রাখাইনে ফের দমনপীড়নের শিকার রোহিঙ্গারা, পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ঘরবাড়ি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, ঢাকা টাইমস
| আপডেট : ২১ মে ২০২৪, ১৪:১৯ | প্রকাশিত : ২১ মে ২০২৪, ১৩:১০

মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে দেশটির সামরিক বাহিনী এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) মধ্যে লড়াইয়ের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে ওই অঞ্চলে বসবাসকারী হাজার হাজার মুসলিম রোহিঙ্গা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, রাখাইনের বুথিডুয়াং শহরের স্থানীয় রোহিঙ্গারা জানিয়েছে, গত কয়েকদিনে শহরজুড়ে ব্যাপক অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এ অগ্নিসংযোগ অভিযানের পেছনে আরাকান আর্মিকে অভিযুক্ত করেছে রোহিঙ্গারা। তবে এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আরাকান আর্মি বলছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিমান হামলার মাধ্যমেই এসব আগুনের সূত্রপাত হয়েছে।

ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশন অ্যাডভোকেসি গ্রুপের সহ-প্রতিষ্ঠাতা নে সান লুইন আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘এখন পর্যন্ত, লোকেরা এখনো নিরাপদ জায়গার সন্ধানে রাস্তায় রয়েছে। সেখানে কোনো খাবার বা ওষুধ নেই। তাদের অধিকাংশই ব্যক্তিগত জিনিসপত্র বহন করতে পারেনি।’

নে সান লুইন দাবি করেছেন, গত সপ্তাহের শেষের দিকে একটি আলটিমেটাম জারি করেছে আরাকান আর্মি, যেখানে ১৮ মে (শনিবার) সকাল ১০টার মধ্যে রোহিঙ্গাদের বুথিডুয়াং খালি করার নির্দেশ দেওয়া হবে। গোষ্ঠীটি ইতিমধ্যে একটি স্কুল ও হাসপাতালসহ রোহিঙ্গারা আশ্রয় নিয়েছিল এমন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আক্রমণ করেছে, যার ফলে অসংখ্য রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছেন বলেও দাবি করেন তিনি।

লুইন আরও বলেন, ‘পুরো শহরজুড়ে রোহিঙ্গাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে এএ সৈন্যরা।’

অন্তত চারটি ভিন্ন সূত্র আল জাজিরাকে জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের তাদের বাড়িঘর থেকে জোরপূর্বক তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

রোহিঙ্গা সূত্র জানায়, গত ১৭ মে থেকে বুথিডুয়াংয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নিরাপত্তা চেয়েছে। যেখানে তাদের ঘরবাড়ি, সরকারি ভবন, হাসপাতাল এবং স্কুলসহ সকল উপলব্ধ জায়গা দখল করে নিয়েছে আরাকান আর্মি।

আল জাজিরা স্বাধীনভাবে দাবিগুলো যাচাই করতে পারেনি কারণ রাজ্যটির ইন্টারনেট এবং মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে গেছে।

এদিকে আরাকান আর্মি কথিত অগ্নিসংযোগের অভিযানে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে। তবে সপ্তাহের শেষের দিকে ঘোষণা করেছে- তারা বুথিডুয়াংয়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।

গত রবিবার আরাকান আর্মির কমান্ডার-ইন-চিফ মেজর জেনারেল তোয়ান মারত নাইং তার এক্স অ্যাকাউন্টে একটি সতর্কতা পোস্টে বলেন, ‘আর-বাঙালি (রোহিঙ্গা বাঙালি) প্রবাসী অ্যাক্টিভিস্ট এবং গোষ্ঠীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে- আমরা একটি নৃশংস সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে মহান ও আত্মত্যাগের সাথে লড়াই করছে। দয়া করে স্বার্থপরতা এবং নাশকতা বন্ধ করুন, সংগ্রামকে ভুল দিকে টেনে নিবেন না। বিদেশি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে একটি পৃথক ইসলামিক নিরাপদ অঞ্চল তৈরি করার আপনার ভুল পরিকল্পনা পরিত্যাগ করার সময় এসেছে, এটি অত্যন্ত দেশদ্রোহিতার কাজ।’

প্রসঙ্গত, ‘বাঙালি’ শব্দটিকে রোহিঙ্গারা একটি অপবাদ বলে মনে করে।

সোমবার ইউনাইটেড লীগ অব আরাকান দাবানলের জন্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে দায়ী করে একটি বিবৃতিতে বলছে, বুথিডুয়াংয়ে সেনাবাহিনীর এবং তার সহযোগীদের বিমান হামলায় শহরটিকে ধ্বংস হয়ে গেছে।’

মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, এ হামলা-অগ্নিসংযোগের জন্য যেই দায়ী হোক না কেন এটি জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার আরেকটি গুরুতর তরঙ্গের বিপদের সতর্কতা, যা ২০১৭ সালের চেয়েও খারাপ হতে পারে।

সেসময় আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ) নামে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী বেশ কয়েকটি পুলিশ পোস্টে হামলা চালানোর পর দেশটির সেনাবাহিনী তাদের গ্রামে ধারাবাহিক হামলা চালানোর পর সাড়ে ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে যায়।

যারা পালিয়েছে তারা বাংলাদেশে বিস্তীর্ণ শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে, প্রায় ৬ লাখ রোহিঙ্গা এখনো মিয়ানমারে রয়ে গেছে, বেশিরভাগই রাখাইন রাজ্যে এবং কঠোর নিষেধাজ্ঞার মধ্যে বসবাস করছে।

স্যাটেলাইট চিত্র

বাংলাদেশ এবং রাখাইনে রোহিঙ্গাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে এমন একটি মানবাধিকার সংস্থা ফরটিফাই রাইটসের মতে, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে এমন একটি রাজ্যে (রাখাইন) পরিস্থিতি অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ।

ফোরটিফাই রাইটস বলেছে, ‘হামলার জন্য কারা দায়ী তা যাচাই করা অত্যন্ত কঠিন, গত দুই রাতের প্রতিবেদনগুলো হতাশাজনক।’

ফোরটিফাই রাইটসের মানবাধিকার সহযোগী সাই আরকার আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘এএ এবং জান্তাকে অবশ্যই ঘরবাড়িসহ বেসামরিক অবকাঠামোর ক্ষতি বা লক্ষ্য করা থেকে বিরত থাকতে হবে। যে এলাকা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে সেটিকে সামরিক লক্ষ্য বলে মনে হচ্ছে না। মাঝরাতে ধানক্ষেতে শিশুসহ হাজার হাজার রোহিঙ্গা আটকে পড়ার খবর পাওয়া গেছে।’

মিয়ানমারের বিশেষ উপদেষ্টা পরিষদ, এসএসি-এম নামে পরিচিত, জাতিসংঘের সাবেক বিশেষ র‌্যাপোর্টারদের একটি দল যারা ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, তারা পরিস্থিতির ওপরও জোর দিয়েছে।

মিয়ানমারে জাতিসংঘের সাবেক বিশেষ র‌্যাপোর্টার এবং এসএসি-এম-এর প্রতিষ্ঠাতা ইয়াংহি লি আল জাজিরাকে বলেছেন, এমন বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন রয়েছে যে বুথিডুয়াংয়ের রোহিঙ্গাদের ওপর আক্রমণ করছে আরাকান আর্মি। এই আক্রমণগুলো আরও বাড়তে পারে বলে মনে করেন তিনি।

এদিকে অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউটের (এএসপিআই) একজন ভূ-বিশ্লেষক নাথান রাসার আল জাজিরাকে বলেছেন, রাখাইনে সংঘাতের জটিলতার পরিপ্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক অগ্নিসংযোগের জন্য কে দায়ী তা প্রমাণ করা কঠিন, তবে স্যাটেলাইট এবং অন্যান্য উপলব্ধ প্রমাণের ভিত্তিতে ধারণা করা হচ্ছে অগ্নিসংযোগের ঘটনাগুলোর পেছনে সম্ভবত আরাকান আর্মি রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমরা যা দেখছি তা হলো- উত্তর রাখাইন রাজ্যের বুথিডুয়াং শহরে ব্যাপকভাবে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।

রাসার উল্লেখ করেছেন, গত ১১ এপ্রিল থেকে ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত বুথিডুয়াংয়ে সবচেয়ে অগ্নিসংযোগের একটি তরঙ্গ লক্ষ্য করা যায়। এর মধ্যে বেশিরভাগ অগ্নিসংযোগ বুথিডুয়াংয়ের উপকণ্ঠে প্রাথমিকভাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বের গ্রামগুলোকে লক্ষ্য করা হয়েছে। এসব এলাকার অন্তত ৩৫টি গ্রামে আগুনে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।

উল্লেখ্য, ইউনাইটেড লীগ অব আরাকানের সশস্ত্র শাখা, আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের একটি জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং তাদের প্রায় ৩০ হাজার সৈন্য রয়েছে বলে মনে করা হয়। গোষ্ঠীটি রাখাইনের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের প্রতিনিধিত্ব করে এবং রাজ্যে স্বায়ত্তশাসন চায়। গত বছরের নভেম্বরে সেনাবাহিনীর সঙ্গে অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি ভেঙে ব্যাপক হামলা শুরু করে এবং রাজ্যের একাধিক শহর দখলে নেয় আরাকান আর্মি।

(ঢাকাটাইমস/২১মে/এমআর)

সংবাদটি শেয়ার করুন

আন্তর্জাতিক বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :