শিক্ষার্থীর বইয়ের কনটেন্টগুলোই এমনভাবে তৈরি করা হয় যেখানে গল্প-কবিতা প্রবন্ধের মাধ্যমে শিক্ষার্থী জ্ঞানের বিকাশ, অনুভূতির বিকাশ অর্থাৎ স্কুলে সরাসরি একজন শিক্ষক গল্প কবিতার যে নৈতিকতা সহমর্মিতার বিষয়গুলো থাকে সেগুলো শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে দেন ফলে তার অনুভূতিমূলক বিকাশ হয়। এটি সামাজিকীকরণের জন্য সবচেয়ে জরুরি। এছাড়া মনোপেশিজ অর্থাৎ একটা বিষয় জানবে পাশাপাশি হাতে-কলমে অর্থাৎ পেশীর ব্যবহারের মাধ্যমেও শিখবে। এগুলো শিক্ষাক্রমে লিখিতভাবে দেয়া থাকে যা শিক্ষক বিষয়গুলো জ্ঞান দানের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মানসিক গঠন তৈরি করে।’

অনলাইন পাঠে শিক্ষক শুধু জ্ঞানভিত্তিক বিকাশে সহায়তা করতে পারেন মন্তব্য করে উম্মে মুস্তারী বলেন, ‘কিন্তু সরাসরি শিক্ষকের এবং সহপাঠীদের সংস্পর্শে না থাকায় অনেকগুলো বিকাশ উহ্য থেকে যাচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থী ঘরে বসে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানগুলো অর্জন করলেও অনুভূতিমূলক এবং মনোপেশিজ অর্থাৎ জানার পাশাপাশি হাতে-কলমে না শিখতে পারায় শিক্ষাক্রমের উদ্দেশ্যগুলো সফল হচ্ছে না অনেকাংশেই।’

এদিকে জুন মাসে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এর এক গবেষণায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার সময় ৮০ শতাংশ কমেছে বলে উঠে এসেছে। যেখানে গ্রামের শিক্ষার্থীরা দিনে স্কুল, কোচিং ও বাড়িতে নিজেদের পড়ালেখা মিলে ১০ ঘণ্টা ব্যয় করত, এখন তা নেমে এসেছে মাত্র দুই ঘণ্টায়, অর্থ্যাৎ ৮০ শতাংশ সময় কমেছে পড়াশোনার।

এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের এই সময় শিশুশ্রমের হারও বেড়েছে। গবেষণায় তথ্যানুযায়ী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের আগে যেখানে ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী দুই ঘণ্টার বেশি আয়মূলক কাজে জড়িত ছিল এখন তার হার দাঁড়িয়েছে ১৬ শতাংশে। এই তথ্যগুলো গ্রামের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে পাওয়া গেছে। আর শহরের বস্তি এলাকায়ও চিত্রটা মোটামুটি একইরকম।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কার্যক্রমে শিক্ষার্থীরা রাগের নিয়ন্ত্রণ কীভাবে করতে হয় সেটা শেখে। কোনো বিষন্নতার বিষয় নিজের মনের মধ্যে আটকে না রেখে পরস্পরের সঙ্গে শেয়ার কিংবা সুস্থ প্রতিযোগিতা করতে শেখে। শিক্ষকরাও সরাসরি পাঠদানে শিক্ষার্থীর মানসিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে তাদের বোঝানো কিংবা অভিভাবকদের সতর্ক করে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে পারেন।’

মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘কিন্তু বাসায় বসে শুধু অনলাইন পাঠ নিলেও বাকি সময়টা অলস এবং বিরক্তিতে কাটছে তাদের। আর অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। তাই এ কারণে অপরাধ প্রবণতা তৈরি হতে পারে যদি ঘরের শৃঙ্খলা ভালো না থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে সন্তানদের সময় দেয়া কিংবা বিভিন্ন বিষয় শেয়ার করার চর্চা অনেক বাবা মায়েরই থাকে না। সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অপরাধ প্রবণতার ঝুঁকিও কিছুটা যায়। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গেলে প্রতিদিনের রুটিন অনুযায়ী শিক্ষার্থীর মানসিকতায় যে শৃঙ্খলা তৈরি হয় সেটি পুরো জীবনের ওপর একটা ভূমিকা রাখে যা এখন অনুপস্থিত।’

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘গ্রামের নিম্নবিত্তের অনেক পরিবার মনে করে যে স্কুল খুলে দিলেই এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ায় আবার শহরের মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের অভিভাবকেরাও ভাবেন যে স্কুলে না গিলেই কী হবে বা না খুললেই কী হবে, পড়ালেখা যা হবার তা তো হচ্ছেই।’

রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘এছাড়া অভিভাবকদের আরেকটা অংশ বাণিজ্যিকভাবে যে অনলাইন কোচিংগুলো আছে সেখানে ভরসা করেই নিশ্চিন্ত থাকতে চান। কিন্তু সারাবিশ্বেই প্রচলিত যে শ্রেণিকক্ষের ভেতর পঠন-পাঠনের বিকল্প নেই। সেখানে শিক্ষকের সরাসরি পাঠদানে শিক্ষার্থীর মেধা ও মননের বিকাশ তৈরি হয়।’

একজন শিক্ষার্থী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দিনের অনেকটা সময় একটা চমৎকার আবহে সামাজীকিকরণসহ অনেককিছু শিখে উল্লেখ করে এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্লাসরুম তো বটেই স্কুলের আঙিনা সামাজিকতা শেখার অন্যতম জায়গা। কিন্তু দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনলাইন পাঠদানে জ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা অর্জনেও অনেকটাই পিছিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের সামাজিকীকরণ থেকে শুরু করে অনেকগুলো বিষয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শুধু টিভি পাঠদানে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানও পুরোপুরি অর্জন করা সম্ভব না কারণ কারিকুলামগুলো শ্রেণিকক্ষের উপযোগী করে তোলা। তবুও সরকারের প্রচেষ্টায় যতটুকুই অনলাইন পাঠদানের শেখা সম্ভব হচ্ছে সেক্ষেত্রে অনেকের বাড়িতেই টিভি নেই।’

(ঢাকাটাইমস/২০সেপ্টেম্বর/ডিএম/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :