কোথায় আছেন সেই অভি?

নব্বইয়ের ডাকসাইটে ছাত্রদল নেতা গোলাম ফারুক অভি। পরে সামরিক শাসক এরশাদের সঙ্গে আপস করে যোগ দেন তার দল জাতীয় পার্টিতে। সেই ধারাবাহিকতায় এরশাদের দলের টিকিটে হন সাংসদ।
রাজনীতির সঙ্গে অপরাধ জগতে আলোচিত সেই অভির সঙ্গেই পরকীয়ায় জড়িয়েছিলেন মডেল তানিয়া মাহবুব তিন্নি। অভির সঙ্গে সম্পর্কের জেরেই তিন্নি স্বামী সাক্কাত হোসেন পিয়ালের ঘর ছেড়েছিলেন। এমনকি মাত্র দেড় বছরের মেয়েকেও রেখে আসেন পিয়ালের কাছে।
কিন্তু যার সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে তিন্নি জগত-সংসারের সব ভুলেছিলেন সেই অভির কাছেই হন প্রত্যাখ্যাত। স্বামীকে তালাক দিয়ে আসার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মর্মান্তিকভাবে খুন হন একসময়ের আলোচিত এই মডেল।
১৯ বছর আগে তিন্নি হত্যা মামলাটির রায় সোমবার ঢাকার সপ্তম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ কেশব রায় চৌধুরীর আদালতে ঘোষণা করার দিন ধার্য ছিল। তবে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের কারণে রায় ঘোষণার তারিখ পিছিয়েছে।
আগামী ৫ জানুয়ারি আদালতে তিন্নি হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দেবেন তার বাবা সৈয়দা তানিয়া মাহবুব ও চাচা সৈয়দ রেজাউল করিম। এতো কিছুর পরেও গোলাম ফারুক অভি এখনও রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
ফ্লাশব্যাক:
সময়টা ২০০২ সালের ১০ নভেম্বরের রাত। অভিযোগ রয়েছে, তিন্নিকে নির্মমভাবে খুন করেন সাবেক সাংসদ গোলাম ফারুক অভি। অপরাধ, তিন্নি তাকে বিয়ে করার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন এবং কথামতো কাজ না করলে তাদের অবৈধ সম্পর্কের কথা মিডিয়ার কাছে ফাঁস করে দেওয়ার হুমকিও দিচ্ছিলেন। এ যেন সিনেমারই গল্প। পরিণতিও হয় সিনেমার গল্পের মতো। মাথায় আঘাত করে তিন্নিকে হত্যা করে ওই রাতেই বুড়িগঙ্গার ১ নম্বর চীন মৈত্রী সেতুর ওপর থেকে লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
কিন্তু বিধি বাম। লাশ পানিতে না পড়ে সেতুর পিলারের উঁচু অংশে গিয়ে পড়ে। পরদিন সকালে ওই লাশ ঘিরে জমে উৎসুক জনতার ভিড়। কেরানীগঞ্জ থানার পুলিশ লাশ উদ্ধারের পর ময়নাতদন্ত করে। কিন্তু পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় মর্গে চার দিন রাখার পর ১৫ নভেম্বর অজ্ঞাত হিসেবে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয় তিন্নিকে।
এদিকে তিন্নির চাচা সৈয়দ রেজাউল করিম কেরানীগঞ্জ থানায় একটি ‘মিসিং ডায়েরি’ করেন। লাশ উদ্ধারের দিন একই থানায় একটি হত্যা মামলা করেন কেরানীগঞ্জ থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক শফি উদ্দিন। মামলায় আসামি করা হয় অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে।
পরে ২০০২ সালে ২৪ নভেম্বর মামলাটি চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে সিআইডিকে তদন্তভার দেওয়া হয়। সেই তদন্তেই ধীরে ধীরে সামনে চলে আসে গোলাম ফারুক অভির নাম। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডি পুলিশের এএসপি মোজাম্মেল হক একমাত্র আসামি হিসেবে সাবেক এই সাংসদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন এবং ৪১ জনকে সাক্ষী করেন। এছাড়া ২২টি আলামতও জব্দ করেন।
পরবর্তীতে ২০১০ সালের ১৪ জুলাই ঢাকার সপ্তম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ তিন্নি হত্যা মামলায় আসামি অভির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। পরের বছরগুলোতে অভিযোগপত্রভুক্ত ৪১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। বাকি থাকলো রায় ঘোষণার পালা।
আদালত সূত্রে পাওয়া খবর অনুযায়ী অভি পলাতক। তিন্নি হত্যা মামলা ছাড়াও অন্য আরেকটি হত্যা মামলায় ১৭ বছরের কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে বর্তমানে তিনি কানাডায় অবস্থান করছেন। তবু আশায় বুক বেঁধে আছে তিন্নির পরিবার। তাদের প্রত্যাশা, অভির উপযুক্ত শাস্তি হবে এবং তাকে বিদেশ থেকে এনে সেই শাস্তি কার্যকর করা হবে। বাকিটা সময়ের অপেক্ষা।
কে এই অভি, আছেন কোথায়?
গোলাম ফারুক অভির উত্থান ঘটে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে। ছাত্র হিসেবে তিনি অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। এসএসসি এবং এইচএসসিতে বোর্ড পর্যায়ে মেধার সাক্ষর রাখেন। নব্বইয়ের গণআন্দোলন ঠেকাতে এরশাদের নেক নজর পান অভি। ওই সময় অপহরণ ও মুক্তিপণ এবং চাঁদাবাজিসহ নানা অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। তিনি নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী গড়ে তোলেন।
এক পর্যায়ে তিনি গ্রেপ্তার হন। তবে নব্বইয়ের গণআন্দোলনের চরম পর্যায়ে ডিসেম্বরের প্রথম দিকে তাকে কারাগার থেকে ছাড়া হয়। আর ছাড়া পেয়েই পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। এত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পরও তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের হাত ধরে ১৯৯৬ সালে বরিশাল-২ আসন থেকে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
চাঞ্চল্যকর তিন্নি হত্যা মামলার ফেরারি আসামি গোলাম ফারুক অভির বিরুদ্ধে ২০০৭ সালে রেড নোটিশ জারি করে ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন (ইন্টারপোল)। তবে দীর্ঘ ১৪ বছরেও তার কোনো সন্ধান বা কোনো ধরনের তথ্য ইন্টারপোল বাংলাদেশ পুলিশ সদরদপ্তরকে জানাতে পারেনি।
পুলিশ সদরদপ্তরের একটি সূত্র জানায়, ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করার পর প্রতি পাঁচ বছর পরপর পুনরায় আবেদন করতে হয়। এরপর পুলিশ সদরদপ্তর থেকে অভির বিরুদ্ধে আবেদন করা হলে ২০১২ সালের ১৯ জানুয়ারি পুনরায় ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করে।
কিন্তু ইন্টারপোল তার ব্যাপারে বাংলাদেশ পুলিশের কাছে কোনো তথ্য দিতে পারেনি। পুনরায় ওই রেড নোটিশের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়। এরপর ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি পুনরায় আবেদন করা হলে একই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি ইন্টারপোল অভির বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করে। এটি ২০২২ সাল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
দীর্ঘ ১৪ বছরেও ইন্টারপোল গোলাম ফারুক অভির বিরুদ্ধে কোনো ধরনের তথ্য বাংলাদেশ পুলিশের কাছে দিতে না পারলেও চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার ফেরারি আসামি গোলাম ফারুক তার নিজ এলাকায় ঈদের জামাতে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বক্তব্য দিয়ে আসছেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। তবে অভি এই মুহূর্তে কোন দেশে আছেন সেটা কেউ বলছে পারছেন না।
জাপার একটি সূত্র জানায়, অভি এখন কানাডায় অবস্থান করছেন। যদিও কানাডার কোন শহরে তিনি বসবাস করেন তা জানাতে চায়নি জাপার সূত্রটি।
এ ব্যাপারে পুলিশ সদরদপ্তরের ইন্টারপোল শাখার একজন কর্মকর্তা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘অভির ব্যাপারে কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই।’
(ঢাকাটাইমস/১৫নভেম্বর/এসএস/এএইচ/ডিএম)

মন্তব্য করুন