ইদ বনাম ঈদ: বাংলা একাডেমির গ্যাঁড়াকলে বাংলা বানান

ড. মোহাম্মদ আমীন
| আপডেট : ১০ জুলাই ২০২২, ২২:৪৫ | প্রকাশিত : ১০ জুলাই ২০২২, ১৪:১৮

বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানের সর্বশেষ সংস্করণের (পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণের চতুর্থ পুনর্মুদ্রণ, ডিসেম্বর ২০১৮) ১৮১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ইদ আরবি উৎসের শব্দ। অর্থ: ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রধান উৎসব (ইদুল ফিতর বা ইদুল আজহা); খুশি, উৎসব; ঈদ-এর সংগততর ও অপ্রচলিত বানান। একই অভিধানের ১৯৭ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, ঈদ হলো ইদ-এর প্রচলিত ও অসংগত বানান। ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ পুস্তিকার ২.১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল অতৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশি, বিদেশি ও মিশ্র শব্দে কেবল ই, উ এবং এদের কার-চিহ্ন ব্যবহৃত হবে।’ আলোচ্য অভিধানটির মুখবন্ধে বলা হয়েছে, ‘এই অভিধানে ২০১২ সালে প্রকাশিত ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বানানের নিয়ম অনুসরণ করা হয়ছে।’ এতৎসত্ত্বেও, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ৩ মে অনুষ্ঠিত ইদের শুভেচ্ছায় অসংগত ‘ঈদ’ বানান লিখেছেন। সংগত বানান বাদ দিয়ে অসংগত বানানে শুভেচ্ছা-জ্ঞাপনও অসংগত।]

২৪৩. কিবোর্ড নাকি কী-বোর্ড

বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান (পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণের তৃতীয় পুনর্মুদ্রণ, এপ্রিল ২০১৮; পৃষ্ঠা: ৩০৮) ইংরেজি কবুনড়ধৎফ-অর্থে বাংলা লিখেছে, ‘কী-বোর্ড’; অর্থ: (বিশেষ্যে) কম্পিউটার পিয়ানো প্রভৃতি চালনের বোতামশ্রেণি, কবুনড়ধৎফ। বাংলা একাডেমি বাংলা বানান-অভিধান (পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত তৃতীয় সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০০৮) অন্তর্ভুক্ত করেছে, ‘কী-বোর্ড’। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমি প্রণীত ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ পুস্তিকার ২.১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল অতৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশি, বিদেশি, মিশ্র শব্দে কেবল ই এবং উ এবং এদের কারচিহ্ন ই-কার এবং উ-কার ( ি ু) ব্যবহৃত হবে।’

বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান নিজেই বলছে, ‘কী-বোর্ড’ শব্দটি ইংরেজি কবুনড়ধৎফ থেকে এসেছে; অর্থাৎ ইংরেজি ‘কবুনড়ধৎফ’ থেকে উদ্ভূত ‘কী-বোর্ড’ বিদেশি শব্দ। সে ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি প্রণীত প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম অনুসারে ‘কবুনড়ধৎফ’ শব্দের বানান-রূপ ‘কী-বোর্ড নয়, ‘কি-বোর্ড’ হওয়ার কথা। অথচ বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত সর্বশেষ অভিধানে বিদেশি শব্দের বানান লেখা হয়েছে দীর্ঘ ঈ-কার দিয়ে। কেন এমন করা হয়েছে, কোথাও তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। কোনো যুক্তিও দেখা যায় না।

২০১২ খ্রিষ্টাব্দে ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ পুস্তিকাটি প্রকাশিত হওয়ার পর, সে নিয়ম অনুসরণ করে, ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণ (প্রথম প্রকাশ: মাঘ ১৪২০/জানুয়ারি ২০১৪; পৃষ্ঠা: ১৩৩) লিখেছে ‘কিবোর্ড নকশা (ষধুড়ঁঃ)’। বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম অনুসারে এই বানানই ছিল সংগত। অথচ ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম প্রকাশিত বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান, তার মুখবন্ধে দাবি করেছে: ‘এই অভিধানে ২০১২ সালে প্রকাশিত “বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম” অনুসরণ করা হয়েছে।’ তারপরও, অভিধানটি কেন ‘কী-বোর্ড’ বানান ঈ-কার দিয়ে লিখল তা বোধগম্য নয়।

এ বিষয়ে বাংলা একাডেমি কি কোনো ব্যাখ্যা দেবে? ‘কী-বোর্ড’ না লিখে ‘কী-বোর্ড’ লিখলে কী ক্ষতি হতো? অনেকে বলেন, দীর্ঘ উচ্চারণের দিকে লক্ষ রেখে ক-য়ে ঈ-কার রাখা হয়েছে। অথচ এই অভিধানে বলা হয়েছে, বাংলা বানানে প্রকৃতপক্ষে উচ্চারণগত কোনো দীর্ঘস্বর নেই। তারপরও যদি দীর্ঘ উচ্চারণকে যুক্তিতে আনা হয়, তাহলে তাহলে ঈদ বানানে কেন ই-কার? ঈদ-বানানকে কেন অসংগত বলা হয়েছে?

বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান একটি স্বতন্ত্র ভুক্তি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে ‘কী-বোর্ড’; যার বানানে রয়েছে ক-য়ে দীর্ঘ ঈ-কার। যদিও শব্দটির ব্যুৎপত্তি নির্দেশ করে বলা হয়েছে ইংরেজি; অর্থাৎ শব্দটি এসেছে ইংরেজি থেকে। যদি শব্দটি ইংরেজি উৎসের হয় তাহলে ‘কী-বোর্ড’ বানান-রূপ ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ (পরিমার্জিত সংস্করণ ২০১২) পুস্তিকায় বর্ণিত ১.২ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বাংলা একাডেমি কোন নিয়মে বানাটিতে ঈ-কার দিল? অন্যদিকে ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণে লেখা হয়েছে কিবোর্ড। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানের ৩০৮ পৃষ্ঠায় পৃথক ভুক্তি হিসেবে লেখা হয়েছে কী-বোর্ড। কোনটি শুদ্ধ? প্রসঙ্গত, ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে, বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান প্রকাশিত হওয়ার পূর্বে, বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণ (২০১৪ খ্রি.)-এর ১৩৩ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছেÑ‘কিবোর্ড নকশা’, ক-য়ে হ্রস্ব ই-কার দিয়ে।

২৪৪. একই অভিধানে একই শব্দের বানান একাডেমি ও একাডেমী

একই গ্রন্থে একবার বাংলা একাডেমি আবার বাংলা একাডেমী, কোনটি শুদ্ধ? ছবির তিনটি পৃষ্ঠাই একই গ্রন্থের। বাংলা একাডেমী শুধু অভিধান রচনায় এবং ‘একাডেমি’ বানানে অবহেলার পরিচয় দিয়েছে তা না, একই সঙ্গে পাঠকের সঙ্গে প্রতারণাও করেছে। ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে মুদ্রিত একটি অভিধানকে ‘২০১৬’ খ্রিষ্টাব্দের পুনর্মুদ্রণ হিসেবে চালিয়ে দিয়েছে। বইটির নাম, প্রচ্ছদ অনুযায়ী ‘বাংলা একাডেমি বানান-অভিধান’। প্রিন্টার্স লাইনে লেখা আছে: ‘বাংলা একাডেমী বানান-অভিধান’, পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত তৃতীয় সংস্করণ, চতুর্থ পুনর্মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারি ২০১৬। ওপরে ‘একাডেমি’, ভেতরে ‘একাডেমী’।

‘বাংলা একাডেমি বাংলা বানান-অভিধান’ বাংলা একাডেমি প্রকাশিত একটি অভিধান। বইটির কভার পেজে লেখা : ‘বাংলা একাডেমি বাংলা বানান-অভিধান’, কিন্তু টাইটেল পৃষ্ঠায় লেখা ‘বাংলা একাডেমী বাংলা বানান অভিধান, পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত তৃতীয় সংস্করণ উচ্চারণ-সহ’। অন্যদিকে প্রিন্টার্স লাইনে লেখা : ‘বাংলা একাডেমী বাংলা বানান অভিধান’, পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত তৃতীয় সংস্করণ, চতুর্থ পুনর্মুদ্রণ, ফেব্রুয়ারি ২০১৬। এই পৃষ্ঠায় ২০১৬ সংখ্যার ‘১৬’ লেখাটির সঙ্গে পূর্ববর্তী ২০-এর ছাপার মিল নেই। স্পষ্টই বোঝা যায়, আগের দুটি অঙ্ক মুছে সেখানে ১৬ সংখ্যাটি সেঁটে দেওয়া হয়েছে। এটি আগের সংস্করণকে ওই বছরের সংস্করণ হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার অপ্রয়াস ছাড়া আর কী হতে পারে?

গ্রন্থটির ভূমিকা ও প্রসঙ্গ কথায় কেউ লিখেছেন একাডেমি আবার কেউ লিখেছেন একাডেমী। প্রসঙ্গত, এই বইটির সম্পাদক জামিল চৌধুরী। তিনি ‘বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান’ গ্রন্থেরও সম্পাদক। অভিধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনায় ‘বাংলা একাডেমি’র মতো একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের এমন দায়সারা কাজ বাংলা বানানের যথেচ্ছাচার ও অবহেলার অন্যতম কারণ। বাংলা একাডেমি বাংলা ভাষার রক্ষক হয়ে যদি এমন কাজ করে তাহলে সাধারণ মানুষের বাংলা একাডেমির প্রতি আস্থা থাকবে কীভাবে?

২৪৬. দিঘি না দীঘি

‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বানানের নিয়ম অনুসারে’ রচিত বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানের ৬৪৮ পৃষ্ঠায় দিঘি-ভুক্তিতে বলা হয়েছে, ‘দিঘি’ সংস্কৃত দীর্ঘিকা থেকে উদ্ভূত। সুতরাং দিঘি অতৎসম শব্দ।

‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ পুস্তিকার ২.১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল অতৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশি, বিদেশি, মিশ্র শব্দে কেবল ই এবং উ এবং এদের কারচিহ্ন ই-কার এবং উ-কার ( ি ু) ব্যবহৃত হবে।’ সে হিসেবে অতৎসম ‘দিঘি’ বানান হ্রস্ব ই-কার দিয়ে হওয়া সমীচীন। তাই প্রমিত বানানের নিয়মানুসারে বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে ‘দিঘি’ শব্দকে স্বতন্ত্র ভুক্তি হিসেবে (পৃষ্ঠা: ৬৪৮) অন্তর্ভুক্ত করেছে।

অন্যদিকে একই অভিধানের ৮০৮ পৃষ্ঠায় অবস্থিত ‘পাড়১’ ভুক্তিতে ‘পাড়’ শব্দের অর্থ লেখা হয়েছেÑতীর (দীঘির পাড়) এবং ৮১৫ পৃষ্ঠার ‘পার’ ভুক্তিতে লেখা হয়েছে, ‘নদী দীঘি পুকুর প্রভৃতির তট (পুকুরপার)’, উভয় ক্ষেত্রে অতৎসম ‘দিঘি’ শব্দের বানান দ-য়ে দীর্ঘ ঈ-কার দেওয়া হয়েছে। অথচ পৃথক ভুক্তিতে লেখা হয়েছে,‘দিঘি’। একই অভিধানে একই অর্থের একই শব্দে ভিন্ন বানান দেখানো হলেও ভুক্তিতে কেবল একটি বানানই ঠাঁই পেয়েছে।

এ অবস্থায় প্রশ্ন, কোন বানানটি প্রমিতÑ‘দিঘি’ না ‘দীঘি’? আমরা কোন বানানটি আদর্শ, মান, প্রমিত, সংগত বা শুদ্ধ ধরব? এটি যদি মুদ্রণ প্রমাদ হয়, তাহলে এতগুলো সংস্করণ চলে যাওয়ার পরও কেন শুদ্ধ করা হলো না?

২৪৫. মনযোগ নাকি মনোযোগ

বাংলা একাডেমি থেকে সর্বশেষ প্রকাশিত আধুনিক বাংলা অভিধান বাংলা শব্দের প্রমিত বানানের জন্য কতটুকু নির্ভরযোগ্য? একই অভিধানে ভিন্ন পৃষ্ঠায় একই শব্দের ভিন্ন বানান দেখা যায়। অথচ কেন এ ভিন্ন বানান তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। যদি মুদ্রণপ্রমাদ হয় তাহলে চতুর্থ পুনর্মুদ্রণ পর্যন্ত কেন তা ঠিক করা হলো না?

মনযোগ নাকি মনোযোগ? কোন বানানটি প্রমিত? অভিধানে দুটিই পাওয়া যায়।

‘মনোযোগ= মনস্+যোগ। ব্যুৎপত্তি অনুযায়ী শব্দের প্রমিত বানানে ‘ন’-ধ্বনি ও-কার দিয়ে লিখতে হয়। সংগত কারণে ‘বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান’ প্রমিত ও শুদ্ধ বানান হিসেবে ‘মনোযোগ’ শব্দকে তার শরীরে একটি স্বতন্ত্র ভুক্তি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে সঠিক কাজই করেছে। ওই অভিধানের ১০৭৯ পৃষ্ঠায় লিখেছে, মনোযোগ (মনস্+ যোগ), অর্থ: (বিশেষ্যে) মনোনিবেশ, মনঃসংযোগ, অভিনিবেশ। এটি তৎসম শব্দ। ব্যাকরণবিধিমতে এটাই শুদ্ধ, সিদ্ধ ও প্রমিত। ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ পুস্তিকার ১.১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই নিয়মে বর্ণিত ব্যতিক্রম ছাড়া তৎসম বা সংস্কৃত শব্দের নির্দিষ্ট বানান অপরিবর্তিত থাকবে।’ এখানে কোনো ব্যতিক্রম নেই। তাই একমাত্র শুদ্ধ বানান: মনোযোগ। অথচ একই অভিধানের ১৩১০ পৃষ্ঠায় অবস্থিত ‘সহকারে’ শব্দের ভুক্তিতে লেখা হয়েছে: ‘মনযোগ সহকারে’। এখানে ‘মনোযোগ’ বানানের ন-য়ে ও-কার নেই।

এ অবস্থায়, কোনটি প্রমিতÑ‘মনোযোগ’ নাকি ‘মনযোগ’? কোনটি শুদ্ধÑমনযোগ নাকি মনোযোগ?

২৪৭. শিকারি নাকি শিকারী

‘শিকার’ থেকে ‘শিকারি’। ‘শিকার’ ফারসি উৎসের শব্দ। বাংলা একাডেমি থেকে ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত, ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ পুস্তিকার ২.১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল অতৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশি, বিদেশি, মিশ্র শব্দে কেবল ই এবং উ এবং এদের কারচিহ্ন ই-কার এবং উ-কার ( ি ু) ব্যবহৃত হবে।’ তাই বিদেশি উৎসের শব্দ হিসেবে বাংলা একাডেমি প্রমিত বানানের নিয়ম অনুসারে ‘শিকারি’ বানানে ‘ই-কার’ বিধেয়। বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান, তার মুখবন্ধে দাবি করেছে: ‘এই অভিধানে ২০১২ সালে প্রকাশিত “বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম” অনুসরণ করা হয়েছে।’ সংগত কারণে বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানের (পরিবর্ধিত সংস্করণের দ্বিতীয় পুনর্মুদ্রণ, সেপ্টেম্বর ২০১৭) ১২৩৪ পৃষ্ঠায় ‘শিকারি’ ভুক্তিতে ‘শিকারি’ বানান লেখা হয়েছে ‘হ্রস্ব ই-কার’ দিয়ে। ওই ভুক্তিতে বলা হয়েছে, শিকারি ফারসি উৎসের শব্দ; অর্থ: (বিশেষ্যে) যে ব্যক্তি শিকার করে, ব্যধ; (বিশেষণে) সাধারণত খাওয়া উদ্দেশ্যে শিকার ধরে এমন (শিকারি বাঘ)।

অন্যদিকে একই অভিধানের ১১০৮ পৃষ্ঠায় ‘মায়ূরিক’ ভুক্তিতে লেখা হয়েছে সংস্কৃত ‘মায়ূরিক’ শব্দের অর্থ: ‘ময়ূর-শিকারী’। ময়ূরের ‘শিকারী’ বানানে দীঘ ঈ-কার, অথচ ‘শিকারি’ ভুক্তির ‘শিকারি’ বানানে হ্রস্ব ই-কার। অর্থ দেখানো হয়েছে একই। একই অর্থে একই অভিধানে একবার লেখা হয়েছে, ‘শিকারি’ এবং আরেকবার লেখা হয়েছে ‘শিকারী’। এ অবস্থায়, কোনটি শুদ্ধ? ময়ূর শিকার করলে ‘শিকারি’, শিকারী হয়ে যায়Ñএটি ব্যাকরণের কোন নিয়মে পড়েছে? একই অর্থ প্রকাশে একই শব্দের দু-জায়গায় দু-রকম বানান কেন দিয়েছে বাংলা একাডেমি? আমরা কোনটা শুদ্ধ জানব? কোনটা প্রমিত জানব?

২৪৮. উদ্বোধন নাকি উদ্বোধন

‘বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান’ (সম্পাদক জামিল চৌধুরী, প্রথম প্রকাশ: মাঘ ১৪২২/ফেব্রুয়ারি ২০১৬) ‘বাংলা একাডেমি’ থেকে প্রকাশিত সর্বশেষ বাংলা অভিধান। ওই অভিধানে এবং এরপরে পুনর্মুদ্রিত সংস্করণেও ‘উদ্বোধন’ বানানের কোনো শব্দ নেই। আছে কেবল ‘উদ্বোধন’। প্রসঙ্গত, ওই অভিধানের ২০২ পৃষ্ঠায় উদ্বোধন ভুক্তিতে বলা হয়েছে, ‘সংস্কৃত ‘উদ্বোধন (উদ্+√বুধ্+ণিচ্+অন)’ অর্থ: সূত্রপাত, আরম্ভ। জাগরণ, বোধৎপাদন। আনুষ্ঠানিক আরম্ভ বা উন্মোচন।’ যার উচ্চারণ নির্দেশ করা হয়েছেÑ‘উদ্ বোধোন্’।

দ-য়ে হস-চিহ্ন দিয়ে লেখার যুক্তি আছে। দ-য়ে ব যুক্ত করে লিখলে বর্গীয়-ব আর অন্তঃস্থ-ব নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়। ওই ‘ব’ তখন অন্তঃস্থ-ব রূপে উচ্চারিত হওয়ার প্রবণতা এসে যায়। ‘ব’ ও ‘য’ এর উচ্চারণ যখন পৃথকভাবে যথাক্রমে /ব্/ ও /জ্/ করা হয়, তখন ব-ফলা এবং য-ফলার পরিবর্তে ‘ব’ ও ‘য’ আলাদাভাবে লেখাই উচিত। অন্যথায় উচ্চারণ বিভ্রাটের আশঙ্কা থেকে যায়। ‘উদ্’ উপসর্গটি রবীন্দ্রনাথ পৃথক রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। বৈয়াকরণদের অভিমত, উদ্-উপসর্গটি পৃথক রাখাই সমীচীন। যেসব বর্ণের সঙ্গে যুক্ত ‘ব’ বর্ণটি, ব-এর অবিকল উচ্চারণ অক্ষুণ্ন রাখে না অর্থাৎ অনুচ্চারিত থাকে অথবা সংশ্লিষ্ট শব্দটিকে দ্বিত্ব উচ্চারণ দেয় সে ‘ব’ ‘অন্তঃস্থ-ব’ থেকে আগত; যার উচ্চারণ ইংরেজি বর্ণ ড-এর মতো। যেমন : হ্রস্ব, অশ্ব, বিশ্ব প্রভৃতি। সে হিসেবে, উচ্চারণ রীতি অনুযায়ী ‘উদ্বোধন’ শব্দের উচ্চারণ হতে পারেÑ‘উদ্ধোধোন্’। যেখানে ‘যুক্ত-ব’ তার নিজস্ব উচ্চারণ অক্ষুণ্ন রাখে সেটি ‘বর্গীয়-ব’। এ কারণে বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান (পৃষ্ঠা: ২০২) অনুযায়ী শুদ্ধ ও প্রমিত বানান দেখিয়েছে: উদ্্বোধন।

‘উদ্বোধন’ শব্দটিকে অভিধানে স্থান না-দেওয়ার কারণ হতে পারেÑ ১. বাংলায় ‘উদ্বোধন’ বানানের কোনো শব্দ নেই; বা ২. থাকলেও তা ভুল, বা অসিদ্ধ বা ব্যাকরণসম্মত নয়। বা ৩. আগে ব্যবহৃত হলেও ‘উদ্বোধন’ শব্দটি অশুদ্ধ ছিল; বা ৪. ‘উদ্বোধন’ শব্দের উচ্চারণ ‘বর্গীয়-ব’ ও ‘অন্তঃস্থ-ব’-এর উচ্চারণ-রীতির কারণে ‘উদ্ধোধন’ হয়ে যেতে পারে; বা ৫. বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান ছাড়া বাকি সব অভিধান অশুদ্ধ এবং বাংলা একাডেমি ছাড়া আর কেউ বাংলা জানে না। বা/এবং ৬. ওপরের সব কটি। অথচ বাংলা একাডেমি, ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০’-এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্রে কমপক্ষে তিনবার অভিধানচ্যুত ‘উদ্বোধন’ শব্দটি ব্যবহার করেছে।

প্রশ্ন, বাংলা একাডেমির সর্বশেষ অভিধানমতে, ‘উদ্বোধন’ শব্দটির অর্থ কী? ‘উদ্বোধন’ যদি ‘উদ্বোধন’ শব্দের সমার্থক এবং শুদ্ধ বা প্রমিত হয়ে থাকে, তাহলে বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে ‘উদ্বোধন’ শব্দটিকে স্থান দেওয়া হয়নি কেন?

অভিধানে স্থান দেওয়া হয়নি এমন একটি শব্দকে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০’-এর আমন্ত্রণপত্রে কেন স্থান দেওয়া হয়েছে? প্রসঙ্গত, বিতাড়িত ‘উদ্বোধন’ শব্দটিকে এমন একটি অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্রে স্থান দেওয়া হয়েছে যে অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত থাকবেন। এ অবস্থায়, বাংলা একাডেমি কী জবাব দেবেন?

২৪৯. আক্কেল শব্দের উৎস কী

বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানের ১২৬ পৃষ্ঠায় আকল ভুক্তিতে বলা হয়েছেÑবাক্যে বিশেষ্য হিসেবে ব্যবহৃত আকল আরবি উৎসের শব্দ। অর্থ: (বিশেষ্যে) বুদ্ধি, জ্ঞান। আকল হতে উদ্ভূত আকলমন্দি শব্দেও বুদ্ধিমত্তা অর্থে বলা হয়েছে আকল আরবি উৎসের শব্দ। একই অভিধানের, ১২৮ পৃষ্ঠায় আক্কেল ভুক্তিতেও বলা হয়েছে আকল আরবি শব্দ। অন্যদিকে একই অভিধানের ১২৬ পৃষ্ঠায় বিদ্যমান আকলমন্দ ভুক্তিতে বুদ্ধিমান অর্থে উল্লেখ করা হয়েছে, আকল সংস্কৃত শব্দ। অথচ বর্ণিত অভিধানে জ্ঞান ও বুদ্ধি অর্থে আকল বানানের কোনো সংস্কৃত শব্দের অস্তিত্ব নেই।

এখন প্রশ্ন: আকল প্রকৃতপক্ষে কোন উৎসের শব্দ? এটি কি মুদ্রণপ্রমাদ? মুদ্রণপ্রমাদ হলে ঠিক করা হয়নি কেন? এর মধ্যে একাধিক সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের এত বিভ্রাটে রাখার কারণ কী?

২৫২. ব্যাঙ ও ব্যাং কোনটি সঠিক

বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান (প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৬; পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ: এপ্রিল ২০১৬) গ্রন্থের পরিশিষ্ট ক হিসেবে সংযুক্ত ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ (পরিমার্জিত সংস্করণ ২০১২) নামের পুস্তিকার ২.২ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে : প্রমিত বানান ‘ব্যাঙ’, ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ পুস্তিকায় ‘ব্যাঙ’ শব্দটি একটি উদাহরণ হিসেবে এ-বানানেই লিখেছে। অন্যদিকে ‘বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান’ অন্তর্ভুক্ত করেছে ‘ব্যাং’ অথচ ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ পুস্তিকায় উদাহরণ হিসেবে বর্ণিত ‘ব্যাঙ’ শব্দটিকে অন্তর্ভুক্ত করেনি। অর্থাৎ এই অভিধানমতে, ‘ব্যাং’ বানানটি ভুল। কিন্তু যে ‘ব্যাঙ’ বানানটি বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানের পরিশিষ্ট ক-য়ে প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম ২.২-এ অন্তর্ভুক্ত করেছে, সেই বানানটি ‘বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান’ কীভাবে ঠাঁই দিল না? তাহলে কি ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’-এর সঙ্গে ‘বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান’ সহমত পোষণ করে না? তারা কি পরস্পর সাংঘর্ষিক?

অথচ, ‘বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান’ মুখবন্ধে ঘোষণা করেছে, ‘এই অভিধানে ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত “বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম” অনুসরণ করা হয়েছে।’ তা যদি হয় তাহলে এত বৈপরীত্য কেন? এটি ভুল নাকি সাংঘর্ষিকতা? বাংলা একাডেমি নিজেই যদি এত সাংঘর্ষিকতায় ভোগে, তাহলে সাধারণ জনগণ কী লিখবে ব্যাঙ নাকি ব্যাং? ভুল হলে কেন সংশোধন দিল না? বাংলা একাডেমি বাংলা বানানের রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ হয়েও বাংলা বানানকে এমন গ্যাঁড়াকলে ফেলে চলছে কেন?

২৫১. ব্যবহারিক নাকি ব্যাবহারিক

বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান নামের গ্রন্থের প্রতিটি সংস্করণে পৃথক ভুক্তিতে ‘ব্যাবহারিক’ শব্দটি আছে, কিন্তু ‘ব্যবহারিক’ বানানের কোনো ভুক্তি নেই। অন্যদিকে বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (পরিমার্জিত সংস্করণ ডিসেম্বর ২০০০ খ্রি.) এবং বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণ (প্রথম প্রকাশ: মাঘ ১৪২০/জানুয়ারি ২০১৪) গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করার আগেও ‘ব্যবহারিক’ বানান-রূপটি ব্যবহৃত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ১৩৫১ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত ও কাজী আবদুল ওদুদ সংকলিত ‘ব্যবহারিক শব্দকোষ’ অভিধানের কথা উল্লেখ করা যায়।

প্রসঙ্গত, কাজী আবদুল ওদুদ সংকলিত ‘ব্যবহারিক শব্দকোষ’ ও বাংলা একাডেমির ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’Ñএ দুটি অভিধানের নামের মধ্যেই ‘ব্যবহারিক’ বানান-রূপটি দেখা যায়। এই ব্যবহারিক শব্দকোষে দুটি আলাদা ভুক্তি পাওয়া যায়: একটি ‘ব্যবহারিক’, ‘ব্য-’ শীর্ষক, অন্যটি হলো ‘ব্যাবহারিক’ শীর্ষক; যদিও দ্বিতীয়টি থেকে আবার প্রথমটি দেখার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। অর্থাৎ দুটো শব্দের অর্থই অভিন্ন।

ব্যবহারিক, ‘ব্যা-’ শীর্ষক ভুক্তিতে দেখা যায়: ‘[ব্যবহার+ষ্ণিক]’, কিন্তু এই ব্যুৎপত্তি কি ব্যাকরণবিধি মতে দুটি বানান-রূপকেই সমর্থন করে? সুভাষ ভট্টাচার্য তাঁর বাংলা প্রয়োগ অভিধান (নবযুগ প্রকাশনী, পরিমার্জিত নবযুগ সংস্করণ: বইমেলা ২০০৩ খ্রি., চতুর্থ মুদ্রণ: ২০১৪) গ্রন্থে বলেছেন: ‘ব্যাবহারিক সংগত হলেও ব্যবহারিক প্রচলিত।’ অথচ জামিল চৌধুরী সম্পাদিত বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে ‘ব্যবহারিক’ শব্দটিকে ঠাঁই দেওয়া হয়নি; কিন্তু পাশাপাশি চলছে বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, যেখানে ‘ব্যবহারিক’ শব্দটিও রয়েছে এবং তা দ্বিতীয় সারিতে। অর্থাৎ ‘ব্যবহারিক’ শব্দের চেয়ে ‘ব্যাবহারিক’ অধিকতর সিদ্ধ এবং প্রমিত।

২০০০ খ্রিষ্টাব্দে ‘বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ (পরিমার্জিত সংস্করণ ডিসেম্বর ২০০০ খ্রি.) গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে সর্বশেষ ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে অষ্টাদশ পুনর্মুদ্রণ পর্যন্ত এবং অদ্যাবধি গ্রন্থটি নিজ নামের মধ্যে ‘ব্যবহারিক’ বানান রূপটি বহাল তবিয়তে ধারণ করে আছে এবং ‘ব্যবহার’ শীর্ষক ভুক্তির অধীনে ‘ব্যবহারিক, ব্যাবহারিক’ দুটি বানানরূপের অবস্থানক্রমের মাধ্যমে ‘ব্যবহারিক’ বানানটি প্রমিত করেছে।

অথচ ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত বাংলা একাডেমি বাংলা বানান-অভিধানে (পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত তৃতীয় সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ খ্রি.) ‘ব্যবহারিক’ শব্দটি নেই; আছে কেবল ‘ব্যাবহারিক’। আবার, ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে ‘ব্যবহারিক’ বানানরূপটি শুবাচি খুরশেদ আহমেদের ভাষায়, ‘ঝান্ডা উড়িয়ে দৃশ্যত বৈয়াকরণ-সমর্থিত নিজের অবস্থান ঘোষণা করেছে বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণ (প্রথম প্রকাশ: মাঘ ১৪২০/জানুয়ারি ২০১৪।) বইটির শিরোনামে প্রচ্ছদে ও প্রতি পাতায়।’ কিন্তু তারপর, ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান (প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০১৬) এবং পরে প্রকাশিত সব কটি সংস্করণে এই শব্দটির বানান-প্রসঙ্গে বাংলা একাডেমি বাংলা বানান-অভিধানের অবস্থানকেই নিশ্চিত করল এবং এতে ঠাঁই পেল না ‘ব্যবহারিক’; ঠাঁই পেল কেবল ‘ব্যাবহারিক’।

প্রমিত গণ্য করে যে বানানটিকে এতকাল বাংলা একাডেমি আমাদের জানিয়েছে, শিখিয়েছে এবং সেই হেতুতে ব্যবহার করে চলেছি, বাংলা একাডেমি বাংলা বানান-অভিধান ও বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে সেই ‘ব্যবহারিক’ শব্দটি নেই, অথচ অপ্রমিত ‘ব্যাবহারিক’ শব্দটি আছে। রাখার পেছনে যুক্তি হচ্ছে : ব্যবহার+ইক = ব্যবহারিক; যা ব্যকরণসম্মত, কিন্তু ‘ব্যবহারিক’ যদি ব্যাকরণসম্মত না হয় তাহলে এত দিন কীভাবে প্রমিত অবস্থানে ছিল? এবং কেন অন্যান্য অভিধানসমূহে ‘ব্যবহারিক’ শব্দটি রেখে দেওয়া হলো? এ প্রসঙ্গে বলছিÑবাংলা একাডেমি যদি ‘ব্যবহারিক’ না চায় তাহলে বলে দিতে পারতÑ ‘ব্যবহারিক’ অশুদ্ধ এবং অন্য কোনো অভিধানে থাকলেও তা গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হবে না। প্রিয় বাংলা একাডেমি, আপনারা কি অনুগ্রহ করে বলবেন প্রমিত বানান কোনটি: ব্যবহারিক, না ব্যাবহারিক?

বাংলা একাডেমির শোকবাণী ভুল ও অসংগত বানান

ভাষাসংগ্রামী আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর প্রয়াণে বাংলা একাডেমির দেওয়া শোকবাণীর বানানবিষয়ক কিছু ভুল বা অসংগতি প্রযোজ্য গ্রন্থাদির আলোকে চিহ্নিত করে শুদ্ধ বা সংগত রূপ যৌক্তিকতাসহ নিচে দেওয়া হলো।

১. ওয়েব সাইট> ওয়েবসাইট [ইংরেজি উৎসের ওয়েবসাইট অর্থ: (বিশেষ্যে) বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত সবার জন্য উন্মুক্ত তথ্যভান্ডার, যেখানে প্রয়োজনীয় তথ্য বা তথ্যসংক্রান্ত বিবরণ পাওয়া যায়, ইংরেজি বিনংরঃব (বাএআবাঅ, পৃষ্ঠা: ২৪৭। সংগত বানান: ওয়েবসাইট।]

২. ১৯-০৫-২০২২> ১৯-০৫-২০২২ খ্রিষ্টাব্দ [বর্ষপঞ্জি, বর্ষ নির্ধারণের অপরিহার্য একক। বর্ষপঞ্জির নাম ছাড়া তারিখ লেখা এককের নামবিহীন সংখ্যার মতো অর্থহীন। বর্ষপঞ্জিভেদে বছরের হিসাবও ভিন্ন হয়ে যায়। বর্ষপঞ্জির নাম ঊহ্য রাখা মানে অপরিহার্য বিবেচিত পরিমাপের একক ঊহ্য রাখা। এখানে বর্ষপঞ্জি খ্রি.। তা দেওয়া সমীচীন ছিল।]

৩. পূর্ব মুহূর্ত> পূর্বমুহূর্ত [পূর্বমুহূর্ত (পূর্ব+√হুর্চ্ছ্+ত) অর্থ: (বিশেষ্যে) পূর্ববর্তী মুহূর্ত (বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধান, পৃষ্ঠা: ৮৪০)। এই অভিধানে, ‘পূর্বমুহূর্ত’ বানানকে নিরেটভাবে লিখে প্রমিত ঘোষণা করেছে। এটি সমাসবদ্ধ পদ। ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ পুস্তিকার ৩.১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সমাসবদ্ধ শব্দগুলি যথাসম্ভব একসঙ্গে লিখতে হবে। বিশেষ প্রয়োজনে সমাসবদ্ধ শব্দটিকে এক বা একাধিক হাইফেন দিয়ে যুক্ত করা যায়।’ এখানে হাইফেনও দেওয়া হয়নি। এটি হাইফেন দিয়ে লেখা সংগত হতো না। ‘পূর্বমুহূর্ত’ বানানই প্রচলিত ও অভিধানভুক্ত।]

৪. ছোটগল্প> ছোটোগল্প [বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানের ৪৯২ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, ‘ছোটোগল্প’ বাংলা শব্দ। অর্থ: (বিশেষ্যে) উপন্যাসের চেয়ে ছোটো পূর্ণাঙ্গ গল্প। বাংলা শব্দ হিসেবে এটি একক শব্দ, কোনো সাধিত শব্দ নয়। ওই অভিধানে ‘ছোটগল্প’ নামের কোনো শব্দ বা ভুক্তি নেই।]

৫. সম্রাটের ছবি-এর> ‘সম্রাটের ছবি’-এর [‘সম্রাটের ছবি’ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর একটি গ্রন্থের/ ছোটোগল্পের নাম। পুরো নামটির ওপর ষষ্ঠী বিভক্তি প্রযোজ্য। কিন্তু ‘এর’ এমনভাবে লেখা হয়েছে যেন, কেবল ছবি পদের ওপর প্রযোজ্য। ষষ্ঠী বিভক্তি ‘এর’ কেবল ‘ছবি’ পদের জন্য নয়; ‘সম্রাটের ছবি’ নামের গ্রন্থ/ ছোটোগল্পের জন্য। তাই পুরো পদাংশটি জোড়োদ্ধৃতির মধ্যে রাখা সংগত ছিল। যেমন করা হয়েছে প্রথম অনুচ্ছেদে ‘আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’-পদাংশের জন্য।]

৬. ছোটগল্প> ছোটোগল্প [প্রাগুক্ত: ৪]

৭. চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান-এর> [প্রাগুক্ত: ৫]

৮. পলাশী থেকে ধানমণ্ডি-এর> ‘পলাশী থেকে ধানমণ্ডি’-এর [প্রাগুক্ত: ৫]

৯. ডানপিটে শওকত-এর> ‘ডানপিটে শওকত’-এর [প্রাগুক্ত: ৫]

১০. ডানপিটে শওকত-এর মতো শিশুসাহিত্য> ‘ডানপিটে শওকত’-এর মতো শিশুপাঠ্য/শিশুপাঠ/ শিশুতোষগ্রন্থ [শিশুসাহিত্য (শিশু+ সহিত+য) অর্থ: (বিশেষ্যে) শিশুদের উপযোগী করে রচিত সাহিত্য, শিশুপাঠ্য (শিশু+√পাঠ্+য) ও শিশুপাঠ (শিশু+√পঠ্+অ) অর্থ: (বিশেষ্যে) শিশুদের পাঠের উপযোগী বই এবং শিশুতোষ (শিশু+√তুষ্+অ) অর্থ: (বিশেষণে) শিশুদের আনন্দ দেয় এমন (বাএআবঅ, পৃষ্ঠা: ১২৪০)। শিশুতোষগ্রন্থ অর্থ: (বিশেষ্যে) শিশুদের আনন্দ দেয় এমন বই। কোনো বিশেষ প্রকৃতির একটি পুস্তককে উদাহরণে এনে সাহিত্য দ্বারা প্রকাশ করা সমীচীন হলে এই শোকবাণীতে ছোটোগল্প, উপাখ্যান, উপন্যাস, নাটক না লিখে সাহিত্য লেখা সমীচীন হতো।]

১১. ধীর বহে বুড়িগঙ্গা-এর> ‘ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা’-এর [প্রাগুক্ত: ৫]

১২. সাংবাদিকতা চর্চার> সাংবাদিকতাচর্চার/ সাংবাদিকতা-চর্চার [এর আগে এই শোকবাণীর তৃতীয় অনুচ্ছেদে ‘সাহিত্যচর্চা’ পদে ‘চর্চা’ পদাংশকে সংশ্লিষ্ট শব্দের সঙ্গে নিরেটভাবে লেখা হয়েছে। একই লেখায় একাধিক বানান রূপ অসংগত।]

১৩. ঢাকা, কলকাতা, লন্ডন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে> ঢাকা-কলকাতা থেকে লন্ডন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে

১৪. মনেপ্রাণে একজন বিশ্ববাঙালি> মনেপ্রাণে একজন বাঙালি [‘বিশ্ববাঙালি’ কথাটির প্রয়োগ সুস্পষ্ট নয়।]

১৫. মুক্তিযুদ্ধসহ> মুক্তিযুদ্ধ-সহ [বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানে ‘সহ’ পদাংশটি হাইফেন দিয়ে লেখার নির্দেশনা বর্ণিত।]

বাংলা একাডেমি প্রকাশিত কারাগারের রোজনামচা অবহেলা আর ভুলে ভুলে সয়লাব

বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থের লেখক শেখ মুজিবুর রহমান। গ্রন্থটি সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম অভিধান প্রণয়ন, বিভিন্ন গবেষণা ও প্রকাশনা’ শিরোনামের প্রকল্পের আওতায় বাংলা একাডেমি থেকে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশ করা হয়। প্রকল্পটির পরিচালক ছিলেন বাংলা একাডেমির পরিচালক জনাব মোবারক হোসেন। তখন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন জনাব শামসুজ্জামান খান।

গ্রন্থটির ২৯৮ পৃষ্ঠায় দুটি ছবির ক্যাপশনে বঙ্গমাতার নাম লেখা হয়েছে ‘বেগম ফজিলাতুন্নেছা’, অথচ ভূমিকায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘ফজিলাতুননেছা’। খ্যাতিমান ঐতিহাসিক ব্যক্তির পরিচিতিমূলক টীকায় জাতীয় নেতা ‘এ এইচ এম কামারুজ্জামান’-এর নাম লেখা হয়েছে ‘এ এইচ এম কামরুজ্জামান’।

‘বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামের অধ্যায়ে লেখা হয়েছে, “১১৯৬৯ সালে এদেশের জনগণ গভীর ভালোবাসায় শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে।’’ সালটি ১১৯৬৯ নয়, ‘১৯৬৯’। একটি পঙ্ক্তিতে লেখা হয়েছে, ‘‘বঙ্গবন্ধু ১৯৩৪ সালে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তাঁর হৃদপিণ্ড এবং চোখ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে’। আরেক পঙ্ক্তিতে লেখা হয়েছে, “তাদের জন্য পৃথক নির্বাচকম-লী নির্ধারণ তাঁর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এখানে, হৃদপি-, নির্বাচকম-লী এবং উদ্বেগের ভুল বানান। শুদ্ধ বানান যথাক্রমে, হৃদপিণ্ড, নির্বাচকমণ্ডলী ও উদ্বেগের।

বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানের পরিশিষ্ট গ-য়ে বাংলা তারিখ ও সময় লেখার নিয়ম বিষয়ে বলা হয়েছে, “অ্যাক বৈশাখ, অ্যাগারো জ্যৈষ্ঠ, শোলো ডিসেম্বর, পোঁচিশে বৈশাখ প্রভৃতি উচ্চারণ অশুদ্ধ। শুদ্ধ ও মান্য রীতি: পয়লা বৈশাখ, অ্যাগারোই জ্যৈষ্ঠ, শোলোই ডিসেম্বর, পোঁচিশে বৈশাখ প্রভৃতি। গ্রন্থটি তারিখ লেখার ক্ষেত্রে এ নির্দেশনা কোথাও অনুসরণ করেছে, কোথাও করেনি। ২৮১ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে ১৫ আগস্ট এবং ২৩ জুন; একই পৃষ্ঠায় আবার লেখা হয়েছে ২৬শে সেপ্টেম্বর। পুরো বইয়ে এ ধরনের অসংগতি রয়েছে ভূরি ভূরি। ২৮৮ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, ‘প্রত্যুপন্নমতিতা’, শুদ্ধ বানান: ‘প্রত্যুৎপন্নমতিতা’।

কোথাও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ক্রিয়াপদ সম্পন্ন হয়েছে সম্মানজনক সম্বোধনে, আবার কোথাও স্বাভাবিক সম্বোধনে। একটি বাক্যে লেখা হয়েছে “যৌবনের প্রারম্ভিক বছরগুলোয় শেখ মুজিবুর রহমান ‘মুসলিম সেবা সমিতি’র সচিব হিসেবে সমাজসেবায় অংশ নেয়।” ‘হিসাব’ আর ‘হিসেবে’ বানানেও দেখা যায় অসংগতি ও দূষণীয় প্রয়োগ। ৩১ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে: চিঠিপত্র লিখে দেয়, হিসাব রাখে; আবার পরক্ষণে লেখা হয়েছে: কয়েদিদের খালাসের সময় হিসেব করে (পৃ: ৩১)। মাল গুদামের হিসেব রাখে। অথচ ‘হিসাব’, ‘হিসেব’ শব্দের সাধু রূপ। একই গ্রন্থের একই অধ্যায়ের লেখায় সাধু-চলিত মিশ্রণ দূষণীয়। বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ পুস্তিকার ২.৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “বিদেশি শব্দের ক্ষেত্রে ‘ষ’ ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। কিন্তু গ্রন্থটির ৩৭ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে ‘ম্যাজিষ্ট্রেট’, আবার ৩৩ পৃষ্ঠায় ‘ম্যাজিস্ট্রেট’।

‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ পুস্তিকার ২.১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “সকল অতৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশি, বিদেশি ও মিশ্র শব্দে কেবল ই, উ এবং এদের কার-চিহ্ন ব্যবহৃত হবে।” গ্রন্থটিতে তা অনুসরণ করা হয়নি। ৩৫ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে ফ্যাক্টরী, আবার ২৮ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে: ফ্যাক্টরি। সংগত বানান: ফ্যাক্টরি। ৩৭ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, আসামী, সংগত বানান: আসামি। ৪১ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে: আপীল, সংগত বানান: আপিল। এ ছাড়া এমন আরও অনেক অসংগতি রয়েছে।

একই বাক্যে একই উদ্দেশ্যে লেখা একই ক্রিয়াপদের বানান দুরকম লেখা হয়েছে। ‘আমার বাগানে সে ঝাড়ু দিতো মাঝে মাঝে; গাছেও মাঝেমধ্যে পানি দিত।’ সংগত বানান: দিত। টীকাংশেও রয়েছে প্রচুর অসংগতি ও তথ্যবিভ্রাট। কোথাও লেখা হয়েছে ‘ভাষা আন্দোলন’ আবার কোথাও লেখা হয়েছে ‘ভাষাআন্দোলন’ না ‘ভাষা-আন্দোলন’?। ২৯১ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে: ‘পূর্ব-বাংলা’, কিন্তু ২৯২ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে: ‘পূর্ব বাংলা’।

১৮০. বিপদজনক নয়, বিপজ্জনক

নিচের ছবিটির অবস্থান: বাংলা একাডেমির সভাপতি ও মহাপরিচালক যে ভবনে বসেন তার পাশে অবস্থিত বাংলা একাডেমির বিদ্যুৎ সরবরাহ অফিসের এই সম্মুখভাগ। ছবিটির অবস্থান পাশের পথ দিয়ে বাংলা একাডেমির কর্মকর্তাবৃন্দ যাওয়া-আসা করেন। ২নং ছবিটি বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা (২০১৯)-এর চত্বর থেকে গৃহীত।

শুদ্ধীকরণ: ১. বিপদজনক> বিপজ্জনক [তৎসম বিপজ্জনক (বিপদ্+জনক) অর্থ: বিপদ ঘটায় এমন, বিপদের আশঙ্কাযুক্ত (বাএআবাঅ, পৃষ্ঠা: ৯৭৫)। ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ পুস্তিকার ১.১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “তৎসম বা সংস্কৃত শব্দের নির্দিষ্ট বানান অপরিবর্তিত থাকবে।” বিপদজনক শব্দটি একটি একক শব্দ হিসেবে লিখিত হয়েছে। ‘বিপদজনক’ লিখলে একমাত্রায় বা না থেমে ‘দ্’ উচ্চারণ করে বিপদজনক কথাটি বলা সম্ভব নয়। বিপজ্জনক লিখলে না থেমে বানানের সব ধ্বনি যথাযথভাবে উচ্চারণ করা সম্ভব। তাই একমাত্র শুদ্ধ ও প্রমিত বানান বিপজ্জনক।]

২. বিদ্যুত> বিদ্যুৎ [তৎসম বিদ্যুৎ (বি+√দ্যুৎ+ক্বিপ্) অর্থ: (বিশেষ্যে) তড়িৎ, দামিনী, বিজলি (বাএআবাঅ, পৃষ্ঠা: ৯৭১)। ব্যুৎপত্তি অনুযায়ী শব্দটির বানানে শেষ ধ্বনি ত অপরিহার্য। “তৎসম বা সংস্কৃত শব্দের নির্দিষ্ট বানান অপরিবর্তিত থাকবে (বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ অনুচ্ছেদ: ১.১)। শুদ্ধ বানান: বিদ্যুৎ।]

৩. ট্রান্সফর্মার> ট্রান্সফরমার;

৪. উঁচু-নীচু> উঁচু-নিচু [বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা অভিধানমতে, সংস্কৃত ‘নীচ’ শব্দ থেকে উদ্ভূত অতৎসম (তদ্ভব/ খাঁটি বাংলা) ‘নিচু’ অর্থ: বিশেষণে অনুন্নত, নিম্ন, অবনত, ছোটো এবং বিশেষ্যে নিম্নস্থান। অন্যদিকে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহৃত সংস্কৃত ‘নীচ (ন+√চি+অ)’ শব্দের অর্থ: হীন, নিকৃষ্ট, সংকীর্ণমনা প্রভৃতি (বাএআবাঅ, পৃষ্ঠা: ৭৩৩, ৭৫৫)। এই অভিধানে ‘নীচু’ শব্দটি ঠাঁই পায়নি। অর্থ বিবেচনায়, ব্যানারে লিখিত নীচু পদটি সঠিক হয়নি; এর অর্থ নিম্ন নয়, হীন বা নিকৃষ্ট। অথচ, সংগত অর্থ: নিম্ন।]

৫. ধাপ ফেলুন> পা ফেলুন [হিন্দি উৎসের ‘ধাপ’ অর্থ: সিঁড়ির স্তর, পইঠা, ওপরে ওঠার সিঁড়ি, আরোহণী (বাএআবাঅ, পৃষ্ঠা: ৬৯৮)। এ অবস্থায় বাংলা একাডেমির ধাপ ফেলার অনুরোধ যথার্থ হয়নি। লেখা উচিত ছিল: পা ফেলুন।

১৯৬. ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে কবি নজরুলের বয়স ৩৯ ছিল না।

শুদ্ধীকরণ: ৩৯তম জন্মবার্ষিকী> ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী [জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বয়স ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে ৩৯ বছর ছিল না। তিনি ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে ২৯শে আগস্ট মারা যান। জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে মে (বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান, পৃষ্ঠা: ১১৩, প্রথম প্রকাশ: জুন ১৯৮৫ খ্রি.।) ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর ১১৬তম জন্মবার্ষিকী ছিল। ওই বছর (২০১৫ খ্রি.) ছিল তাঁর ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী।

১৮৮. বাংলা একাডেমির বাংলা বানান

নিচের ছবিটি বাংলা একাডেমির মালিকানাধীন স্টাফদের আনা-নেওয়ার জন্য ব্যবহৃত গাড়ি থেকে তোলা হয়েছে। এখানে বিদ্যমান ভুল ও অসংগতি বাংলা ব্যাকরণ, ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ ও বাংলা একাডেমি আধুনিক বাংলা আলোকে চিহ্নিত করে শুদ্ধ রূপ ও যৌক্তিকতার বিবরণ উপস্থাপন করা হলো।

শুদ্ধীকরণ: ষ্টাফ বাস> স্টাপ-বাস/ স্টাপ বাস [বিদেশি শব্দ। বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ পুস্তিকার ২.৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “বিদেশি শব্দের ক্ষেত্রে ‘ষ’ ব্যবহারের প্রয়োজন নেই।” স্টাপ বিদেশি শব্দ। তাই বানানে ‘ষ’ পরিহার্য। এটি সমাসবদ্ধ পদ। ‘বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম’ পুস্তিকার ৩.১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,“সমাসবদ্ধ শব্দগুলি যথাসম্ভব একসঙ্গে লিখতে হবে। বিশেষ প্রয়োজনে সমাসবদ্ধ শব্দটিকে এক বা একাধিক হাইফেন দিয়ে যুক্ত করা যায়।”]

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :