বিশ্ববাজারে কমছে জ্বালানি তেলের দাম, দেশে কমবে কবে
![](/assets/news_photos/2022/10/02/image-281342.jpg)
প্রায় তিনমাস ধরে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমতির দিকে থাকলেও দেশে এখনও সমন্বয় করা হয়নি। যদিও বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধিকে অন্যতম কারণ উল্লেখ করে সবশেষ গত ৬ আগস্ট থেকে দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়নো হয়। এর প্রভাব পড়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য, গণপরিবহনসহ সবক্ষেত্রেই।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের জীবন। প্রচণ্ড চাপে পড়েছে স্বল্প আয়ের মানুষ। এখন সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, বিশ্ববাজারে দাম কমছে, দেশে কমবে কবে?
বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধির দোহাই দিয়ে আগস্ট মাসে এক লাফে গড়ে প্রায় ৪৭ শতাংশ বাড়ানো হয় পেট্রোল, অকটেন, ডিজেল ও কোরোসিনসহ সব ধরণের জ্বালানি তেলের দাম। তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিশ্ববাজারে দাম কমলে দেশেও জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করা হবে। একই অজুহাতে গত বছর নভেম্বর মাসে জ্বালানি তেলের দাম ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি করে সরকার। সবমিলিয়ে ১০ মাসে দাম বাড়ানো হয় প্রায় ৭০ শতাংশ। আর ওই সময়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে গড় মূল্য বৃদ্ধি পায় ২০ শতাংশ। অর্থাৎ বিশ্ববাজারের তুলনায় দেশের বাজারে দাম ৫০ শতাংশ বেশি বাড়ানো হয়।
কিন্তু বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম নিম্নমুখী হলেও কার্যত সমন্বয়ের উদ্যোগ নেই সরকারের। উল্টো জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলছেন, এখনও লোকসান গুনছে বিপিসি। গেল কয়েক মাসে এ খাতে সরকারের লোকসান চার হাজার কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়লেই দেশে বাড়ানো হয়। কিন্তু দাম কমলেও প্রভাব পড়ে না বাংলাদেশে। তারা বলছেন, বিশ্বে জ্বালানি তেলের দাম অনেকাংশে কমেছে, কিন্তু দেশে এখনও দাম সমন্বয় না করা অন্যায্য। সরকারের উচিত, বিশ্ববাজার অনুযায়ী জ্বালানি তেলের দাম কমানো এবং এর প্রভাবে গণপরিবহন এবং যেসব জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, তা কমিয়ে জনসাধারণের জীবনযাত্রায় অব্যাহত চাপ কমানোর ব্যবস্থা নেওয়া।
অন্যদিকে একাধিক বিশেষজ্ঞ বলছেন, দাম না কমিয়ে যে বাড়তি মুনাফা হচ্ছে তা ‘প্রাইস স্টাবলাইজেশন ফান্ড (মূল্য স্থিতিশীলতা তহবিল)’ নামের একটি তহবিলে রেখে দেওয়া উচিত। বিশ্ববাজারে আবার দাম বাড়লে তখন দেশে জ্বালানি তেলের দাম না বাড়িয়ে ওই তহবিল থেকে সমন্বয় করা উচিত। এতে মানুষের ওপর হঠাৎ করে বাড়তি চাপ পড়বে না বলেও মনে করেন বিশেষষজ্ঞদের কেউ কেউ।
এদিকে ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির (আইইএ) প্রতিবেদন বলছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে ব্যারল প্রতি (১৫৯ লিটার) পৌঁছেছিল ১৩০ ডলারে। আর গতকাল তা কমে ৭৯ ডলার থেকে ৮১ ডলারে নেমে এসেছে। গত তিন মাসে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ৬৫ শতাংশ কমেছে বলেও সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়।
এছাড়া বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমায় একদিন আগে পাকিস্তানেও জ্বালানি তেলের মূল্য কমানো হয়েছে প্রায় ৬ শতাংশ। দেশটিতে এখন প্রতি লিটার পেট্রলের দাম বাংলাদেশি মুদ্রায় ৯৯ টাকা ৮৮ পয়সা, ডিজেলের লিটার ১০৪ টাকা ৫৫ পয়সা, কেরোসিন লিটার প্রতি ৮৫ টাকা ২৩ পয়সায় বিক্রি হচ্ছে। বিশ্ববাজারের সাথে মূল্য সমন্বয় করে জ্বালানির দাম পুননির্ধারণ করে দেশটি।
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমেছে, তাই দেশের বাজারে কমা উচিত। এ কথা আমি স্বীকার করছি। তবে আমি সমন্বয়ের পক্ষপাতি নই। কেননা সম্প্রতি ডিজেলের দাম লিটারে ৫ টাকা কমলেও যাত্রীভাড়া বা পণ্যমূল্য কমেনি। মানুষ কোনো সুফল পায়নি। দাম কমানোর সঙ্গে এগুলো নিশ্চিত করতে পারলে ইফেকটিভ (ফলপ্রসূ) হবে। যেহেতু তা হচ্ছে না, সেক্ষেত্রে সরকার রাজস্ব আদায় করুক, সেটাই ভালো।’
এ জ্বালানি বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ‘যখন বিশ্ববাজারে দাম কমেছে কিন্তু দেশে কমানো হয়নি, সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত মুনাফা হচ্ছে। এ বিষয়ক একটি তহবিল গঠন করে এই মুনাফা সেখানে রেখে দিতে হবে। পরবর্তীতে বিশ্ববাজারে দাম বাড়লেও দেশে দাম বৃদ্ধি না করে ওই তহবিল থেকে সমন্বয় করতে হবে। এ তহবিল পরিচালনায় পরিস্কার একটি নীতিমালা প্রয়োজন। স্বচ্ছতা থাকতে হবে, যেন- এই তহবিলের অর্থ অন্য কোনো খাতে সরকার খরচ করতে না পারে।’
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘যেই যুক্তিতে (বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধি) সরকার জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছিল, সেই যুক্তি এখন আর নেই। এর পরও দাম কমানো হচ্ছে না। আমরা কিছু বুঝতে পারছি না। আর তারাও (সরকার) এ বিষয়ে কিছু বলছে না যে, দাম কমাবে কখন?’
তিনি বলেন, ‘কথা হচ্ছে- যদি সরকার মনে করে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল আগের সেই দামে ফিরে গেলে দেশে দাম কমাবে, তাহলে এটা অন্যায় হবে।’ এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, বিশ্ববাজারে দাম যখন বাড়লো, সরকার সর্বোচ্চ জায়গাটা চুজ করে দামটা বাড়িয়ে দিল। তখন দাম মাঝামাঝি রাখলেই তো হতো। আরেকটি বিষয় হচ্ছে- বিশ্ববাজারে দাম কমে গেলে যে সরকার আবার দাম কমাবে সেই জিনিসটি সরকার সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করছে না।’
তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম যথেষ্ট কমে গেছে। যে জায়গাটা থেকে বৃদ্ধি শুরু হয়েছিল, সেটিও বেশি দূরে নয়।’
জ্বালানি তেলের দাম কমানোর মধ্যদিয়ে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রভাবে অন্য যেসব জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে তাও কমাতে হবে। নইলে মানুষের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হচ্ছে বলেও মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘এখন আর জ্বালানি তেলের দাম ভোক্তার পক্ষে নেই, সাংঘাতিকভাবে সরকারের পক্ষে চলে গেছে।’
এ বিষয়ে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম ঘনঘন পরিবর্তন না করে একসাথে বিশ্বমানের যুক্তিসঙ্গত একটি দাম নির্ধারণ করতে হবে। যা মানুষের জন্য সহনীয় হয়। নইলে মানুষ সুফল পাবে না।’
তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে প্রাইস স্টাবলাইজেশন ফান্ড (মূল্য স্থিতিশীলতা তহবিল) গঠন করতে হবে। যখন বিশ্ববাজারে দাম কমবে তখন দেশে যে অতিরিক্ত মুনাফা হবে তা ওই তহবিলে রাখতে হবে। যখন দাম বাড়বে তখন ওই তহবিল থেকে ভর্তুকি মেটাতে হবে। তাহলে বিশ্ববাজারে দাম ওঠানামা করলেও মানুষের জীবনযাত্রার ওপর চাপ তেমন একটা পড়বে না।’
এ বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘প্রথম কথা হচ্ছে- আইনে আছে যে, জ্বালানি সরবরাহের জন্য যতটা খরচ হবে, মূল্যহার তার সামঞ্জস্য হবে। কিন্তু বিশ্ববাজারে দাম বাড়ায় দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলো কিন্তু বিশ্ববাজারে দাম কমার পর দেশে কমানো হলো না। অর্থাৎ দাম না কমিয়ে বাড়তি প্রোফিট (মুনাফা) করা হচ্ছে। আইনের ভাষায় এটি লুণ্ঠনমূলক মুনাফা, যা সরকার দীর্ঘবছল ধরে জ্বালানি খাতে করে আসছে। যা ফৌজদারি অপরাধ। বিচারযোগ্য অপরাধ। বিচারবিভাগ চাইলে এ অভিযোগে সরকারের বিরুদ্ধে বিচার শুরু করতে পারে।’
‘দুর্ভাগ্য যে, দীর্ঘবছর ধরেই জ্বালানিখাতে এসব চলছে। এ থেকে মানুষকে পরিত্রাণ দিতে হবে। জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে ভোক্তার ওপর চাপ কমাতে হবে, দুর্ভোগ কমাতে হবে’, বলেন এই বিশেষজ্ঞ।
এ বিষয়ে জানতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, সিনিয়র সচিব মো. মাহবুব হোসেন ও বাংলাদেশ পেট্রলিয়াম করপোরেশন -বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও তারা ফোন ধরেননি।
তবে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. মো. হেলাল উদ্দিন ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় বা পুনরায় নির্ধারণের কোনো আলোচনা এখনও হয়নি।’
(ঢাকাটাইমস/০২অক্টোবর/এফএ)
সংবাদটি শেয়ার করুন
বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ
![](/cache-images/news_photos/2024/07/03/resize-90x60x0image-358347.jpg)
বেড়ার মেয়র আসিফ ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি, দেশ ছাড়লেন কীভাবে? কৌতূহল সর্বত্র
![](/cache-images/news_photos/2024/07/02/resize-90x60x0image-358194.jpg)
শিক্ষকদের পেনশনের টেনসনে স্থবির উচ্চশিক্ষা
![](/cache-images/news_photos/2024/07/01/resize-90x60x0image-358165.jpg)
কেরাণীগঞ্জে দেড় কোটি টাকার নিষিদ্ধ ব্রাহমা গরুর সন্ধান
![](/cache-images/news_photos/2024/06/30/resize-90x60x0image-357958.jpg)
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি চালুর উদ্যোগ কতটা গ্রহণযোগ্য? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা
![](/cache-images/news_photos/2024/06/28/resize-90x60x0image-357767.jpg)
সর্বজনীন পেনশনে অনীহা কেন, যা বলছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকনেতারা
![](/cache-images/news_photos/2024/06/28/resize-90x60x0image-357765.jpg)
সাদিক অ্যাগ্রোর সবই ছিল চটক
![](/cache-images/news_photos/2024/06/26/resize-90x60x0image-357537-1719373181.jpg)
ঢাকা মহানগর বিএনপি ও যুবদলের কমিটি দিতে ধীরগতি যে কারণে
![](/cache-images/news_photos/2024/06/25/resize-90x60x0image-357433.jpg)
রাসেলস ভাইপার আতঙ্ক: উপজেলা হাসপাতালগুলোতে নেই চিকিৎসা সক্ষমতা
![](/cache-images/news_photos/2024/06/22/resize-90x60x0image-357190.jpg)
মাগুরায় বাড়ি-জমি উত্তম কুমারের: কোথাও খোঁজ নেই তার, দুদকের অনুসন্ধান সম্পন্ন
![](/cache-images/news_photos/2024/06/21/resize-90x60x0image-357067.jpg)