জিএম কাদেরের বলয়ে রওশনপন্থিদের ছোবল

জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর থেকেই পার্টির নেতৃত্ব নিয়ে মুখোমুখি রওশন এরশাদ ও জিএম কাদের। দেবর-ভাবির এ দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে দলটির বিভিন্নস্তরের নেতাকর্মীরাও। বিশেষ করে দল থেকে অব্যাহতি পাওয়া এবং বাদ পড়া নেতাকর্মীরা আশ্রয় নেয় রওশন এরশাদের সান্নিধ্যে। এরপর জিএম কাদেরকে বিভিন্নভাবে রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করার চেষ্টা করলেও হালে পানি পাননি রওশনপন্থীরা।
তবে, সম্প্রতি দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মনোনয়নে স্বজনপ্রীতি ও সারাদেশে দলীয় প্রার্থীদের কোনো খোঁজখবর না রাখার অভিযোগে ফুঁসে ওঠা নেতাকর্মীরা রওশন এরশাদের দিকে ধাবিত হতে থাকে এবং রাতারাতি সরব হয়ে ওঠে। জিএম কাদের আস্থাভাজন বলে পরিচিত অনেক নেতাকর্মী সরাসরি চ্যালেঞ্জ করে বসেন দলটির বর্তমান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। তাদের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে খোদ বনানী কার্যালয়ে হয় বিক্ষোভ। এতে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় অনেককে। এখন বহিষ্কার হওয়া এবং জাপার বর্তমান নেতৃত্বের কর্মকাণ্ডে আঘাতপ্রাপ্তরা রওশনপন্থিদের সঙ্গে একজোট হয়ে জিএম কাদেরের বলয়ে ছোবল মারছেন।
ইতিপূর্বে জাতীয় পার্টি বা অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের পদধারী কোনো নেতা রওশন এরশাদ অনুসারীদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না রাখলেও এবার অনেক নেতাকর্মী স্বেচ্ছায় যাচ্ছেন রওশন এরশাদের সান্নিধ্যে। এমনকি তৃণমূলের যেসকল নেতাকর্মীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জিএম কাদেরের গুণগানে ব্যস্ত থাকতো তারাই এখন তার বিরুদ্ধে সরব।
সাড়ে চারবছর যাবত রওশন এরশাদের নেতৃত্বে একটি অংশ অনেকবার সারাদেশে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালানোর চেষ্টা করলেও আশানুরূপ সাড়া জাগাতে পারেননি তারা। এবার দেশের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে ক্ষোভ এবং রওশন এরশাদের প্রতি যে উৎসাহ সৃষ্টি হয়েছে তা কাজে লাগিয়ে দ্রুতগতিতে সারাদেশে সংগঠনকে বিকশিত করার লক্ষ্যে মাঠে নেমেছেন জিএম কাদের বিরোধীরা।
ইতিপূর্বে রওশন এরশাদ স্বাক্ষরিত অনেক বিজ্ঞপ্তিতে জিএম কাদেরের সমালোচনা করে বক্তব্য প্রকাশিত হলেও বিজ্ঞপ্তি নিয়ে অনেক প্রশ্ন জন্ম নেয়। কারণ, গণমাধ্যমের সামনে প্রকাশ্যে জিএম কাদেরের সমালোচনা করেননি রওশন এরশাদ। কিন্তু, ২৮ জানুয়ারি তার গুলশানের বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে পার্টির চেয়ারম্যান থেকে জিএম কাদের এবং মহাসচিব থেকে মুজিবুল হক চুন্নুকে অব্যাহতি দিয়ে নিজেকে পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করে দলের নেতৃত্ব নিয়ে জিএম কাদেরের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অবস্থান নেন প্রয়াত এরশাদপত্নী রওশন এরশাদ।
এরপর থেকে রাতারাতি পাল্টে যায় জাপার মাঠ পর্যায়ের প্রেক্ষাপট। বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী নিয়ে রওশন এরশাদের অনুসারীরা শুক্রবার প্রথমবারের মতো প্রবেশ করেন জাপার কাকরাইলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। শনিবার রাজধানীর মোহাম্মদপুরে প্রতিনিধি সম্মেলনের মাধ্যমে গঠন করা হয় জাতীয় ছাত্রসমাজের নতুন আহ্বায়ক কমিটি। ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে ঢাকা মহানগর উত্তর জাতীয় পার্টির সম্মেলন। এছাড়াও আগামী ২ মার্চ জাতীয় সম্মেলনের ঘোষণা দেন তারা।
রওশন এরশাদ অনুসারী এক নেতা ঢাকা টাইমসকে জানান, আমরা কয়েকদিনের মধ্যেই সিলেট শাহ জালাল (রা.) মাজার শরিফ এবং রংপুরে প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কবর জিয়ারত করে সারাদেশে সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য জেলা সফরে নামবো। এছাড়া অল্প কয়েকদিনের ভেতর আমরা বনানী কার্যালয়ে প্রবেশ করবো।
রওশনপন্থি জাতীয় পার্টির মুখপাত্র সুনীল শুভ রায় ঢাকা টাইমসকে বলেন, সারাদেশে জাতীয় পার্টির এমন অবস্থা তালা ঝুলতে ঝুলতে এখন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা ঝুলতে শুরু করেছে। এ অবস্থা থেকে পার্টিকে রক্ষা করতে হলে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে পুনর্গঠন করা ছাড়া বিকল্প নেই।
এদিকে, জিএম কাদেরপন্থি জাতীয় পার্টির এক প্রেসিডিয়াম ঢাকা টাইমসকে বলেন, আজকে যারা রওশন এরশাদের সঙ্গে বেশি সক্রিয় তারা কয়েকমাস আগেও জিএম কাদেরের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। জিএম কাদের-রওশন এরশাদের দ্বন্দ্বে এই লোকগুলোই প্রকাশ্যে জিএম কাদেরের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বনানীতে বিক্ষোভ মিছিল করেছিলেন। কিন্তু জিএম কাদের তাদের কাছে ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন অথবা কাছে রাখার চেষ্টা করেননি।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ঢাকা টাইমসকে বলেন, তারা (রওশনপন্থি) কী করলো আমাদের কিছু আসে যায় না। আমাদের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তারা অন্যদল করলে আমাদের কিছু করার নেই। রওশন অনুসারীরা তাদের জাতীয় পার্টিকেই মূল অংশ দাবি করছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে চুন্নু বলেন, আনোয়ার হোসেন মঞ্জুও তো তাদের পার্টিকে মূল জাতীয় পার্টি দাবি করেন। দাবি করলেই তো আর হয় না। তাছাড়া জাতীয় পার্টির কার্যালয় কেউ দখল নেইনি এবং নিতেও পারবে না।
দলটির উভয়পক্ষের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, রওশন এরশাদের অনুসারীরা সারাদেশে জাতীয় পার্টির তৃণমূল পর্যায়ে যোগাযোগ করছেন। এর আগে তারা প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিভিন্ন জেলা ও ইউনিট কমিটি ঘোষণা করলেও এবার সরাসরি সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটির দেওয়ার কার্যক্রম শুরু করেছে।
ঢাকা বিভাগের একটি জেলার সাধারণ সম্পাদক ঢাকা টাইমসকে বলেন, রওশন এরশাদের পক্ষ থেকে আমাকে ফোন দিয়ে তাদের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার কথা বলেছেন। আমি বলেছি, জিএম কাদের সাহেবের কর্মকাণ্ডে আমি নিজেও হতাশ। তবে, আমি জিএম কাদেরের বাইরে যাবো না।
বৃহত্তর রাজশাহী জেলার এক সভাপতি ঢাকা টাইমসকে বলেন, জিএম কাদের সম্প্রতি এক প্রেসিডিয়াম সদস্যকে অব্যাহতি দিয়েছেন। সে আমাকে ফোন দিয়ে রওশন এরশাদের পক্ষে অবস্থান নিতে বলেছেন। উত্তরে আমিও বলেছি, আমি আর জিএম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি করবো না। আমি এখন থেকে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি করবো।
কুমিল্লার একটি আসন থেকে জাতীয় পার্টির দ্বাদশ নির্বাচনে অংশ নেওয়া এক প্রার্থী ঢাকা টাইমসকে বলেন, আমার সঙ্গে রওশন এরশাদের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করেছে। আমি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছি- জাতীয় পার্টিই আর করবো না। অনেক হয়েছে। এ দলটি করে সমাজে আর ছোট হতে চাই না।
এ বিষয়ে রওশন এরশাদপন্থি জাতীয় পার্টির মহাসচিব কাজী মামুনুর রশীদ ঢাকা টাইমসকে বলেন, আগামী নির্বাচনকেন্দ্রীক কোনো জোট ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতিমূলক সংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছি। পার্টির তৃণমূল নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলবো- জিএম কাদের এবং মুজিবুল হক চুন্নুকে যেনো কেউ আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেয়। তারা দল ও জাতির জন্য ক্ষতিকারক। আসুন সবাই মিলে পল্লীবন্ধুর আদর্শ লালন করে পার্টিকে সুসংগঠিত করি।
(ঢাকাটাইমস/৪ফেব্রুয়ারি/জেবি/এআর)

মন্তব্য করুন