করোনাকালে হায়রে মৃত্যু, হায়রে গ্রামবাসী

রফিকুল ইসলাম রনি
| আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০২১, ১৫:৩৫ | প্রকাশিত : ২৪ এপ্রিল ২০২১, ১৫:০৮

হে আল্লাহ তুমি এমন মৃত্যু দিও না, যে মৃত্যুর পর বাপের ভিটায় লাশ দাফনেও গ্রামবাসী বাধা হয়! এমনিতে গত কিছুদিন যাবত কাছের মানুষ, শ্রদ্ধা-ভালোবাসার মানুষ, অভিভাবকদের মৃত্যুতে বুকে শোকের পাথর বেঁধে আছি। সেহরি খাওয়ার পর আরও একটি সংবাদ বুকের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে উঠল। কী নিষ্ঠুর! কী অমানবিক! কী নির্মম! সেই কথাটিই শেয়ার করতে লিখছি। আর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি, ‘হে আল্লাহ তুমি এমন মৃত্যু দিও না, যে মৃত্যুর পর বাপের ভিটায় লাশ দাফনেও গ্রামবাসী বাধা হয়!’ করোনা নামক মহামারিতে বাংলাদেশের মৃত্যু সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়েছে বেশ কয়েকদিন আগে। কয়েকদিন আগে দৈনিক মৃত্যুর হার ‘তিন সংখ্যা’ ছাড়িয়েছে। অর্থাৎ শতকের উপরে। গত তিনদিন ধরে শতকের নীচেই। এই শতকের নীচে মৃত্যুর তালিকায় যোগ হওয়া একজন ব্যক্তি আমার ভাতিজা যুগান্তরের স্টাফ রিপোর্টার হাসিবুল হাসানের মামা শ্বশুর। এ মৃত্যুর সংবাদটি গতকাল সন্ধ্যায় শুনতে পাই।

করোনায় আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন রাজধানীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। প্রথম দফায় আইসিসিইউতেও ছিলেন বেশ কয়েকদিন। এরমধ্যে করোনা নেগেটিভও হয়। কিন্তু অন্যান্য জটিলতা বেড়ে যাওয়ায় আবার আইসিসিইউতে ভর্তি করা হয়। শুক্রবার বিকালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে চিরদিনের জন্য বিদায় নেন তিনি।

মরহুমের বাড়ি আমার উপজেলা এমনকি নিজ ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী একটি গ্রামে। কিন্তু তিনি নারায়ণগঞ্জে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। নারায়ণগঞ্জে বসবাস করলেও গ্রামের কবরস্থানে বাবা-মা-ভাইসহ আত্মীয় স্বজনের পাশেই কবর দিতে ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন, মরহুমের সন্তানেরা। তাই নারায়ণগঞ্জে এক দফা জানাজা নামাজ শেষে তাড়াশের দিকে রওনা হয় সন্ধ্যা রাতেই। রাত দশটার দিকে ভাতিজা ফোন করে। আমি তখন অফিস থেকে মোটরসাইকেল চালিয়ে বাসায় ফিরছি। ফোনে জানালো, মামা শ্বশুড়কে গ্রামে নিয়ে দাফন করা হবে। কিন্তু সম্ভবত গ্রামবাসী ঝামেলা করবে! দাফন করতে দেবে না। আপনি একটু থানায় কথা বলেন। আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, এ গ্রামে ‘অমুক’ ভাই আছে না? তাকে বলে দিচ্ছি তুই যাও কোনো সমস্যা হবে না। (সেই অমুক ভাই-আমার নিকট আত্মীয়ও এবং একই আদর্শের। কিছুদিন আগে ভোটের মাধ্যমে ইউনিয়নের শীর্ষ নেতা নির্বাচিত হয়েছেন)। বড় আশা নিয়ে সেই ভাইকে রাত সাড়ে দশ্টার দিকে ফোন করি।

দীর্ঘ ৬ মিনিট তার সাথে কথা বলে যা বুঝলাম, করোনা সংক্রামক রোগ। প্রশাসন জেনে গেছে-এ লাশ গ্রামে দাফন করতে দেওয়া হবে না! আমি বললাম, আপনি এত সচেতন মানুষ, তারপরও নেতা। আপনিই এমন কথা বললে গ্রামবাসী কী বলবে? আর লোকটি করোনায় মারা যায়নি, কয়েকদিন আগেই তার রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। এটাও বললাম, আপনারা দাফনে অংশ না নিলেও ওদের আত্মীয় স্বজন যারা যায়, তাদেরকে দাফন করার সুযোগ দিন। তার প্রশ্ন-ওরা তো গ্রামের লোকজনের সাথে ঘুরে বেড়াবে। তাদের থেকে করোনা হবে।

বললাম, মৃত্যুর তিনঘণ্টা পর রোগী শরীর থেকে করোনা ছড়ায় না। যাই হোক, কথা বলে সুবিধা হবে না, যেনে ফোন রেখে দিলাম। তাকে ম্যানেজ করতে ফোন করলাম উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সনজিত দাদাকে। দাদা আশ্বস্ত করলেন, আমি বলে দিচ্ছি। ফোন করেছেনও। এরমধ্যে ভাতিজা আবার ফোন করে বললেন, কথা বলছেন কি? গ্রামবাসী তো বড় ঝামেলা করবে মনে হয়।

নিরুপায় হয়ে ফোন করলাম তাড়াশ প্রেসক্লাবের সভাপতি সনাতন দাশকে। কিছুক্ষণ কোন উত্তর না পেয়ে আবারও তাকে ফোন করলাম। এরপর সনাতন দাদা ফোন ব্যাক করে বললেন, উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে বলে দিয়েছি। ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমিও ফোন দিলাম উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে। খুব আন্তরিকভাবে আমার কথা শুনলেন এবং তাড়াশ প্রেসক্লাবের সভাপতি এ বিষয়ে অবহিত করেছেন বলেও জানালেন। একই সঙ্গে জানালেন, সেই অমুক ভাই তাকে ফোন করেছিলেন, ধরতে পারেননি। পরে বিষয়টি সনাতন দাশের মাধ্যমে অবহিত হওয়ার পর ফোন ব্যাক করে নিদের্শ দিয়েছেন ‘মরহুমের লাশ দাফনে কোন ঝামেলা করা যাবে না-বরং আপনারই দায়িত্ব (যেহেতু রাজনৈতিক দলের নেতা, যে দলের ভ্রাতৃপ্রতিম ও সহযোগী সংগঠনের নেতারাও প্রথম থেকে করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের লাশ নিজ কাধে নিয়ে দাফন-কাফনে অংশ নিয়েছেন, এ জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেই সংগঠনের নেতাকর্মীর প্রশংসা করেছেন-করছেন)। ভাতিজাকে বিষয়টি আবারও জানালাম, আর ঝামেলা হবে না। আত্মতৃপ্তি নিয়ে ঘুমাতে গেলাম, যে হয়ত আমার প্রচেষ্ঠায় একজন মরা মানুষ তার বাবা-মায়ের কবরের পাশে ঘুমাতে পারবেন।

কিন্তু ভোর রাতে সেহরি খেতে উঠে ভাতিজাকে ফোন করে নিষ্ঠুর ও নির্মম কাহিনী শুনে শুধু অবাকই হইনি, বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচরে উঠল। লাশ নিয়ে গ্রামে ঠিকই গেছে, কেউ বাধাও দেয়নি। কিন্তু যারা গোর খোদক, তাদের পর্যন্ত কবরস্থানে থাকতে দেওয়া হয়নি। দাফন-কাফনে হয়ত মানা করা হয়েছে ভাই-ভাতিজাসহ আত্মীয় স্বজনদের! গ্রামে ‘সমাজ’ বলে কথা আছে। হয়ত বলা হয়েছে, যারা দাফন কাফনে অংশ নেবে তাদেরকে ১৫ দিনের লকডাউন দেওয়া হবে। সামনে ঈদ কে চাইবে ১৫ দিন ঘরবন্দী থাকতে। তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও হয়ত দাফনে অংশ নেয়নি কেউ। আর ওই নেতাও হয়ত গ্রামের মানুষের কাছে অসহায়। না হলে তার নেতা (উপজেলার সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার বলার পরও কেন এমন করবে?

এদিকে যে গ্রামবাসীর কথা চিন্তা করে মরহুমের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হলো, গ্রামে সেই গ্রামবাসীর এমন আচরণ ভালভাবে মেনে নেয়নি ছেলে-মেয়ে। তাই বেঁকে বসলেন, বাবার লাশ নিয়ে আবার ছুটে আসবেন দুইশ কিলোমিটার দূরে ‘নারায়ণগঞ্জে’। এখানে দাফন করবেন, যেখানেই কেউ বাধা দিবে না। আমি কথা বললাম- মৃত্যু ব্যক্তিকে এমন কষ্ট না দিয়ে যে কয়েকজন আছো, সে কয়েকজন মিলেই মাটি দাও। এরপর শুরু হলো আবার ছেলে মেয়েকে বুঝানোর প্রক্রিয়া। অবশেষে ফজরের আযানের পর ঢাকা থেকে যাওয়া ৮জন, আর উল্লাপাড়া থেকে যাওয়া দুজন ও পাশের গ্রাম থেকে যাওয়া একজন। মোট ১১ জন মিলে দাফন করা হলো সেই মরদেহ। হায়রে মানুষ! হায়রে আত্মীয় স্বজন? হায়রে সমাজ। হায়রে নেতা। কিসের এত বড়াই করো? গ্রামে কি করোনা যায়নি? কেউ কি করোনায় আক্রান্ত হবে না? যার যায় সে বোঝে কি চলে গেল।

আবারও আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করছি, আল্লাহ তুমি এমন মৃত্যু দিও না, যেখানে আমার বাপ-চাচার ভিটেয় মাটি দিতে গ্রামবাসী বাধা হবে। কারণ আমার গ্রামে পারিবারিক কবরস্থান নেই। আমার বাপ-চাচার ভিটায় আমাদের গ্রামের কবরস্থান। সেই কবরস্থানে যদি আমি শেষ যাত্রায় ঘুমাতে না পারি, আত্মা শান্তি পাবে না। যদিও আমার গ্রামবাসী এমন না। কিন্তু আমি চাই না-চিরনিদ্রায় শায়িত হওয়ার সময় গ্রামবাসীর মনে খটকা লাগুক। আমি চাই এমনভাবে আমার মৃত্যু হবে, যে মৃত্যুতে গ্রামবাসীই শুধু নয়, উপজেলাবাসী চোখে জল ফেলে শেষ বিদায় জানাবে।

লেখক: সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :