রাসেলস ভাইপার আতঙ্ক: উপজেলা হাসপাতালগুলোতে নেই চিকিৎসা সক্ষমতা
দেশজুড়ে বিষধর সাপ রাসেলস ভাইপার নিয়ে আতঙ্ক উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে গনমাধ্যমেও এই সাপ ছড়িয়ে পড়ার খবর এখন টক অব দ্যা কান্ট্রিতে পরিণত হচ্ছে। এতে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মানুষের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক বিরাজ করছে।
সঠিক সময়ে চিকিৎসা পেলে এই বিষধর সাপের কামড়ে মৃত্যু হয় না বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, রাসেলস ভাইপার নিয়ে দেশে সতর্কতা এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি।
তবে ঢাকা টাইমস খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছে দেশের উপজেলা পর্যায়ের মেডিকেলগুলোতে সাপে কামরের রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার সক্ষমতা নেই। নেই পর্যাপ্ত পরিমাণে ওষুধ। বিশেষ করে বিষধর সাপ মানুষকে কামর দিলে তাকে অতিদ্রুত চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে হয়। সেক্ষেত্রে স্থানীয় অনেক রোগীই দেরিতে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে হাসপাতাল যেতেও সময় লেগে যায়। এতে করে রোগীরা হাসপাতালে দেরিতে আসায় তাদের শরীরে বিষক্রিয়া ছড়িয়ে পড়লে আইসিইউ কিংবা সিসিইউ এর প্রয়োজন পড়ে। এছাড়াও অনেক সময় রোগীদের কার্ডিয়ার্ক সাপোর্টের দরকার হয়। তবে উপজেলা পর্যায়ে এসকল সাপোর্ট না থাকায় বেশিভাগ রোগীকে অন্যত্র বদলী করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এতে করে রোগীদের মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়।
লালমনিরহাট সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. দীপংকর রায় ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘সঠিক সময়ে সাপে কামর দেওয়া রোগী মেডিকেলে এসে চিকিৎসা নিলে তেমন কোনো সমস্যা হয় না। তবে বেশিভাগ রোগীরাই দেরিতে মেডিকেলে আসেন। এসময় রোগীর অবস্থা এমনিতেই খারাপ থাকে। তাই অনেক রোগীর আইসিইউ, সিসিউর প্রয়োজন পড়ে। এছাড়াও এই সময় রোগীর কন্ডিশন অনুযায়ী ‘অ্যান্টিভেনম’ প্রয়োগ না হলে মাঝে মাঝে পার্শ প্রতিক্রিয়াও দেখা যায়। তখন রোগীকে ভিন্ন ওষুধ দিতে হয়। উপজেলা পর্যায়ে এসব সক্ষমতা থাকে না।’
এদিকে অনুসন্ধানে সবশেষ রবিবার পর্যন্ত অনেক উপজেলা পর্যায়ে সাপে কামরের ‘অ্যান্টিভেনম’ ওষুধ পাওয়া যায়নি। জানতে চাইলে স্থানীয় পর্যায়ের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা ঢাকা টাইমসকে জানিয়েছেন, ‘অ্যান্টিভেনম’ জেলা সদর হাসপাতালগুলোতে সব সময় পাওয়া যায়। তবে উপজেলা পর্যায়ে এর সরবরাহ তেমন থাকে না।
নেত্রকোনা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আহসান কবীর ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘জেলা সদর হাসপাতালে ‘অ্যান্টিভেনম’ রয়েছে, তবে উপজেলা পর্যায়ে সাপে কামরের এই ওষুধ নেই।’
মানিকগঞ্জেরে সিংগাইর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাক্তার সৈয়দা তাসনুবা মারিয়া ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘কয়েকদিন আগে সিংগাইর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সাপে কামরের ‘অ্যান্টিভেনম’ দেওয়া হয়েছে। তবে শুধু ‘অ্যান্টিভেনম’ থাকলেই রোগীর সম্পূর্ণ চিকিৎসা দেওয়া যায় না। সাপে কামরের রোগীর চিকিৎসায় অনেক সময় কার্ডিয়াক সাপোর্টের প্রয়োজন হয়। এছাড়াও রোগীর অবস্থা অনুযায়ী বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আইসিউ এবং সিসিউ’র প্রয়োজন হয়। উপজেলা পর্যায়ে এসবের কোনো ব্যবস্থাই নেই। এজন্য রোগীদের অনেক সময় জেলা সদস্য কিংবা অন্যত্র ট্রান্সফার করতে হয়।’
রাসেলস ভাইপার সাপের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সাপে কামর দিলে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে আনতে হবে। যত দ্রুত আনা হবে তত ভালো চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে। এই সাপ নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক এবং সচেতন হতে হবে।’
বনবিভাগের তথ্য বলেছে, দেশে ২০১২ সালের পর থেকে রাসেলস ভাইপারের সংখ্যা বাড়তে থাকে। রাসেলস ভাইপার দক্ষ সাঁতারু হওয়ায় নদীর স্রোতে ও বন্যার পানিতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিস্তৃত হয়েছে। বন অধিদপ্তরের উপ বন সংরক্ষক মো. জিল্লুর রহমান ঢাকা টাইমসে বলেন, ‘ইতোমধ্যে ২৫ জেলায় রাসেলস ভাইপারের বিস্তৃতি পাওয়া গেছে। অতি দ্রুত এরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা নদী এবং এর শাখা নদী কেন্দ্রিক এলাকাগুলোতে রাসেল ভাইপারের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই সাপটির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পেছনে মূলত আমরাই দায়ী। যেসব প্রাণী রাসেলস ভাইপার খেয়ে এদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখে, প্রকৃতিতে এদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে। বেজি, গুইসাপ, বাগডাশ, গন্ধগোকুল, বন বিড়াল, মেছো বিড়াল; এরা রাসেলস ভাইপার খেয়ে থাকে। এছাড়া তিলা নাগ ঈগল, সারস, মদনটাক রাসেলস ভাইপার খেতে পারে। বন্যপ্রাণী দেখলেই তা নিধন করার প্রবণতা, কারণে অকারণে বন্যপ্রাণী হত্যা, এদের আবাসস্থল ধ্বংস করাসহ বিভিন্ন কারণে দেশের সর্বত্রই এসব শিকারি প্রাণী আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে, ফলে রাসেলস ভাইপার অত্যধিকহারে প্রকৃতিতে বেড়ে গেছে।’
দক্ষিনাঞ্চলের উপজেলাগুলোতে রাসেলস ভাইপার নিয়ে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে পটুয়াখালীর বিভিন্ন উপজেলাতে এই সাপের আতঙ্ক এখন বসতভিটা থেকে শুরু করে চায়ের দোকানেও। তবে আসলেও এই উপজেলাতে রাসেল ভাইপারের অবস্থান এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হতে পারেনি বন বিভাগ। জেলা কর্মকর্তারাও এখন পর্যন্ত এই সাপের অস্তিত পটুয়াখালিতে এখন পর্যন্ত পাননি।
পটুয়াখালী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. ফজলুল হক সরদার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত পটুয়াখালিতে রাসেলস ভাইপারের বিস্তৃতি বা অবস্থান পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন এলাকায় সাপ দেখলেই রাসেল ভাইপার বলে অনেকে আতঙ্কিত হচ্ছেন।’
শনিবার দুপুর ২টার দিকে জেলার বাউফল উপজেলার কালিশুরি ইউনিয়নের মাজেদা ক্লিনিকের সামনে একটি সাপ দেখে রাসেল ভাইপার ভেবে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এলাকাবাসী। মুহুর্তের মধ্যে খবর ছড়িয়ে পড়ে পুরো জেলায়। রাসেল ভাইপার ভেবে একটি সাপ ও তার ১৭ বাচ্চা মেরে ফেলে স্থানীয়রা। পরে মৃত সাপটি পটুয়াখালীর বন্য প্রাণী ও সাপ উদ্ধার কর্মী আসাদুল্লাহ হাসান মুসা শনাক্ত করেন। তিনি জানান, যেই সাপগুলো মারা হয়েছে স্থানীয়ভাবে মেটে সাপ বা মাইট্টা সাপ নামে পরিচিত। সাপটির নাম রেইনবো ওয়াটার স্নেক। প্রায় সময়েই সাপে কামর খেয়ে এই উপজেলার মানুষ উপজেলা হাসপাতালে গেলেও তেমন কোনো চিকিৎসা পান না বলে জানা গেছে। এদিকে এই উপজেলা মেডিকেলে নেই সাপে কামর দেওয়া রোগীর অতি জরুরি ওষুধ ‘অ্যান্টিভেনম’।
পটুয়াখালীর জেলার বাউফল উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা প্রশান্ত কুমার সাহা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘এই উপজেলায় আগে ‘অ্যান্টিভেনম’ ছিল না, তবে এখন কিছু সরবরাহ করা হয়েছে। তবে আমরা আরও চাহিদা পত্র পাঠাবো। যেহেতু এই সাপের উপদ্রব বাড়তে শুরে করেছে তাই ‘অ্যান্টিভেনম’ পর্যাপ্ত পরিমাণে রাখার ব্যবস্থা করা হবে।’
এদিকে বাউফল উপজেলার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার ডা. মো. আখতার উজ জামান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বাউফল উপজেলায় কোনো ‘অ্যান্টিভেনম’ নেই। সাপে কামর দেওয়া কোনো রোগী আসলে তাদের জেলা সদর হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’
স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের যুগ্মসচিব (সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা অধিশাখা) অতুল সরকার ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নির্দেশনায় দেশের সব জায়গায় সাপের বিষ প্রতিষেধক বা অ্যান্টিভেনম পর্যাপ্ত পরিমাণে দেওয়া হয়েছে। যদি উপজেলা পর্যায়ে কোনো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এই ওষুধ না সরবরাহ করা হয় তাহলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোথাও যদি এখনো না পৌঁছে থাকে তা স্বল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে যাবে।
(ঢাকাটাইমস/২৫জুন/এইচএম/এসআইএস)