একুশ যা বলে

আহসান ইমাম
 | প্রকাশিত : ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৮:২১

শহিদ দিবসের নির্মাণ মূলত ভাষার প্রসঙ্গে। আমরা চেয়েছিলাম আমাদের মাতৃভাষা বাংলা, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে। সেসময়ের রাষ্ট্র সেটি অনুমোদন করেনি। শুধু অনুমোদন না করে ক্ষান্ত হয়নি, হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিলো। হত্যা করেছিলো তাদের, যারা দাবি করেছিলেন যে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। একুশ কেবল ভাষার প্রশ্নে মানুষের জাগরণ এবং জীবন উৎসর্গের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বাংলাদেশ সৃষ্টির সূচনা হয়েছিলো এই চেতনার উপর নির্ভর করে। আমাদের মূল আদর্শ, মূল্যবোধ, প্রেরণা, আত্মসম্মানের জায়গা একুশ। আরো বৃহৎ এবং গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক, সাংস্কৃতিক তাৎপর্য বহন করে একুশ।

একুশ এ জাতির, দেশের এবং ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য সবসময়ই অনুপ্রেরণার। প্রশ্ন সেই অনুপ্রেরণা আমাদেরকে কতদূর এগিয়ে নিয়েছে? নতুন প্রজন্মকে আমরা সেই বলিষ্ঠ, আত্মমর্যাদার চেতনাকে কতটুকু এবং কীভাবে সঞ্চারিত করতে পারছি? একুশ কী কেবল শুধু ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখের মধ্যেই বা আরেকটু বললে পুরো ফেব্রুয়ারি মাসজুড়েই সীমাবদ্ধ? এসব আমাদের অনুধাবন করার সময় এসেছে এবং সেভাবে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্মাণ করা দরকার। আমাদের জীবনে-যাপনে, চলায়-বলায়, কথায়-কাজে, শিল্পে-সাহিত্যে বড় কিছু কতটা অর্জন করতে পেরেছি।

আজও মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটক ছাড়া আমাদের দ্বিতীয় কোনো বড় অর্জন নাটকের ক্ষেত্রে নেই। আবদুল গাফফার চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ কিংবা আব্দুল লতিফের ‘মাগো আটই ফাল্গুনের কথা আমরা ভুলি নাই’ ছাড়া বড় তেমন কোন গানের দেখা পাই না। চলচ্চিত্রে জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছাড়া উল্লেখযোগ্য একুশকেন্দ্রিক অর্জন চোখে পড়ে না। তবে কবিতার ক্ষেত্রে একুশ আমাদের মননে অনেকটাই বড় অংশ জুড়ে এখনো বিরাজমান। অর্থ্যাৎ আমরা সেই চেতনাকে আজ আর বড় করে দেখছি না। আবারও বলা প্রয়োজন শুধু ফেব্রুয়ারি মাস ছাড়া একুশ আমাদের সঙ্গে সবসময় থাকতে চায়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থকে পাশ কাটাতে বলে। হানাহানি, ভেদাভেদ, অসাম্প্রদায়িকতা, সংকীর্ণতাকে পাশ কাটাতে বলে।

তৌকির আহমেদের ‘ফাগুন হাওয়ায়’ আমরা পেয়েছি এ সময়ে এসে, তবে এটি মৌলিক গল্পের সৃষ্টি না হলেও বড় অর্জনের মধ্যে একটি। এগুলো আমাদের অর্জন। এই অর্জনগুলোকে সম্মানের সাথে দেখতে হবে। আর যা হওয়ার ছিল তা সামনের দিনে করার প্রয়াস চালাতে হবে।

আব্দুল লতিফের ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়’ -এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন, গানের মাধ্যমে যে অভিযোগ এবং ফলশ্রুতিতে আত্মসম্মানকে রক্ষা করা, নিজস্বতাকে রক্ষা করার যে প্রয়াস ছিলো সেই শক্তিকে আমরা যেন হারিয়ে না ফেলি। বোধকরি একুশ আমাদের কাছে এমন দাবি রাখে। আমরা তো সেই জাতি যারা একটি সমৃদ্ধ ইতিহাসের উত্তরাধিকার। এই উত্তরাধিকারের ভার যেন আমরা বহন করে পরম্পরায় বয়ে চলি। একুশ তাই বলে।

তবে একুশ আরো বলে একুশের কবিতা, একুশের শিল্প-সাহিত্য, একুশের চলচ্চিত্র, একুশের গান, একুশের বক্তব্য- এসব অবশ্যই ভাষানির্ভর হতে হবে। সময় এসেছে নতুন করে ভাববার। ভাবতে হবে কেবল ভাষার জন্য, কেবল রাজনৈতিক অধিকারের জন্য, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যই একুশ আসেনি সেসময়ে। একুশের তাৎপর্য, গুরুত্ব, মাহাত্ম্য আরো অনেক বেশি। কেননা একুশের পথ ধরেই বাংলাদেশের জন্ম। পরাধীন অবস্থায় আমাদের পূর্বপুরুষরা যদি একুশ সৃষ্টি করতে পারে, স্বাধীন দেশে আমাদের ভূমিকা সততায়, মেধায়, সৌহার্দ্যে, সৌজন্যে, বিনয়ে, প্রতিবাদে, সংগ্রামে, দৃঢ়তায় আরো বলিষ্ঠ হওয়ার দাবি রাখে। এই একুশে আমরা সবাই ভাষার সাথে এই অঙ্গীকারে আবদ্ধ হই যেন আমরা যার যার ক্ষেত্রে, যার যার অবস্থান থেকে এমনভাবে কাজ করি, চলি, ব্রতী হই, সব সীমাবদ্ধতাকে জয় করে সামনে আগাই, যাতে দেশ ও দেশের মানুষ আরও সমৃদ্ধ হয়। একুশ আমাদের কাছে এমনটাই প্রত্যাশা করে।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক-বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

(ঢাকাটাইমস/১৮ফেব্রুয়ারি/জেডএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :