উপজেলা নির্বাচন
বহিষ্কার আমলে নিচ্ছেন না বিএনপি নেতারা, প্রার্থীদের পক্ষে মাঠে তৃণমূল

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে অনেকটা বেকায়দায় পড়েছে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত থাকলেও চলমান উপজেলা নির্বাচনে তৃণমূল নেতাদের আটকাতে পারছে না দলটি। বহিষ্কারকে পরোয়া করছেন না তৃণমূল বিএনপির নেতারা। বরং বহিষ্কৃত নেতাদের পক্ষে নির্বাচনি মাঠে নামছেন দলটির তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মী।
প্রথম ধাপের ভোটে অংশ নেওয়ায় এরই মধ্যে ৭৬ জনকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তারা এখন দলের এই বহিষ্কারাদেশকেও উপেক্ষা করে নির্বাচনি প্রচারণা চালাচ্ছেন। এ নিয়ে তারা ভাবছেন না। এখন তাদের লক্ষ্য ভোটারের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং জয়ী হওয়া। এরই মধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে তারা বলছেন, নির্বাচনে জয়ী হলে দলই তাদের খুঁজে বের করে আবার দায়িত্ব দেবে।
বহিষ্কৃত নেতারা বলছেন, ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়াটা ছিল তাদের দলের ‘ঐতিহাসিক ভুল’। যে ভুলের খেসারত আজও দিচ্ছে গোটা দল। সবচেয়ে বেশি দিচ্ছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তাই নির্বাচনে অংশ নিয়ে এক অর্থে তারা দলকেই রক্ষা করছেন। একটা সময় দল এই ভুল বুঝতে পারবে।
দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপে অংশ নেওয়ায় বহিষ্কার করা হয়েছে ৭৬ জন নেতাকে। এই বহিষ্কার থেকে শিক্ষা না নিয়ে দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচনেও অংশ নিচ্ছেন আরও অনেকে। তাদের মধ্যে আরও ৬৬ জন নেতাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। দু-এক দিনের মধ্যেই তাদের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হবে। বিএনপির একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা এ তথ্য জানিয়েছেন।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বহিষ্কৃত প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করছেন বিএনপির অনেক নেতাকর্মী। এসব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধেও সাংগঠনিক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে কিনা তা নিশ্চিত করতে পারেননি দলটির নেতারা। তবে, বিএনপির বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এবং জেলার শীর্ষ নেতারা উপজেলা নির্বাচনের কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার জন্য নেতাকর্মীদের আহ্বান জানাচ্ছেন।
এ বিষয়ে সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. শাখাওয়াত হোসেন জীবন ঢাকা টাইমসকে বলেন, “আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নির্বাচন বর্জন করা। কেউ যেন একতরফা নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করেন। বহিষ্কার আমাদের মূল উদ্দেশ্য নয়। যারা বহিষ্কৃত প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করছেন আমরা তাদের নিবৃত্ত করার কাজ করছি। আমাদের প্রথম লক্ষ্য নেতাদের প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত রাখা। দ্বিতীয় লক্ষ্য নেতাকর্মীদের নির্বাচনি প্রচারণা থেকে বিরত রাখা। বিশেষ করে জেলা ও উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের প্রতি দল দৃষ্টি রাখছে।”
বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মতে, ক্ষমতাসীনদের চাপ ও ফাঁদে পড়ে দলের কেউ কেউ প্রার্থী হয়েছেন। তবে দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে যারা নির্বাচন করবেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কারণ, যে কোনো মূল্যে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা হবে।
দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সিদ্ধান্ত অমান্য করে জাতীয়সহ স্থানীয় সরকারের ভোট করায় গত কয়েক বছরে দল ও অঙ্গসংগঠনের পদধারী চারশ নেতাকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। এর মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা শতাধিক নেতা রয়েছেন। বাকিরা সিটি করপোরেশন, উপজেলা, পৌরসভাসহ স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে অংশ নিয়ে বহিষ্কৃত হয়েছেন। এ ছাড়া সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বিভিন্ন সময় দলটির আরও কিছু নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। পরে তাদের মধ্যে দলে ফিরতে ভুল স্বীকার করে শতাধিক নেতা আবেদন করলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ১৫-২০ জনের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হয়েছে। এ ছাড়া খুলনার নজরুল ইসলাম মঞ্জুসহ দলের বিভিন্ন পর্যায়ের আরও ২৫ নেতার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে বিএনপির।
বিএনপির ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বেনজির আহমেদ টিটু ঢাকা টাইমসকে বলেন, “আমি এখনও কালিহাতী (টাঙ্গাইল) ঘুরছি। মানুষের সঙ্গে কথা বলে দেখলাম ভোটের প্রতি তাদের কোনো আগ্রহ নেই। তারা জানে এ ভোট মূল্যহীন। জনগণের এই সেন্টিমেন্টের সঙ্গে বিএনপি একমত প্রকাশ করেছে। আর যারা এ ভোটের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ নির্বাচনকে সমর্থন দেওয়া মানে হচ্ছে জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া।”
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করলেও ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির স্থানীয় নেতারা অংশ নিয়েছিলেন। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে প্রথম দিকে অংশ নিলেও ভোটে অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগে ২০২১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার সিদ্ধান্ত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সব স্থানীয় নির্বাচন বর্জন করে আসছে বিএনপি। তবে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হওয়ায় কুমিল্লার মনিরুল হক সাক্কু, নারায়ণগঞ্জের তৈমূর আলম খন্দকারসহ অনেককে দলীয় বহিষ্কার করেছে বিএনপি।
তবে গণহারে দল থেকে এই বহিষ্কার তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে; দলকে আরও দুর্বল করবে কি না, এসব প্রশ্নও রয়েছে বিএনপিতে। এরপরও কঠোর অবস্থানেই থাকছে দলটির নেতৃত্ব।
জানা গেছে, উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নিতে দল থেকে নির্দেশনার পরও নেতারা প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেননি। একই কারণে সম্প্রতি তৃণমূলের ৭৫ জন নেতাকে বহিষ্কার করেছে বিএনপি। দুই ধাপে দলটির নেতাদের বহিষ্কারের সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ১৪১।
দ্বিতীয় দফায় বহিষ্কারের তালিকায় থাকা ৬৬ জনের মধ্যে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন ২৯ জন। ২০ জন নেতা হয়েছেন ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী; আর মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী ১৭ জন। এর বাইরে দ্বিতীয় ধাপে প্রার্থী হওয়া নেতাদের মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৬ জন ও ভাইস চেয়ারম্যান পদের ২ জন প্রার্থী নিজেদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে এখন জোর আলোচনা, এ নির্বাচন ঘিরে শেষ পর্যন্ত বহিষ্কারের তালিকা ৩০০-এ ঠেকতে পারে। এ অবস্থায় উপজেলা নির্বাচন ঘিরে কেন্দ্রের সঙ্গে তৃণমূলের দূরত্ব বেড়েই চলেছে।
বিএনপির সূত্র বলছে, সাংগঠনিক শৃঙ্খলা অটুট রাখতে শক্ত অবস্থান নিয়েছে দলটির হাইকমান্ড। প্রথম ধাপে নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের প্রথমে শোকজ করলেও নোটিশের জবাব দেননি, আবার কেউ কেউ নোটিশ পেয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহারও করেছেন। নোটিশ দেওয়ার পর তৃণমূলের এই নেতাদের সঙ্গে রুহুল কবির রিজভী এবং কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকরা কথাও বলেছেন। যাদের কাছে বহিষ্কারের চিঠি পাঠানো হয় তাদের মধ্যে ৩০ জন উপজেলা চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী, ২৫ জন ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী এবং ২১ জন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী রয়েছেন।
দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়া বহিষ্কৃত নেতারা বলছেন, অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই নির্বাচনে অংশ নেওয়া জরুরি। স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হচ্ছে না। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগসহ সব প্রার্থী স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। তৃণমূল কর্মীদের সংগঠিত করতে এবং কর্মী সমর্থকদের চাপেই তারা নির্বাচন করতে বাধ্য হচ্ছেন। এভাবে বহিষ্কার করতে থাকলে কেন্দ্রের সঙ্গে তৃণমূলের দূরত্ব বাড়তেই থাকবে। তবে বহিষ্কৃত ৭৫ জনের মধ্যে গত দুই দিনে দুইজন দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন।
দলের নীতিনির্ধারকরা বলছেন, সংসদ নির্বাচন বর্জনের চার মাসের মাথায় অনুষ্ঠেয় উপজেলা নির্বাচনের ব্যাপারে শুরু থেকেই কঠোর অবস্থানে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। তারা বলছেন, এই সরকারের অধীন কোনো নির্বাচনই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হওয়ার সুযোগ নেই। যেসব কারণে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি, সেসব কারণ এখনো বহাল আছে। বরং একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতাসীন দল আরও কর্তৃত্ববাদী হয়েছে। এ অবস্থায় উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলন হাস্যকর হয়ে যাবে।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ঢাকা টাইমসকে বলেন, “বিএনপি একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক দল। এখানে মত-দ্বিমত থাকবেই। দ্বিমত না থাকলে একটি দল একনায়কতন্ত্রে পরিণত হয়। যেমনটা আওয়ামী লীগ চলছে এক ব্যক্তির নির্দেশে, দ্বিমত করার সুযোগ নেই। কিন্তু বিএনপিতে গণতান্ত্রিক চর্চা রয়েছে।”
তিনি বলেন, “এ নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েই বা লাভ কি? বিরোধী দলের নির্বাচিতদের চেয়ারে বসতে দেওয়া হয় না। জেলে পাঠানো হয়। চিঠি দিয়ে সরিয়ে ফেলা হয়। যারা এই পণ্ডশ্রম করছেন তারা ভুল করছেন। তারা যখন ভুল বুঝতে পারবেন তখন তাদের আর কিছুই করার থাকবে না।”
গত ২৮ অক্টোবর ঢাকার মহাসমাবেশে সহিংসতার পর প্রায় ২৭ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এখনো কয়েক হাজার নেতাকর্মী কারাবন্দি। অসংখ্য মামলায় সারাদেশে লাখ লাখ নেতাকর্মী আদালতে ঘুরছেন। এ পরিস্থিতিতে উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেয়া আন্দোলনের নৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করবে। ভোটে অংশ নেওয়া দলের বর্তমান ও সাবেক নেতাদের বহিষ্কার করার মধ্য দিয়ে কার্যত বিএনপির মাঠপর্যায়ে চরম বার্তা পৌঁছানো হয়েছে।
এবার চার ধাপে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হচ্ছে। গত ২১ মার্চ উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপের তফসিল ঘোষণা করা হয়। প্রথম ধাপে ৮ মে ১৫০ উপজেলায় ভোট হবে। দ্বিতীয় ধাপে ভোট হবে ২১ মে হবে। এ ধাপে ভোট হবে ১৪৮ উপজেলায়।
(ঢাকাটাইমস/০৩মে/জেবি/এফএ)

মন্তব্য করুন