নোয়াখালীতে বন্ধ ১৩০০ খামার, মাসপ্রতি ক্ষতি ২০ কোটি টাকা

মিজানুর রহমান রিয়াদ, নোয়াখালী
 | প্রকাশিত : ২৬ এপ্রিল ২০২১, ১৭:৩৪

পোল্ট্রি খামার ব্যবসায়ী ৩০ বছর বয়সী আল মামুন। ২০১৫ সালে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চরএলাহি ইউনিয়নের গাংচিলে প্রথমে ৩২ হাজার মুরগি নিয়ে পোল্ট্রি খামার ব্যবসা চালু করেন। পরবর্তীতে ব্যবসায় সফলতা এলে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে সুদে ঋণ নিয়ে একে একে নয়টি খামার গড়ে তুলেন তিনি।

ব্রয়লার, লেয়ার, সোনালী- এই তিন প্রজাতির প্রায় ৫৫ হাজার মুরগি ছিল তার খামারগুলোতে। ২০১৯ সাল থেকে তার খামারগুলোতে রোগের আক্রামণ শুরু হয়। রাণীক্ষেত, গামবোরা, ককসিডিওসিস, পুলোরাম, ঠান্ডাজনিত ও বার্ডফ্লুসহ বিভিন্ন রোগে মরতে থাকে খামারের মুরগি। বর্তমানে তার আটটি খামারই বন্ধ হয়ে গেছে।

একই অবস্থা জেলার অনেক খামারির। জেলা পোল্ট্রি খামার অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে গত কয়েক মাসে বন্ধ হয়ে গেছে অন্তত ১৩০০ মুরগির খামার। আর তাতে প্রতি মাসে প্রায় ২০ কোটি টাকার মুরগি ও ডিম উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগই ব্যাংক ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়ছেন। খামারগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়া খামারের মালিকরা যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তেমনি কর্মচারীদের কাজ না থাকায় জেলায় বেকারত্বের হারও বাড়ছে।

খামারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের মাংসের চাহিদার প্রায় ৮০ ভাগই আসে পোল্ট্রি খামারে উৎপাদিত মুরগি থেকে। গরীবের আমিষের যোগান হিসেবে পরিচিত বিভিন্ন প্রজাতির পোল্ট্রি মুরগি। কম দামে পাওয়ায় দেশের প্রতিটি এলাকায় ব্যপক জনপ্রিয় এই মুরগি। এ মুরগির বিভিন্ন জাত রয়েছে। তার মধ্যে ব্রয়লারসহ কিছু মুরগি মাংস ও লেয়ার জাতের মুরগি ডিম উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। আবার সোনালী প্রজাতি মাংস ও ডিম দুটাই উৎপাদনের জন্য জনপ্রিয়। সাত থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে একটি ব্রয়লার মুরগির ওজন দুই থেকে আড়াই কেজি হয়ে থাকে। এরপর তা বাজারজাত করা যায়। পাঁচ থেকে ছয় মাসের মধ্যে ডিম দেয় লেয়ার মুরগি। একবারে তারা ২৫০ থেকে ৩০০টি ডিম দিয়ে থাকে। মুরগির জাত হিসেবে ডিমের রং লাল ও সাদা হয়।

জেলা পোল্ট্রি খামার অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, ২০২০ সালের শেষের দিকে জেলার নয়টি উপজেলায় প্রায় ছয় হাজার পোল্ট্রি খামার ব্যবসায়ী ছিল। খামারগুলোতে মুরগির মাংসের পাশাপাশি ডিমও উৎপাদন হয়ে থাকে। উৎপাদিত মুরগি ও ডিম জেলার মানুষের চাহিদা মিটিয়ে পাশের চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হয়। খামারগুলো থেকে প্রতি মাসে ৬০০ টন মুরগি ও এক কোটি পিস ডিম উৎপাদন হয়। কিন্তু বিভিন্ন সময় রাণীক্ষেত, গামবোরা, ককসিডিওসিস, পুলোরাম, ঠান্ডাজনিত ও বার্ডফ্লুসহ বিভিন্ন রোগে খামারগুলোর লাখ লাখ মুরগি মারা যায়। আর তাতে নিজেদের পুঁজি হারিয়ে গত পাঁচ-ছয় মাসে বন্ধ হয়ে গেছে জেলার অন্তত ১৩০০ খামার। মুরগির খাদ্য, ওষুধ কেনার একটি অংশ সরকারি রাজস্বে যোগ হয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমানে খামারগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লাখ লাখ টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

ব্যবসায়ীদের সংগঠনটি জানায়, ২০১৯ সালে প্রতিটি মুরগির বাচ্চা কিনতে খরচ হতো ৪০-৫০টাকা, মুরগির খাদ্য প্রতি ৫০ কেজির বস্তার মূল্য ছিল ২০৫০ টাকা। দুই বছরের ব্যবধানে বর্তমানে প্রতিটি বাচ্চার মূল্য ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। আর খাদ্য প্রতি বস্তা ২৪৫০ টাকা। খামারে প্রতি হাজার ব্রয়লার মুরগি উৎপাদনে খরচ হয় দুই লাখ টাকা। এর মধ্যে ওষুধ বাবদ ২০ হাজার ও খাদ্য বাবদ এক লাখ ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়। ৩০ দিন পর বাজার উপযোগী হয়ে উঠার পর বিভিন্ন রোগের ক্ষতির পর প্রতি হাজার মুরগি বিক্রি হয় এক লাখ ৬০ হাজার টাকার মতো। তবে রোগ কম হলে এর মধ্যে কিছু মুরগিতে মাঝে মাঝে লাভ হয়।

গাংচিল গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত খামারি আল মামুন বলেন, গত ২০১৯ সালের জুনে রাণীক্ষেত রোগে তার নয়টি খামারের এক কোটি ১৭ লাখ টাকার মূল্যের ১৮ হাজার ব্রয়লার মুরগি মারা যায়। দ্বিতীয় ধাপে ২০২০ সালে জানুয়ারিতে বার্ডফ্লু রোগে মারা যায় ৩৭ হাজার মুরগি। এগুলোর বাজার মূল্য ছিল দুই কোটি চার লাখ টাকা। নিরুপায় হয়ে ওই বছরের ডিসেম্বরে খামারগুলো বন্ধ করে দেন তিনি। বর্তমানে তিনি বিভিন্ন ব্যাংকে সাড়ে তিন কোটি টাকা ঋণগ্রস্ত হয়ে দিশেহার হয়ে পড়েছেন। এতকিছুর পরও সরকার ঘোষিত কোনো প্রণোদনা পাননি বলে অভিযোগ করেন মামুন।

কোম্পানীগঞ্জের চরযাত্রা গ্রামের খামারি জাহাঙ্গীর আলম জানান, তার দুটা খামারে তিনটি ঘরে প্রায় তিন হাজার মুরগি ছিল। কিন্তু মুরগি বাচ্চা, ওষুধ, খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি, যাতায়ত ব্যবস্থা ও খামার পরিচালনায় খরচ বেড়ে যাওয়ায় গত তিন মাস আগে খামার দুটি বন্ধ করে দিয়েছেন। বর্তমানে তিনি এবং তার খামারের চারজন কর্মচারি বেকার হয়ে গেছেন।

চরএলাহী ইউনিয়নের খামারি আরিফুল ইসলাম বলেন, আমাদের পোল্ট্রি শিল্পের বর্তমানে বেহাল অবস্থা। দেশের পরিস্থিতি, বাজারে ওষুধ ও খাদ্য মূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে আমার তিনটি খামার দীর্ঘদিন থেকে বন্ধ হয়ে আছে। বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ায় বর্তমানে নতুন করে শুরু করার সাহসও পাচ্ছি না।

জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলার নয়টি উপজেলায় ব্রয়লার ১৫২১টি, লেয়ার ১৬৯টি, সোনালী/ফাউমি ১৪৭টি ও টার্কি মুরগির ১০৭টিসহ মোট ১৯৪৪টি মুরগি উৎপাদন খামার রয়েছে। এর মধ্যে ব্রয়লারের ৩৪৩টি ও লেয়ারের ৬০টি খামারের নিবন্ধন রয়েছে। তবে এর বাইরে জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরি হওয়ার আরও মুরগি খামার আছে। জেলায় মাংসের চাহিদা রয়েছে তিন দশমিক ৮৪ লাখ মেট্রিকটন আর উৎপাদন হচ্ছে তিন দশমিক ৮৯ মেট্রিকটন। আর ডিমের চাহিদা রয়েছে ৩৩ দশমিক ৯০ কোটি। কিন্তু তার বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছে ২৯ দশমিক ৭৩ কোটি। চাহিদাও উৎপাদনে মাংসের দিক থেকে এগিয়ে থাকলেও খামারগুলোতে ডিম উৎপাদন কম হচ্ছে। বিভিন্ন সমস্যার কারণে কিছু মুরগির খামার প্রতিনিয়ত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আবার এদের মধ্যে কেউ কেউ নতুন করে আবার শুরু করেছেন।

জেলা পোল্ট্রি খামার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার বেলায়েত হোসেন জানান, জেলার বর্তমান পোল্ট্রি খামারিরা একটা সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। এ সিন্ডিকেট কোনো প্রকার পূর্বঘোষণা ছাড়াই মুরগির বাচ্চা, খাদ্য ও ওষুধের মূল্য বাড়িয়ে দেয়। সরকারি কোনো সংস্থ্যার নিয়ন্ত্রণ না থাকায় তারা নিজেদের মতো করে কয়েক মাস পরপর এসব করে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে মুরগি খামারিরা বিভিন্নভাবে ক্ষতিরমুখে পড়লেও বেশির ভাগই সরকারি প্রণোদনা ও স্বল্প সুদে ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ পাননি। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে খামারিরা আরও বিপাকে পড়েছেন। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে প্রণোদনা ও সুদবিহীন ঋণ দিতে সরকারের কাছে অনুরোধ জানান তিনি। প্রণোদনা পেলে ক্ষতিগ্রস্তদের কিছুটা হলেও উপকার হবে।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. শহিদুল ইসলাম আকন্দ জানান, করোনাকালে ও তার আগে বিভিন্ন রোগে মুরগি মারা যাওয়া কিছু খামারি তাদের খামারগুলো বন্ধ করে দিয়েছেন। এর মধ্যে কেউ কেউ আবার নতুন করে চালুও করছেন। জেলার ক্ষতিগ্রস্ত ৭৭৮ জন খামারি প্রণোদনার জন্য আবেদন করেছিলেন। এর মধ্যে গত মার্চে ৭৩৬ জনকে ১৬ কোটি ১৭ লাখ ১৫ হাজার টাকা সরকারি প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ও তালিকার বাইরে ক্ষতিগ্রস্ত যেসব খামারি রয়েছেন উপজেলা পর্যায়ে তাদের তালিকা তৈরি করে প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হবে।

মুরগির বাচ্চা, ওষুধ ও খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি স্বীকার করে এ কর্মকর্তা বলেন, বাচ্চা, ওষুধ ও খাদ্য বাজার নিয়ন্ত্রণে আমাদের কোনো হস্তক্ষেপ নেই। তবে খামারিদের সুবিধার্থে এসবের বাজার একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্যে রাখার উচিত বলে মনে করেন তিনি।

(ঢাকাটাইমস/২৬এপ্রিল/কেএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বাংলাদেশ এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :