নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতা

ধারাবাহিক হামলায় বাড়িছাড়া পরাজিত প্রার্থীদের সমর্থকরা

তাওহিদুল ইসলাম, ঢাকা টাইমস
  প্রকাশিত : ১৫ জানুয়ারি ২০২৪, ১০:০০| আপডেট : ১৫ জানুয়ারি ২০২৪, ১০:০২
অ- অ+

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষ হয়েছে গত জানুয়ারি। এরপর থেকেই পরাজিত প্রার্থীদের নেতা-কমী সমর্থকরা হামলার শিকার হচ্ছেন। যা ধারাবাহিকভাবে চলছে।

ঢাকা টাইমসের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভোটের পর থেকেই পরাজিত প্রার্থীদের ওপর হামলা হচ্ছে। কোথাও কোথাও সশস্ত্র হামলা, কুপিয়ে জখম হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া নানা ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থীর নেতা-কর্মী সমর্থকরা।

পরাজিত প্রার্থীরা বলছেন, অব্যাহতভাবে কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা করা হচ্ছে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটেছে। হামলার ভয়ে অনেকেই বাড়িঘর থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

জানা গেছে, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে পিরোজপুর- আসনে (মঠবাড়িয়া) পরাজিত স্বতন্ত্র প্রার্থী রুস্তম আলী ফরাজীর সমর্থক হারুন অর রশিদ হাওলাদারকে (৫৫) কুপিয়ে জখম করেছেন বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী শামীম শাহনেওয়াজের লোকজন। হারুন অর রশিদ হাওলাদার তুষখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। রুস্তম আলী ফরাজী জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান। তিনি এবার জাতীয় পার্টির মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন।

হারুন অর রশিদ হাওলাদার গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে তুষখালী বাজারে যাওয়ার পথে বিজয়ী শামীম শাহনেওয়াজের সমর্থক বাবু, আল আমিন, রনিসহ কয়েকজন তার ওপর হামলা করেন। তারা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হাত-পায়ে পিটিয়ে হারুনকে গুরুতর জখম করেন।

নোয়াখালী- (সেনবাগ সোনাইমুড়ী আংশিক) আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর এজেন্ট শাহেদুজ্জামান ওরফে পলাশকে (৩৫) কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা।

আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহা. আতাউর রহমান ভূঁইয়ার পোলিং এজেন্ট ছিলেন শাহেদুজ্জামান।

আতাউর রহমান ভূঁইয়া ঢাকা টাইমসকে বলেন, আমার এজেন্টকে গুলি হরে হত্যা করেছে প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থীর সমর্থকরা। তিনি বলেন, এখনও আমার নেতা-কর্মীদের প্রতিনিয়ত হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। নৌকার প্রার্থীর লোকজন এসব করছে।

চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে নির্বাচনে পরাজিত স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিনের কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা করেছে নৌকার সমর্থকরা। হামলায় আহত হয়েছেন, গিয়াস উদ্দিনের নির্বাচনি এজেন্ট মঞ্জুরুল হাসান মঞ্জু (৪৪) মাইনুল হাসান আশরাফ (৪৫)

খুলনার , আসনে নৌকার বিপরীতে স্বতন্ত্র হিসেবে আওয়ামী লীগের তিন নেতা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। তিন প্রার্থীর হয়ে যারা কাজ করেছেন, তাদের ওপরই হামলার ঘটনা ঘটছে।

খুলনা- আসনে (রূপসা-তেরখাদা-দিঘলিয়া) নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছেন শিল্পপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী। তার বিপরীতে কেটলি প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন ওই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তফা রশিদী সুজার ভাই এস এম মোর্তজা রশিদী দারা।

মোর্তজা রশিদীর হয়ে নির্বাচনি কাজ করেছিলেন তেরখাদা উপজেলার ছাগলাদাহ ইউনিয়নের কুদলা গ্রামের রিলি বেগম তার স্বামী মোহাম্মদ এসকেন্দ শেখ। নির্বাচনের দিন ভোট গণনা শুরুর কিছুক্ষণ পর তাদের ওপর সশস্ত্র হামলা হয়। এসকেন্দ শেখকে কুপিয়ে জখম করা হয়। রিলি বেগম অভিযোগ করে বলেন, হামলার ঘটনায় তেরখাদা থানায় মামলা করতে গেলেও তা নেওয়া হয়নি।

একই উপজেলার আজগড়া এলাকায় কেটলি প্রতীকের হয়ে কাজ করেছিলেন মো. আবদুল কুদ্দুস তালুকদার তার মেয়ে শিল্পী বেগম। নির্বাচনের পরদিন তাদের ওপর হামলা করেন নৌকার সমর্থকেরা। বেদম মারধর করার পর তারা এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

রূপসা উপজেলার নৌহাটি ইউনিয়নের ইলাইপুর গ্রামে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল সিরাজুল ইসলামের। নির্বাচনের পরদিন নৌকার লোকজন তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটিতে তালা লাগিয়ে দিয়েছেন।

স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এম মোর্তজা রশিদী সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, তার নির্বাচনি এলাকায় অন্তত ৩০ জনের বেশি মানুষের ওপর হামলা হয়েছে। তাদের বাড়িঘর ভাঙচুর লুটপাট করা হয়েছে। দোকান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অনেকেই বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে থানা পুলিশ সুপারের কাছে অভিযোগ করলেও হামলা ফল হচ্ছে না। থামানো যাচ্ছে না ধারাবাহিক এই হামলা। প্রশাসন থেকেও হামলা বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।

খুলনা- আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এম মোর্তজা রশিদী দারা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমার অগণিত নেতা-কর্মীদের ওপর নৌকা প্রতীকের বিজয়ী সংসদ সদস্য আবদুস সালাম মুর্শেদীর কর্মী-সমর্থকরা হামলা করেছে। এই হামলার ঘটনায় থানায় মামলা করতে গেলে মামলাও নেয়নি পুলিশ।

মোর্তজা রশিদী বলেন, ‘আমার আসনের হিন্দুবাড়ি লুট হয়েছে। হিন্দুর বাড়ির লোকজন ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

খুলনা- (ডুমুরিয়া-ফুলতলা) আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছেন সাবেক মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। বিপরীতে ঈগল প্রতীকে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ফুলতলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আকরাম হোসেন। নির্বাচনে আকরাম হোসেনের হয়ে কাজ করেছিলেন শোভনা ইউনিয়নের মো. আবদুর রহিম তার স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন। ভোট গ্রহণের পরদিন সকালে আবদুর রহিমের বাড়িতে হামলা করেন নৌকার নেতা-কর্মীরা। কিন্তু আবদুর রহিমকে বাড়িতে না পেয়ে তার স্ত্রীকে বেধড়ক মারধর করেন।

আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী আকরাম হোসেন বলেন, স্বতন্ত্র হিসেবে অংশ নিলেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে নাÑ দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার এমন আশ্বাসে তারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। তাদের সঙ্গে যারা কাজ করেছেন, তারাও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী। নির্বাচন শেষ হওয়ার পর ডুমুরিয়ার বিভিন্ন এলাকায় ঈগল প্রতীকের নেতাকর্মীদের ওপর একের পর এক হামলা হচ্ছে। বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়েছে। মানুষ ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘরও ভাঙচুর করা হয়েছে।

খুলনা- (কয়রা-পাইকগাছা) আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন পাইকগাছার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মো. রশীদুজ্জামান। তার বিপরীতে ঈগল প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ জিএম মাহবুবুল আলম। নির্বাচনের পরে পাইকগাছার গড়াইখালী ইউনিয়নে বেশ কয়েকটি সহিংসতার ঘটনা ঘটে। অনেককে মারধর করা হয়েছে। কাউকে কাউকে বাড়িছাড়া করার হুমকি দেওয়া হয়েছে।

মানিকগঞ্জ- (সিঙ্গাইর, হরিরামপুর সদরের একাংশ) আসনে পরাজিত নৌকার প্রার্থী মমতাজ বেগমের নেতা-কর্মীরা হামলা শিকার হয়েছে। মমতাজ বেগমের অভিযোগ, তার অনুসারীদের ওপর হামলার ঘটনাগুলোয় নির্বাচনে বিজয়ী ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান জাহিদ আহমেদ জড়িত।

আরও জানা গেছে, কুষ্টিয়া- (কুমারখালী-খোকসা) আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী সেলিম আলতাফ জর্জকে পরাজিত করে বিজয়ী হন স্বতন্ত্র প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আবদুর রউফ (ট্রাক প্রতীক) এরপর থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থীর লোকজন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষকে নির্যাতন করছে। সহিংসতা ছড়াচ্ছে। মানুষকে কুপিয়ে আহত করছে। বাড়িঘর ভাঙচুর করছে।

কুষ্টিয়া জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কুমারখালীর বাসিন্দা জয়দেব বিশ্বাস বলেন, কুমারখালীতে নৌকায় ভোট দেওয়ায় প্রতিপক্ষের লোকজন হিন্দুদের ওপর হামলা করেছে। বাড়িঘর ভাঙচুর করে নারীদের মারধর করেছে। পাঁচ থেকে ছয়টি পরিবার ভয়ে বাড়িছাড়া।

সিরাজগঞ্জ- (বেলকুচি-চৌহালী) আসনে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার বিষয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাস গত শনিবার সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ভোটের পরে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর ছত্রছায়ায় বহিরাগত নব্য আওয়ামী লীগের লোকজন তার কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা করছে। ঈগলের প্রায় দুই হাজার সমর্থক বাড়িছাড়া। তাদের পরিবারকে অব্যাহতভাবে এলাকাছাড়া করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। আবদুল লতিফের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন সংসদ সদস্য আবদুল মমিন মন্ডল। তিনি নৌকা প্রতীকে ৭৭ হাজার ৪২২ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন।

মুন্সিগঞ্জ- আসনে নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় অর্ধশত বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ককটেল বিস্ফোরণসহ ভাঙচুর লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। রবিবার ভোর সাড়ে ৬টার দিকে সদর উপজেলার চরাঞ্চলের আধার ইউনিয়নের সোলারচর বকুলতলা গ্রামের এই হামলার ঘটনা ঘটে। এতে আহত হয়েছেন নারীসহ জন। স্বর্ণালঙ্কার নগদ টাকা গরু-ছাগল লুটে নেওয়ার অভিযোগ করেছে ভোক্তভোগীরা। তাদের অভিযোগ নির্বাচনে নৌকা সমর্থন করায় একই আসনের জয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী হাজী ফয়সাল বিপ্লব সমর্থকরা হামলা করেছেন।

(ঢাকাটাইমস/১৫জানুয়ারি/টিএ/আরআর)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
এবার চিন্ময়ের জামিন স্থগিতের আদেশ প্রত্যাহার, শুনানি রবিবার
গুলশানে নসরুল হামিদের ২০০ কোটি টাকা মূল্যের জমি ক্রোক
খুলনায় ট্যাংক লরি উল্টে দুই নারী নিহত
আন্তঃজেলা বাসে ডিএনসির অভিযান, সাড়ে ১৫ হাজার ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার ২
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা