সরেজমিন পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

কাচের বাক্সে মুক্তিযুদ্ধের সরঞ্জাম, আছে সেই রেডিও আর পাগলা ঘণ্টাও

লিটন মাহমুদ, ঢাকা টাইমস
  প্রকাশিত : ২৬ মার্চ ২০২৪, ২১:৫৭| আপডেট : ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৩:২৬
অ- অ+

‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগে অবস্থিত তৎকালীন পুলিশের কেন্দ্রীয় ওয়্যারলেস বেজ স্টেশন থেকে দেশের বিভিন্ন পুলিশ লাইন্সে একটি বার্তা পাঠানো হয়। বার্তাটি ছিল- ‘বেইজ ফর অল স্টেশনস, ভেরি ইমপোর্টেন্ট মেসেজ। প্লিজ কিপ নোট। বেইজ ফর অল স্টেশনস অব ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ। কিপ লিসেন, ওয়াচ। উই আর অলরেডি অ্যাটাক্টড বাই পাক আর্মি। ট্রাই টু সেভ ইয়োরসেলফ। ওভার অ্যান্ড আউট।’

ভয়াল ওই রাতের সাড়ে ১১টার দিকে বেতার অপারেটর শাহজাহান মিয়া ‘হেলিকপ্টার ব্যাজ’ মডেলের একটি বেতারযন্ত্র থেকে এ বার্তাটি পাঠান।

মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত ওই বেতার যন্ত্রটি এখন স্থান পেয়েছে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের ভেতরে প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’-এ।

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ করেছিলেন অকুতোভয় বীর পুলিশ সদস্যরা। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে হানাদার বাহিনীর হামলা প্রতিরোধ করতে গিয়ে রাজারবাগে শহীদ হয়েছিলেন অনেক পুলিশ সদস্য। সেই ভয়াল রাতের ইতিহাসটি পুলিশের স্মৃতিবিজড়িত ইতিহাস যেমন, তেমন একটি স্বাধীন বাংলাদেশের জন্যও বটে! কিন্তু অনেকেই তা জানেন না। সেদিনের কালোরাতে দেশজুড়ে পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতা এবং অকুতোভয় বীর পুলিশ মুক্তিযোদ্ধাদের সেই আত্মত্যাগের ইতিহাস ও পুলিশের সশস্ত্র প্রতিরোধের অসংখ্য নিদর্শন নিয়ে ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ রাজধানীর রাজারবাগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’।

পঁচিশে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে আক্রমণ করলে তৎকালীন আইজিপির বডিগার্ড কনস্টেবল আব্দুল আলী পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে পুলিশ সদস্যদের জড়ো করেন। পাগলা ঘণ্টার আওয়াজ শুনে পুলিশ সদস্যরা অস্ত্র নিয়ে সমবেত হন। তার পরই ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করেন। সেই ঐতিহাসিক পাগলা ঘণ্টাটিও জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।

রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের পূর্বপাশে অবস্থিত এই জাদুঘরে সবার জন্যই উন্মুক্ত। বুধবার ব্যতীত প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। তবে শুক্রবার বিকাল ৩টা থেকে ৬টা পর্যন্ত। টিকিটের মূল্য ১০ টাকা।

দুইতলা বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক কাঠামোর এই জাদুঘরটির গ্রাউন্ড ফ্লোরে ‘বঙ্গবন্ধু গ্যালারি’ এবং বেজমেন্টে অবস্থিত ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’। জাদুঘরে প্রবেশ করতেই বঙ্গবন্ধু গ্যালারি। এর ঠিক মাঝ বরাবর গোলাকার দুটি সিঁড়ি নেমে গেছে জাদুঘরের মূল কক্ষে।

২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের দিনে সরেজেমিনে জাদুঘরের মূল কক্ষে প্রবেশ করতে চোখে পড়ে কাচের বাক্সে থরে থরে সাজানো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত টুপি, বেল্ট, টাই, স্টিক, ডায়েরি, বই, পরিচয়পত্র, চশমা, কলম, মেডেল, বাঁশি, মাফলার, জায়নামাজ, খাবারের প্লেট, পানির মগ, পানির গ্লাস, রেডিও, শার্ট, প্যান্ট।

আরও আছে র‌্যাঙ্ক ব্যাজসহ টিউনিক সেট, ক্যামেরা, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, মানিব্যাগ, লোহার হেলমেট, হ্যান্ড মাইক, রক্তভেজা প্যান্ট-শার্ট, দেয়ালঘড়িসহ কত কী! অন্যপাশে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ব্যবহৃত ৭.৬২ এমএম রাইফেল, ২ ইঞ্চি মর্টার, মর্টার শেল, সার্চ লাইট, রায়ট রাবার শেল, রিভলবার, .৩০৩ এলএমজি, মেশিনগান, ৭.৬২ এমএম এলএমজি, .৩২ বোর রিভলবার, .৩৮ বোর রিভলবার, .৩০৩ রাইফেল, ১২ বোর শটগান, ৯ এমএম এসএমজিসহ অনেক অস্ত্র।

আছে মোগল, ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের পুলিশের ইউনিফর্ম এবং পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত তরবারি, চাবুক, শিঙা, রামদা, তৎকালীন পুলিশপ্রধানকে দেয়া ভাওয়াল রাজার ঘোড়ার গাড়িটি। ২৫ মার্চের নৃশংসতায় এই গাড়িটি এবং আস্তাবলে রক্ষিত ঘোড়াও আক্রান্ত হয়েছিল।

এই জাদুঘরে রয়েছে একটি লাইব্রেরিও। এখানে মূলত মুক্তিযুদ্ধনির্ভর বইগুলো রাখা হয়েছে। আছে পুলিশ সদস্যদের আত্মজীবনী, রণাঙ্গনের স্মৃতি, পুলিশের নানা অবদানের ওপর লেখা বই। পাঠকরা চাইলে লাইব্রেরিতে বসে বই পড়তে পারেন। চারটি কম্পিউটারের মাধ্যমে অনলাইনে বিভিন্ন বই পড়তে পারবেন।

স্বাধীনতা দিবসের ছুটিতে মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর খিলগাঁও থেকে এই জাদুঘরে এসেছেন কলেজপড়ুয়া দুই বন্ধু সোহাগ ও রাতুল। ঢাকা টাইমসকে তারা জানান, সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে এই জাদুঘর সম্পর্কে তারা ধারণা পেয়েছেন। তারা বলেন, ‘এই জাদুঘরে দেখার মতো অনেক কিছু রয়েছে। যা সম্পর্কে তারা কিছুই জানতেন না।’ এজন্য সংশ্লিষ্টদের জাদুঘরটি নিয়ে প্রচারণার মাধ্যমে এখানে এই জাদুঘর আছে সেটি সম্পর্কে সবাইকে জানানোর আহ্বান করেন তারা।

সাপ্তাহিক ছুটি পেয়ে প্রথমবার এই জাদুঘরে ঘুরতে এসেছেন পুলিশ কর্মকর্তা সজিব চন্দ্র সরকার। তিনি বলেন, ‘আগে থেকে জানতাম জাদুঘর সম্পর্কে। কিন্তু আজই প্রথম আসলাম। মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে পুলিশ প্রতিরোধ গড়ে তোলে রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে। তার অনেক নিদর্শন এখানে এসে দেখতে পেলাম।’

জাদুঘরে দায়িত্বরত এক পুলিশ কর্মকর্তা ঢাকা টাইমসকে জানান, প্রতিদিন অর্ধশত মানুষ জাদুঘরে ঘুরতে আসেন। তিনি বলেন, ‘অনেকে এই জাদুঘর সম্পর্কে জানে না। আবার পুলিশ লাইন্সের কারণে অনেকে ভাবে এখানে সবাই ঢুকতে পারে না। এজন্য লোকজন কম আসে। তবে এখানে আগামী প্রজন্মের জানার ও দেখার অনেক কিছু সংরক্ষিত আছে।’

জাদুঘর সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের টেলিকম ভবনে প্রথম জাদুঘরটি উদ্বোধন করা হয়। পরে ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি বর্তমান জায়গায় দেড় বিঘা জমির ওপর নতুন এ ভবন উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাদুঘর ভবনের নকশা করেছেন স্থপতি মীর আল-আমিন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সামনে থাকা স্মৃতিস্তম্ভটির আদলেই দৃষ্টিনন্দন জাদুঘর ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। ভবনের উচ্চতা যাতে স্মৃতিস্তম্ভের উচ্চতার বেশি না হয়, সে কারণে ভূগর্ভেও জাদুঘরের মূল অংশ করা হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) বর্তমান কমিশনার হাবিবুর রহমান এই জাদুঘর নির্মাণের উদ্যোগ নেন।

জাদুঘরের পরিচালক ও পুলিশ সুপার তালেবুর রহমান বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর অবদানের স্মৃতি ধরে রাখতেই এই জাদুঘর স্থাপন করা। বিশেষ করে ২৫ মার্চ রাতে প্রথম প্রতিরোধ কীভাবে করা হয়েছিল, তা সংরক্ষণ করে জাদুঘরে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি।

তিনি জানান, ২৫ মার্চ রাজারবাগে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণে পুলিশ সদস্যদের তালিকা সম্বলিত সব রেকর্ড পুড়ে যায়। ফলে যুদ্ধের নয় মাসে কতজন পুলিশ সদস্য শহীদ হয়েছিলেন, তার সুনির্দিষ্ট তালিকা পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে একটি তালিকা করা হয়েছে, রাজারবাগ স্মৃতিস্তম্ভে তা লিপিবদ্ধ রয়েছে।

(ঢাকাটাইমস/২৬মার্চ/এলএম/ইএস)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
এপ্রিলের ২৯ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ২৬০ কোটি ৭৬ লাখ ডলার
নির্ধারিত সময়ের দুই মাস আগেই সব দেনা পরিশোধ করল পেট্রোবাংলা
ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করব: অর্থ উপদেষ্টা
উপদেষ্টাদের সঙ্গে পুলিশের মতবিনিময়, বিভিন্ন প্রস্তাব বাস্তবায়নের আশ্বাস
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা